Sunday, January 29, 2023

মহাবিশ্বের জ্ঞান অর্জনে কুরআনি তাগিদ

 

মহাবিশ্বের জ্ঞান অর্জন কোনো বিলাসী কাজ নয়। এ বিষয়ে পশ্চিমা জগত এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে, কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের এ ব্যাপারে কোনো চেতনা নেই। অথচ মহাকাশ গবেষণা ঈমানকে মজবুত করার জন্য অপরিহার্য। আল্লাহতা’য়ালাই আমাদের প্রকাশমান বিশ্বলোক সম্পর্কে চিন্তা ও গবেষণা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে কুরআনপাকে এরশাদ হচ্ছে-
“ইন্না ফি খালকিস সামাওয়াতি ওয়াল আরদি ওয়াখতিলাফিল লাইলি ওয়ান্নাহারে লাআয়াইতিল্ লি উলিল আলবাবিল্লাজিনা ইয়াজ কুরুনাল্লাহা কিয়ামাওঁ ওয়া কুয়ুদা ওয়া য়ালা জুনুবিহিম ওয়া ইয়াতাফাক্কারুনা ফি খালকিস্ সামাওয়াতে ওয়াল আরদি... (আলে ইমরান-১৯০)
অর্থাত- আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে; দিবস ও রাত্রির পরিবর্তনে, নিশ্চিত নিদর্শনাবলী রয়েছে প্রকৃত বুদ্ধিমান লোকদের জন্য। যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে বসা ও শায়িত অবস্থায় সর্বক্ষণ এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি পর্যায়ে চিন্তা-ভাবনা করে।
এই চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণার ফলশ্রুতিতে একজন ঈমানদার পরম সত্যে উপনীত হয় এবং মহান আল্লাহর একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় লাভ করে।
মহান আল্লাহ আকাশ গবেষণার তাগিদ দিয়ে ইরশাদ করেন-
“আফালাম ইয়ানজুরু ইলাস্ সামায়ে ফাওকাহুম কাইফা বানাইনাহা ওয়া ঝাইয়ান্নাহা ওয়া মালাহা মিন ফুরুজ। ওয়াল আরদা মাদাদনাহা ওয়া আলকাইনা ফিহা রাওয়াসিআ ওয়া আনবাতনা মিন কুল্লি ঝাওজেম্ বাহিজ। ( কাফ-৬-৭)
অর্থাত-ওরা কি কখন ও ওদের উপর অবস্থিত আকাশমন্ডলের দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখছে কিভাবে তা আমরা নির্মাণ করেছি, সুসজ্জিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত বানিয়েছি এবং তাতে কোনো ফাঁক ফাটল নেই? আর যমীনকে আমরা সুবিন্যস্ত করেছি, তার বুকে বড় বড় পর্বতরাশি দাঁড় করিয়ে দিয়েছি এবং তাতে তরতাজা চাকচিক্যময় জোড়াসমূহ উতপাদন করেছি?
সুসজ্জিত সুবিন্যস্ত আকাশমন্ডল মানুষের নিকট চিরদিনের জন্য এক মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণার ফলে এই মহাবিস্ময় আরও বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মুসলমানদের আবদান আরও ব্যাপক হওয়া উচিত ছিল।
বিশ্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয় বেশ পরে। ইসলামের প্রথমদিকে দীনের মৌলিক শিক্ষা প্রচার ও বাস্তবায়নে বহু বছর কেটে যায়। পরে হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যভাগে শিয়া মতবাদের ছায়াতলে ইখওয়ানুস সাফা নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। এই দলটির প্রকৃত অবদান হলো তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা। তারা অংক, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা দর্শন, সঙ্গীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রবন্ধ রচনা করেন।
জ্যোতিষ শাস্ত্রের উতকর্ষতা শুরু হয় খলিফা আল মামুনের কালে (৮১৯-’৩৩ খ্রিঃ)। মামুনের রাজত্বকালে অনুবাদ কার্যের ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি মামুনের প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল এবং তিনি নিজেও একজন জ্যোতির্বিদ ছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যা সম্বন্ধে ব্যাপক গবেষণা চালানোর জন্য তিনি বাগদাদের সন্নিকটে ট্যাডমোরের প্রান্তরে শামসিয়া নামক স্থানে মান মন্দির নির্মাণ করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মান মন্দির। খলিফা আল মামুনের সময় সিনদ বিন আলী এবং ইয়াহ বিন- আবি মনসুরের তত্ত্বাবধানে এই মান মন্দির নির্মিত হয়। আল মামুন দামেস্কের নিকট কাসিয়ুনেও একটি মান মন্দির নির্মাণ করেন। আব্বাসীয় খিলাফতের অন্যতম প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ আবু আল- আব্বাস আহমদ আল ফারগানী। পরবর্তী কালে স্পেনের জ্যোতির্বিদ মাসলামা আল মাজরিতি জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সারণী বিশোধিত করেন। বুয়াইয়া আমলে বাগদাদে যে মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় উহাতে আবদুর রহমান আস সুফী, আহমদ আস সাগানী এবং আবু ওয়াফা গবেষণা কার্য পরিচালনা করেন। অনন্ত বিশ্ব সম্পর্কে জানার জন্য মামুনের উতসাহে আরব জ্যোতির্বিদদের নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করতে গিয়ে Draper বলেন, “The Arabs have left unfading trace of their fingers on the sky which every one can see who reads the names of the stars on an celestial globe.” অর্থাত “আরবগণ নভোমন্ডলে যে অম্লান হস্তছাপ রেখেছেন তা যে কোনো ব্যক্তি ভূমন্ডলের নক্ষত্র সম্বন্ধীয় জ্ঞার আহরণকালে উপলব্ধি করতে পারবেন।”
ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ আল বাত্তানী (৮৭৭-৯১৮) খ্রিঃ রাক্কায় জ্যোতিষ শাস্ত্র গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। মৌলিক গবেষণায় তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। টলেমির সূত্র পরিবর্তন করে তিনি চন্দ্র এবং বিভিন্ন গ্রহের কক্ষ পথ সম্পর্কে অবিনব মত প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মাহমুদের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রের সমসাময়িক তত্ত্বাবলীর সমন্বয়ে “আল কানুন উল মাসূদী ফিল হাইওয়ান নজুম” শীর্ষক একটি গবেষণা প্রসূত গ্রন্থ ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে প্রণয়ন করেন।
বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ নবম ও দশম শতাব্দীতে সম্পূর্ণরূপে না হলেও, প্রভূত পরিমাণে তাইগ্রিস ও ফোরাত নদীর উপত্যকায় কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। দশম শতাব্দীর প্রথম চল্লিশ বছরের মধ্যে খলিফারা দীর্ঘদিনের জন্য পার্থিব ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন। বাগদাদ এবং পারস্যের উভয়স্থলে, প্রথমটিতে পারসিকদের শাসনকালে এবং দ্বিতীয়টিতে কোনো তুর্কী বংশীয়দের শাসনকালে অন্ধকারময়তার যুগ শুরু হয়ে গৈল। একইসময় আরব সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রশক্তি বৈজ্ঞানিকদের পৃষ্ঠপোষকতা কমিয়ে দিলেন। যেমন খলিফা হাকিম ( ৯৯৬-১০২১) কর্তৃক কায়রোতে প্রতিষ্ঠিত “বিজ্ঞান সভার” বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ২৫৭ দিনার। এসব কারণে মুসলমানরা প্রতিযোগিতায় খ্রিস্টান ইউরোপের সঙ্গে টিকে থাকতে পারলো না। কারণ ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই ইউরোপে নাগরিক জীবন ও শিল্প বাণিজ্যে বিবর্তন শুরু হয়ে যায়। ইউরোপের রেনেসাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় মুসলমানগণ টিকে থাকতে পারলো না। পঞ্চদশ শতাব্দীর পরে ইসলামিক জগত বর্বরতায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছিল। যে সমস্ত অনুকূল পরিবেশে মুসলমান সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক উন্নতি ঘটেছিল, বর্তমানে সেগুলোর অভাব। আজ তাই মুসলমানদের পুনরায় হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে হবে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে প্রচুর আয়াত রয়েছে মহাবিশ্ব সম্পর্কে চিন্তা গবেষণার তাগিদ দিয়ে যেমন-
“আলাম তারা কাইফা খালাকাল্লাহু সাবায়া সামাওয়াতেন তিবাকা, ওয়া জায়ালাল কামারা ফিহিন্না নুরাওঁ ওয়া জায়াআশ্ শামসা সিরাজা। ( নুহ- ১৫-১৬)
অর্থাত-তোমরা কি ভেবে দেখেছ আল্লাহ কিভাবে স্তর বিন্ন্যাস করে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেছেন, তাতে চন্দ্রকে আলো বানিয়েছেন এবং সূর্যকে বানিয়েছেন প্রদীপ।
“কুল সিরু ফিল আরদে ফানজুরু কাইফা বাদায়াল খালকা (আল আনকাবুত-২০)
অর্থাত- বল হে নবী! তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ কর অতঃপর লক্ষ্য করে দেখ, আল্লাহ সৃষ্টিকর্ম কিভাবে সৃষ্টি করেছেন।
“ওয়া কাআইয়িম্ মিন আয়াতিন ফিস্ সামাওয়াতে ওয়াল আরদে ইয়ার্মুরুরনা আলাইহা ওয়া হুম আনহা মু’রেদুন। (ইউসুফ- ১৫)
অর্থাত- মহাকাশ ও পৃথিবীতে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। লোকেরা তার উপরে দৃষ্টি ফেলে চলে যায়, কিন্তু তার মর্ম বুঝতে ইচ্ছুক নয়।
এতসব নির্দেশ থাকার পরেও মুসলিম বিশ্ব এখনও নীরব। আজ যদি মুসলমানরা আবার গবেষণা কার্যে লেগে যায় তাহলে মহাবিশ্ব রহস্য তাদের হাতের মুঠোয় এসে যাবে।

সূত্র: মনসুর আহমদ

Wednesday, January 25, 2023

মানার খবর নেই অথচ নামাযের মতো গুরুত্বপূরণ কাজ করতে মসজিদে আসি

 সালাতে মোবাইল ফোন : জরুরি মাসয়ালা

এখন প্রায় প্রতিটি মসজিদের একই চিত্র যে, জামাতে সালাত চলা অবস্থায় মুসল্লির মোবাইলে রিং বেজে ওঠে। সালাত অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু যে তার সালাতেরই বিঘ্ন ঘটায় এমন নয়; বরং আশপাশের মুসল্লিদেরও খুশুখুজু বিঘ্নিত হয়। সালাত অবস্থায় মসজিদে যেহেতু পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে, তাই মোবাইল বেজে ওঠার সাথে সাথেই সবার ধ্যানখেয়াল চলে যায় মোবাইলের রিংটোনের দিকে। অথচ সালাত অন্য সব ইবাদত থেকে ভিন্ন ধরনের একটি ইবাদত। এ ইবাদতটি হলো সরাসরি আল্লাহ তায়ালার দরবারে হাজিরা দিয়ে তাঁর মহান সত্তার সামনে দণ্ডায়মান হয়ে তাঁর সাথে কথোপকথনের এক অপূর্ব মুহূর্ত। এ কারণেই সালাত অবস্থায় একাগ্রতা ও খুশুখুজুর প্রতি যেভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অন্য কোনো ইবাদতের বেলায় তেমনটি করা হয়নি।
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘ওই সব মু’মিন সফলকাম, যারা নিজেদের সালাতে বিনয়-নম্র।’ (সূরা মু’মিনুন : ১-২) তাই একজন মুসল্লির উচিত মসজিদে প্রবেশের আগেই মোবাইল একেবারে বন্ধ না করলেও অন্তত রিংটোন বন্ধ করে দেয়া। এ অবস্থায় মোবাইলে ভাইব্রেশন দিয়ে রাখাও ঠিক নয়। কারণ ভাইব্রেশন দিয়ে রাখলেও কল এলে মুসল্লির মনোনিবেশ নষ্ট করে। এতে অন্যের সালাতের ক্ষতি না হলেও নিজের সালাতের খুশুখুজু নষ্ট হয় অবশ্যই। তা ছাড়া মোবাইলটি তখন পাশের মুসল্লির শরীরে স্পর্শ করলে তারও সালাতের একাগ্রতা নষ্ট হবে। তাই ভাইব্রেশন দিয়ে রাখাও ঠিক নয়; বরং হয়তো সাইলেন্ট করে রাখবে, কিংবা একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে। কোনো কারণে যদি সালাতের আগে মোবাইলের রিং বন্ধ করা না হয় আর সালাত পড়াবস্থায় রিং বেজে ওঠে তখন করণীয় ও লক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো নিম্নরূপ-
১. দুই হাত ব্যবহার না করে নামাজের আপন অবস্থায় থেকেই এক হাতের সাহায্যে মোবাইল পকেটে রেখেই কোনো বাটন চেপে রিং বন্ধ করে দেবে। আর পকেট থেকে বের করার প্রয়োজন হলেও এক হাত দিয়েই করবে। মোবাইল বের করে পকেটের কাছে রেখেই না দেখে দ্রুত বন্ধ করে পকেটে রেখে দেবে। জেনে রাখা প্রয়োজন, সালাতে প্রয়োজনে এক হাত কোনো কাজে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে যেমন- টুপি উঠানোর জন্য, জামার হাতা নামানোর জন্য, সিজদার স্থানের কঙ্কর সরানোর জন্য, শরীরের কোনো স্থান বিশেষ প্রয়োজনে চুলকানোর জন্য ইত্যাদি। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/৫৬৪, শরহুল মুনিয়াহ-৪৪৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া-১/১০৫, খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার : ১/৬২৪, শরহে নববী : ১/২০৫)
২. এক হাত দিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে মোবাইল পকেট থেকে বের করে দেখে দেখে বন্ধ করা যাবে না। কারণ এমনটি করলে যদিও দুই হাত ব্যবহার হচ্ছে না, কিন্তু মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করা অবস্থায় এ ব্যক্তিকে কেউ দেখলে সে সালাতে আছে বলে মনে করবে না। আর সালাত অবস্থায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সালাত ভেঙে যায়। তাই সালাত অবস্থায় মোবাইল দেখে দেখে বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। (রদ্দুল মুহতার : ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক : ২/১১-১২)
৩. সালাতে মোবাইল বন্ধের জন্য একসাথে দুই হাত ব্যবহার করা যাবে না। যদি একসাথে দুই হাত ব্যবহার করে তবে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/২৬৪-২৬৫, আলবাহরুর রায়েক : ২/১১-১২)
৪. সিজদাবস্থায় রিং বেজে উঠলে কেউ কেউ সিজদা থেকে প্রায় বসে গিয়ে মোবাইল বের করে বন্ধ করে থাকে। অথচ তখনো ইমাম-মুসল্লি সবাই সিজদাতেই থাকে। সালাতের এ অবস্থা থেকে মোবাইল বন্ধের জন্য বসে যাওয়াতে নামাজ ভেঙে যাবে। যদিও মোবাইল বন্ধ করাতে তিন তাসবিহ পরিমাণ সময় ব্যয় না হয়। কারণ যেখানে দুই হাতের ব্যবহারকেই সালাত ভঙ্গের কারণ বলা হয়েছে, সেখানে পুরো শরীরকে সালাতের অবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা নিঃসন্দেহে সালাত ভঙ্গের কারণ হবে। এ ছাড়া এ অবস্থায় কোনো আগন্তুক তাকে দেখলে সে সালাতে নেই বলেই মনে করবে। এটিও আমলে কাসিরের অন্তর্ভুক্ত, যা সালাত নষ্টকারী।
৫. তিনবার বিশুদ্ধভাবে ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আজিম’ বা ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ বলা যায়- এ পরিমাণ সময়ের ভেতর উপরন্তু দু’বার পর্যন্ত এক হাতের সাহায্যে উপরোক্ত ১ নম্বরে উল্লেখিত নিয়মে রিং বন্ধ করা যাবে। এ সময়ের ভেতর দুইবারের বেশি বন্ধ করা যাবে না। যদি করে তবে সারাত নষ্ট হয়ে যাবে। হ্যাঁ, একবার বা দু’বার বন্ধ করার পর তিন তাসবিহ পরিমাণ বিলম্বে আবার রিং বেজে উঠলে তখন বন্ধ করা যাবে। মোট কথা, তিন তাসবিহ বলা যায় এ সময়ের ভেতর তিনবার রিং বন্ধের জন্য এক হাতও ব্যবহার করা যাবে না। এতে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ১/১২৯, রদ্দুল মুহতার : ১/৬২৫, আহসানুল ফাতাওয়া : ৩/৪১৮-৪১৯)
৬. মোবাইল প্যান্টের পকেটে থাকলে তা বের করে বন্ধ করার জন্য দুই হাত ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। তদ্রƒপ ফোল্ডিং সেট হলেও রিং বা ফোন বন্ধ করতে কখনো কখনো দুই হাত ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। অথচ দুই হাত ব্যবহার করলে সালাত ভেঙে যায়। তাই এ ক্ষেত্রে কি নিজের সালাত নষ্ট করে হলেও রিং বন্ধ করবে? নাকি করবে না। মূলত সালাতে খুশুখুজুর গুরুত্ব অনেক বেশি। এতই বেশি যে, কোনো মুসল্লির মল-মূত্রের বেগ হওয়ার দরুন খুশুখুজু বিঘ্নিত হলে তার জন্য সালাত ছেড়ে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। ফিকহের কিতাবাদিতে এ ক্ষেত্রে সালাত ছেড়ে দেয়াকে উত্তম বলা হয়েছে। কেউ কেউ ওয়াজিবও বলেছেন। (তাহতাবি আলাল মারাকি-১৯৮, হিন্দিয়া : ১/১০৭, আল বাহরুল রায়েক : ১/২৮৭, রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৪)
তাহলে সালাত অবস্থায় মোবাইল বেজে উঠলে যার মোবাইল শুধু তার সালাতেরই বিঘ্ন ঘটায় না; বরং আশপাশের মুসল্লিদেরও খুশুখুজু বিঘনিত হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সালাত নষ্ট না করে বন্ধ করা সম্ভব না হলে সালাত ছেড়ে দিয়ে হলেও মোবাইল বন্ধ করা জায়েজ তো বটেই; বরং এমনটি করাই কর্তব্য। আর রিংটোন যদি গান বা মিউজিকের হয়, তবে এর খারাবি তো আরো অধিক। সুতরাং এ ধরনের পরিস্থিতিতে সালাতে থেকে উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী এক হাত দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হলে তাই করবে। আর তা সম্ভব না হলে নিজের সালাত ছেড়ে দিয়ে হলেও রিং বন্ধ করে দেবে। এরপর মাসবুকের ন্যায় আবার নতুন করে জামাতে শরিক হবে। (রদ্দুল মুহতার : ১/৬৫৫)
সোর্সঃ মুফতি পিয়ার মাহমুদ, সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, তালতলা, ময়মনসিংহ

দাড়ি

 আরবি শব্দ লাহি (চোয়ালথেকে আগত লিহইয়াহ অর্থ দাড়ি দাড়ি নবীর সুন্নাত যা একজন মুসলিম পুরুষের জন্য আবশ্যক অথচ মিথ্যার মায়াজাল কিছু মানুষকে সত্য থেকে দূরে রাখে দাড়ি সমস্যা একটি অনাহুত সৃষ্টি দাড়ি না রাখার অজুহাত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে দুনিয়ায় রাসূল সা:-এর চেয়ে স্মার্ট কেউ নেইচলনে-বলনে তিনি সমগ্র জাতির মডেল আল্লাহ তায়ালা বলেননিশ্চয় আল্লাহর রাসূলের মাঝে তোমাদের জন্য আছে উত্তম আদর্শ (সূরা নিসা : ৮০)

অজুহাত নিরসনএক শ্রেণীর চাকরিজীবী মন্তব্য করেনঅফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অধ্যাদেশনুযায়ী কর্মচারীরা চলতে বাধ্যসেখানে স্মার্টনেসের একটা ফিডব্যক পাওয়া যায়নানা ধরনের সুযোগ দাড়ি রাখলে হাত ছাড়া হয়ে যায়। আর কিছু অফিসে তো নির্দেশই দেয়া থাকে দাড়ি না রাখারসেজন্য রাখছি না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাকে খুশির জন্য আমাদের চলা উচিতআল্লাহকে নাকি অফিসের বসকে?

এক শ্রেণীর ছাত্রের অভিমতক্লাসে দাড়ি রেখে যাওয়া আর হাসির পাত্র সাজা একইআর এখন স্টাডির সময়জীবন উপভোগের সময় সময় দাড়ি রাখলে অল্প বয়সেই বৃদ্ধ দেখা যায়। অথচ তাদের অজানা  বয়সই ইবাদতের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ

আল্লাহ বলেননিশ্চয় আল্লাহর রাসূল-সাএর মাঝে তোমাদের জন্য আছে উসওয়াতুন হাসানাহ। (নিসা : ৮০আসল কথা হচ্ছে দাড়ি অশোভন হলে আল্লাহ দাড়ি দিতেন নাকারণ তিনি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন

সম্মানের মাপকাঠি দাড়িপৃথিবীর বহু মনীষী দাড়ি রেখে প্রমাণ করে গেছেন দাড়িতে সম্মান বৃদ্ধি পায়। বিশ্বকবি হিসেবে পরিচিত রবিন্দ্রনাথ নিজ আবক্ষ প্রলম্বিত দাড়ি নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করে প্রত্যেক স্থানে সম্মানের আসনে বসেছেন। হিন্দু সন্নাসীখ্রিষ্টান পাদ্রিমুসলিম সম্প্রদায় পীর  আলেমগণ দাড়ি রেখে থাকেন। এতে প্রমাণ হয় যে দাড়ি ধার্মিকতা  রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে

দাড়ি স্বাস্থ্যবিধিশ্লেষ্মার আক্রমণ হতে নিরাপত্তায় দাড়ি অনুকূল ভূমিকা পালন করে। দাড়ি শেভ করার ফলে মুখমণ্ডলের সূক্ষ্ম স্নায়ুগুলো বারংবার আহত হয় আঘাত চোখের শিরাসমূহে পৌঁছে যার ফলে দৃষ্টিশক্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়। এই দাড়ি শেভের ফলেই সংক্রামক রোগসমূহ দ্রুত বিস্তার লাভ করে

বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর মূর বলেনত্বকের জন্য আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি অত্যন্ত ক্ষতিকর রশ্মি সূর্যকিরণের সাথে মিশে ত্বকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এছাড়া শেভ করার কারণে পিটুইটারি গ্লান্ডে ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দেয়  নার্ভ সিস্টেম মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। দাড়ি শেভ করার কারণে ত্বক  শরীর যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয় সম্ভবত অন্য কোনো কারণে শরীরে এত ক্ষতি হয় না

সালেহীনদের মতামত : হজরত আয়েশা রাবলেন১০টি বিষয় সব নবী রাসূলগণের সুন্নাত তার মধ্যে গোঁফ ছোট করা  দাড়ি লম্বা করা অন্যতম। (মুসলিম শরিফ : /১২৯)

মুসলিম পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা ওয়াজিব বিধান বিভিন্ন হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছেহানাফি মাজহাবের কিতাব আদ্দুররুল মুখতার গ্রন্থে উল্লেখ আছে দাড়ি কাটা হারাম। দাড়ি এক মুষ্টির চেয়ে ছোট করা মেয়েলি স্বভাবআর পুরোপুরি কেটে ফেলা ফারসি  হিন্দুস্তানি মুশরিকদের প্রথা
আল উম্ম গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছেইমাম শাফেয়ির মতে দাড়ি মুণ্ডন হারাম। এছাড়া হাম্বলি আলেমদের মাঝে  ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই

আল মুহাল্লায় উল্লেখ আছেইবনে তাইমিয়াহ বলেনসহিহ হাদিস থেকে প্রাপ্ত হুকুমের ফলে দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম। কোনো আলেম কখনোই এর অনুমোদন দেননি

তাফসিরে রুহুল মায়ানির ১৭ পারার ৬৬ পৃষ্ঠায় নিম্নলিখিত হাদিসটি উল্লেখ আছেহজরত দাউদ বলেছেন১০টি কুকর্মের দরুন হজরত লুৎ :-এর কওম ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছেতার মধ্যে

দাড়ি কর্তন।

মোচ লম্বা রাখা।

হাতে তালি দেয়া।

রেশমি বস্ত্র পরিধান করা ইত্যাদি

 

ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতি হচ্ছেশরিয়ত প্রবর্তক কর্তৃক কোনো বিষয়ের প্রতি সাধারণ নির্দেশ হলে তা পালন ওয়াজিব  বিপরীত করা হারাম। আল্লাহ বলেনযে কেউ রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করেতার কাছে সরল পথ প্রমাণিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলেআমি তাকে ওই দিকেই ফেরাব যেদিক সে অবলম্বন করেছে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব। আর তা নিকৃষ্টদের গন্তব্য। (সূরা নিসা : ১১৫)
রাসূলের অনুসরণ হোক পূর্ণভাবে : রাসূলের সুন্নাতকে ভালোবাসার মানে খাবারের পর কেবল মিষ্টি  অজুর পূর্বে মিসওয়াকেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়। আরো কিছু সুন্নাত আছেযা নিজ স্বার্থে যুক্তি দিয়ে দূরে না ঠেলে বরং উম্মতে মোহাম্মদি হিসেবে যথাযথভাবে পালন আবশ্যক

রাসূল সাবলেনযে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে মুহাব্বত করে সে যেন আমাকেই মুহব্বত করল। আর যে আমাকে মুহাব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে বসবাস করবে। (তিরমিজি শরিফমিশকাত শরিফপৃ৩০)

রাসূলের সুন্নাত পালনকারীই প্রকৃত স্মার্ট : ফিতরাতের বিপরীত কাজ করতে করতে আমাদের চোখে বিকৃতটাই স্বাভাবিক হয়েগেছে। দাড়ি শেভ করা ব্যক্তিকে অভিনন্দন জানানো মানেই দ্বীনে প্রতিষ্ঠিত একটি বিধানের বিরোধিতা করা। আর যদি দাড়ির বিধান না জেনে দাড়ি মুণ্ডন সমর্থন করা হয় তবে তা কুফুরি হবে

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা নিসার ৮০ নং আয়াতে বলেছেনযে রাসূলের আনুগত্য করল সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। ব্যক্তি স্বার্থে নিজের জীবন স্থির না রেখে একটুখানি বুদ্ধির সাথে যদি রাসূল সা:-এর সুন্নাত অনুযায়ী চলা যায় তবে সহজেই দুনিয়াদারি দ্বীনদারিতে পরিণত হবে

মহান রাব্বুল আলামিন প্রতিটি মুসলিম যুবককে রাসূলের সুন্নাত জীবনে বাস্তবায়নের জান্নাতি সৌভাগ্য দান করুন। আমিন

-সূত্রউম্মেহানী বিনতে আবদুর রহমান