হাটে হাঁড়ি ভাঙা
আজও অধিকাংশ গ্রামগঞ্জে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে হাট বসে। আগে প্রায় সব গ্রামগঞ্জেই বসত। হাটের দিন লোকের ভিড় হতো জিনিস কেনাবেচার জন্য। আর হাঁড়ি রান্নাঘরের উপকরণ। আগে মূলত মাটির হাঁড়িতেই রান্না হতো। এখন কেউ যদি অন্দরমহল বা ভেতরবাড়ির হাঁড়ি হাটে নিয়ে ভাঙে, তবে সেই ঘটনা হাটের সবাই দেখতে পাবে। এমনকি এ কান–ও কান হয়ে বাকিরাও জেনে যাবে। এখান থেকে ‘হাটে হাঁড়ি ভাঙা’র অর্থ দাঁড়িয়েছে, কোনো গোপন কথা সবার সামনে ফাঁস করে দেওয়া।
‘ধোপে টেকা’ কথাটিকে অন্যভাবে বলা যায়—ধোয়ার পরও টিকে থাকা। আগের দিনে রঙিন কাপড় কেনার সময় ক্রেতাকে কাপড়ের রং নিয়ে ভাবতে হতো। কারণ, রং পাকা না হলে ধোয়ার পর কাপড় থেকে রং উঠতে শুরু করত। অর্থাত কাপড়ের রং যাচাইয়ের জন্য ধোয়ার কাজটিই ছিল আসল পরীক্ষা। এখান থেকে ‘ধোপে টেকা’ বাগ্ধারাটি এসেছে। এর অর্থ হলো, কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া বা বাধাবিঘ্ন পার হয়ে টিকে থাকা।
ছিনিমিনি খেলা
মাটির হাঁড়ি বা কলসির ভাঙা ছোট টুকরাকে বলা হয় খাপরা। এই খাপরা বা ছিন্ন টুকরা পুকুরে বিশেষভাবে ছুড়ে মারার খেলাকে বলা হয় ছিনিমিনি। ছিনিমিনি খেলার সময় খাপরা এমনভাবে পানিতে ছোড়া হয়, যাতে সেটা ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত যায়। এ ধরনের খেলা মূলত শিশুরাই খেলে। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু নিয়ে এ রকম ছেলেখেলা করলে তখন বলা হয় ‘ছিনিমিনি খেলা’ বা যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করা।
মানিকজোড়
মানিক এক রকম রত্ন, যার রং লাল। কিন্তু এই বাগ্ধারার সঙ্গে মানিকজোড় নামের জলচর পাখির সম্পর্ক আছে। মানিকজোড় বকের মতো দেখতে, বেশ বড় পাখি। এদের পা দুটি হয় লম্বা ও লালরঙা। দূর থেকে মনে হয় যেন একজোড়া মানিক। একইভাবে দুজন মানুষকে যদি বেশির ভাগ সময় একসঙ্গে চলতে–ফিরতে বা কাজকর্ম করতে দেখা যায়, তখন তাদেরকে বলে মানিকজোড়। মানিকজোড় পরস্পর ভালো কাজের সঙ্গী, খারাপ কাজেরও সঙ্গী হতে পারে।
মেকি কান্না
ফারসি ‘মেখ’ অর্থ গোঁজ বা ভেজাল। বাংলায় ‘মেকি’ শব্দের অর্থ কৃত্রিম, নকল বা কপট। সুদূর অতীতে রুপার মুদ্রাব্যবস্থা চালু ছিল। তখন আসল রুপার মুদ্রার মধ্যে অনেক সময় একই রকম করে বানানো লোহা বা অন্য ধাতুর নকল মুদ্রা চালিয়ে দেওয়া হতো। এসব নকল বা জাল মুদ্রাকে বলা হয় মেকি। মেকি মুদ্রার কোনো দাম নেই। তেমনি লোক দেখানো কান্না বা নকল কান্নাকে বলে মেকি কান্না। কিছু লোক অন্যের ক্ষতি করে কিংবা অন্যের ক্ষতিতে খুশি হয়েও মেকি কান্না কাঁদে।
পেটে বোম মারা
এ রকম কথা হরহামেশা শুনতে পাই, ‘পেটে বোম মারলেও কথা বের হবে না।’ এই বোম কোনো বোমা বা বিস্ফোরক নয়। এটি লোহার তৈরি একধরনের লম্বা সুচালো কাঠির মতো জিনিস। এটা দিয়ে খোঁচা দিয়ে মুখ বন্ধ করা বস্তা থেকে চাল বের করা হয়। বস্তায় বোম মেরে চাল বের করা যায়, কিন্তু কোনো মানুষ যদি মুখ বন্ধ করে থাকে এবং তার জানা বিষয়টিও গোপন করে রাখে, তখন বলা হয় পেটে বোম মারলেও কথা বের হবে না।
বিন্দুবিসর্গ
‘বিন্দুবিসর্গ’ বাগ্ধারার অর্থ একটু, কিছুমাত্র, অণুমাত্র। অর্থাত কোনো কিছুর সামান্যতম আভাস বা ইঙ্গিতকে বলে বিন্দুবিসর্গ। বিন্দু বলতে বোঝানো হয় অনুস্বার (ং)। একসময় লিপি যখন হাতে লেখা হতো, তখন অনুস্বার লেখার জন্য কেবল বিন্দু বা ফোঁটা চিহ্ন ব্যবহার করার চল ছিল। বিন্দুর নিচে রেখার মতো কোনো টানা দাগ ছিল না। এই বিন্দু বা অনুস্বারের পরের বর্ণ বিসর্গ (ঃ)। দুইয়ে মিলে হয়েছে বিন্দুবিসর্গ। সংস্কৃত ভাষার অনেক শব্দের শেষে বিন্দু ও বিসর্গ আছে। এই ব্যাপারটিও যখন কারও অজানা থাকে, তখন সাধারণভাবে বলা যায়, সে বিন্দুবিসর্গও জানে না।
বানচাল করা
‘বান’ বা ‘বাইন’ শব্দটি এসেছে ‘বয়ন’ থেকে। নৌকার নিচের দুই তক্তার সন্ধি বা জোড়ার মুখকে বলে বান বা বাইন। বাইন শক্ত না হলে নৌকার তক্তার জোড়া দিয়ে পানি ঢোকে। বান বিচ্ছিন্ন হলে নৌকা ডুবে যায়। অর্থাৎ ‘বানচাল’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ—নৌকার জোড়া বা তক্তা ফাঁক হয়ে যাওয়া। আর তাই কোনো পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য পণ্ড করে দেওয়াকেও আমরা বলি বানচাল করা। সব মিলিয়ে ‘বানচাল’ করা বাগ্ধারাটির অর্থ দাঁড়ায় ভন্ডুল করা, ভেস্তে যাওয়া, ফাঁসিয়ে দেওয়া।
তুবড়ি ছোটা
কারও মুখ থেকে যখন একটানা কথা বের হতে থাকে, তখন বলা হয়, মুখ দিয়ে কথার তুবড়ি ছুটছে! ‘তুবড়ি’ শব্দটি হিন্দিতে তুমড়ি। এটি একধরনের আতশবাজি। মাটির খোলে বারুদ পুরে তুবড়ি বানানো হয়। দেখতে হয় অনেকটা পেটমোটা পেঁয়াজের মতো। তারপর এর চিকন মাথার দিকে আগুন দিলেই চারদিকে বারুদের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত আলো ছড়িয়ে তুবড়ি জ্বলতে থাকে। তাই কারও মুখ থেকে তুবড়ির মতো অনর্গল কথা ছুটতে থাকলে এই বাগ্ধারা ব্যবহার করা হয়।
শশব্যস্ত
‘শশ’ শব্দের অর্থ শশক বা খরগোশ। এদের চলাফেরা দেখে মনে হয়, এরা বুঝি খুব ব্যস্ত। অত্যন্ত সতর্ক ও চঞ্চল প্রাণী হিসেবেই খরগোশ পরিচিত। এই সতর্কতার কারণ এদের কান। খরগোশের কান অনেক লম্বা ও বাঁকানো হয়। ফলে সামান্য শব্দও এরা ভালো শুনতে পায়। আর এদের চঞ্চল মনে হয় এদের চলা ও লাফানোর ভঙ্গি দেখে। শিকারির হাত থেকে বাঁচার জন্য এরা এঁকেবেঁকে দৌড়াতে থাকে। মানুষের মধ্যে খরগোশের মতো ব্যস্ততা দেখা গেলে তাকে বলা হয় শশব্যস্ত।
কূপমণ্ডূক
‘কূপ’ মানে কুয়া, আর ‘মণ্ডূক’ মানে ব্যাঙ। ‘কূপমণ্ডূক’ শব্দের সাধারণ অর্থ কুয়ার ব্যাঙ। কুয়ার ব্যাঙ কুয়ার ভেতরে থাকে; সেখান থেকে সে বাইরে আসতে পারে না। ফলে তার কাছে মনে হয়, ওইটুকুই বুঝি জগৎ। ওইটুকু জগতের খবরই সে জানে, কুয়ার বাইরের দুনিয়ার কোনো খবর সে জানে না। একইভাবে কোনো মানুষ যদি কুয়ার ব্যাঙের মতো সীমাবদ্ধ জ্ঞানবিশিষ্ট হয়, সে যদি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিশাল দুনিয়ার খবর না রাখে, তখন তাকে কূপমণ্ডূক বলা হয়।
বুজরুকি কাণ্ড
‘বুজুর্গ’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ দরবেশ বা সাধু। বুজুর্গ শব্দ থেকে ‘বুজরুকি’ শব্দটি এসেছে। দরবেশ বা সাধুদের অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। এসব ক্ষমতা দেখে মানুষ অবাক হয়ে যেত। সাধারণভাবে বুজরুকি কাণ্ড বলতে বোঝানো হয় অলৌকিক কাজ বা অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিন্তু বাগ্ধারায় এর অর্থ প্রতারণা বা চাতুরী। সাধারণ মানুষের পক্ষে অলৌকিক কাণ্ড দেখানো সম্ভব নয়। তাই কোনো লোক যদি অবিশ্বাস্য কাজ করে ফেলেছে বলে দাবি করে, তখন তাকে বলা হয় প্রতারণা বা বুজরুকি কাণ্ড।
হন্যে হয়ে খোঁজার এই ‘হন্যে’টা কী?
হনন করা যায় বা মেরে ফেলা যায় এমন জন্তুকে বলা হয় ‘হন্য’। শিকারি কোনো প্রাণী পেছনে ধাওয়া করলে ওই প্রাণী জীবন বাজি রেখে ছুটতে থাকে। ওই সময় শিকারের কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। একইভাবে কোনো মানুষ যখন ভালো–মন্দ জ্ঞান হারিয়ে কোনো কিছু খোঁজে, তখন তাকে বলা হয় হন্যে হয়ে খোঁজা। অন্যভাবে বলা যায়, হন্যে হয়ে খোঁজা মানে কিছু করা বা পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে চেষ্টা করা।
হেস্তনেস্ত করা
হেস্তনেস্ত করা মানে ভালো বা মন্দ যেকোনো ধরনের নিষ্পত্তি করা। এটাই তখনকার মতো ওই কাজের শেষ সমাধান বা চরম ফয়সালা। ‘হেস্তনেস্ত’ শব্দটি এসেছে ফারসি ‘হস্ত’ ও ‘নিস্ত’ থেকে। এখানে, হস্ত বা হেস্ত শব্দের অর্থ হওয়া, আর নিস্ত বা নেস্ত শব্দের অর্থ না–হওয়া। দীর্ঘদিন ধরে কোনো কাজে হওয়া না–হওয়ার দ্বিধা থাকলে চূড়ান্ত সমাধান চাওয়া হয়। হয় এটা, নয় ওটা—এ রকম বোঝাতেও হেস্তনেস্ত শব্দের ব্যবহার আছে।
হাবুডুবু খাওয়া
‘হাঁপ’ ও ‘ডুব’—এ দুটি শব্দের সঙ্গে উ–প্রত্যয় যোগ করে হয়েছে হাবুডুবু। এই শব্দের মধ্যে আছে ‘হাঁপ’ অর্থাতশ্বাসের কষ্ট এবং ‘ডুব’ অর্থাত ডুবে যাওয়ার কষ্ট। প্রতিদিনের অনেক সমস্যায় আমাদের হিমশিম খেতে হয়। একবার মনে হয়, সমস্যা থেকে ওঠা সম্ভব হয়েছে, একবার মনে হয়, সমস্যার মধ্যেই ডুবে আছি। এ রকম ভাসা আর ডোবার সঙ্গে মিল থাকায় কোনো কাজে কূলকিনারা না পেলে বলা হয় হাবুডুবু খাওয়া।
ফোড়ন কাটা
সবজি বা ডাল রান্নার একপর্যায়ে ফোড়ন দিতে হয়। গরম তেলে ভেজে নেওয়া শুকনা মরিচ, জিরা, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলাকে বলা হয় ফোড়ন। রান্না কিছু সময়ের জন্য থামিয়ে ফোড়ন তৈরি করে সেখানে ঢেলে দিতে হয় সবজি বা ডাল। ফোড়ন দেওয়ার সময় ছ্যাঁত করে শব্দ হয়। একইভাবে দুজনের কথার মাঝখানে তাদের থামিয়ে মন্তব্য করাকে বলা হয় ফোড়ন কাটা। আলাপের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির কথা বলা বা ফোড়ন কাটা ওই দুজনের জন্য বিরক্তির কারণ হয়।
ঢুঁ মারা
‘ঢুঁ মারা’ বাগ্ধারার অর্থ অতি সামান্য সময়ের জন্য কোথাও যাওয়া। এ ধরনের যাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ থাকে না। ঢুঁ মারা বাগ্ধারাটি এসেছে ছাগলের ঢুস্ মারা থেকে। ছাগল কখনো কখনো মানুষ দেখে কারণ ছাড়াই তেড়ে এসে মাথা দিয়ে ঢু্ মারে। একইভাবে কোনো কোনো সময় আমরা কারণ ছাড়াই কোনো জায়গায় মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিই এবং দেরি না করেই সেখান থেকে চলে আসি।
পাততাড়ি গোটানো
‘পাততাড়ি’ শব্দের সাধারণ অর্থ পাতার তাড়ি বা পাতার গুচ্ছ। কাগজ উদ্ভাবনের আগে তালপাতা বা কলাপাতায় লেখা হতো। ছাত্ররা পাঠশালায় তালপাতা বা কলাপাতার গোছা নিয়ে যেত এবং সেই পাতায় লেখাজোখা করত। পাঠশালার পাঠ শেষ হলে তারা পাতার তাড়ি গুছিয়ে বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরত। এখান থেকে পাততাড়ি গোটানো বাগ্ধারাটি এসেছে। এর অর্থ দাঁড়িয়েছে কাজ হয়ে যাওয়ার পর সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে সরে পড়া বা পালিয়ে যাওয়া।
বিড়ালতপস্বী
যারা ভালো মানুষের ভাব ধরে থাকে এবং সুযোগ বুঝে খারাপ কাজ করে, তাদের বলা হয় বিড়ালতপস্বী। বিড়াল সাধারণত চুপিসারে শিকার ধরে। ধীরে ধীরে এবং সতর্কতার সঙ্গে তারা শিকারের কাছে যায়। এগিয়ে আসার সময়ে পেটে হামাগুড়ি দেয় এবং সব শেষে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই সাধু বা ভালো মানুষের বেশ থেকে হঠাত আক্রমণকারীর ভূমিকা যারা নেয়, তাদের জন্যই তৈরি হয়েছে এই বাগ্ধারা।
ঢাকের কাঠি
চামড়া দিয়ে মুখ আঁটা ঢোলজাতীয় বড় বাদ্যযন্ত্রকে ঢাক বলে। এটি ঘাড়ে ঝুলিয়ে, কোমরে বেঁধে কিংবা মাটিতে বা কোলে রেখে বাজানো হয়। ঢাক বাজাতে দুটি সরু কাঠি লাগে। ঢাকের মতো বড় জিনিসের নিত্যসঙ্গী এই কাঠি। মানে ঢাক যেখানে যায়, কাঠিও সেখানে যায়। গ্রামের মাতবর বা ক্ষমতাসীন লোকের সঙ্গেও সব সময় তার চাটুকার থাকে। চাটুকার বা তোষামোদকারী ব্যক্তি বোঝাতে ঢাকের কাঠি বাগ্ধারাটি ব্যবহার করা হয়।
ডুমুরের ফুল
ডুমুরের ফুল থাকে ফলের ভেতরে। অতি ছোট ছোট কীটপতঙ্গ সেই ফলের মধ্যে ঢুকে পরাগায়ন ঘটায়। ডুমুর ভাঙলে ভেতরে গর্ভকেশর, পুংকেশর সবই পাওয়া যাবে। ডুমুর ফুল গর্ভাশয় দ্বারা পুরোপুরি আবৃত হয়ে ফলের আকার ধারণ করে। অন্য ফুলের মতো ডুমুরের ফুল তাই সহজে দেখা যায় না। কোনো লোককে যদি সহজে দেখা না যায়, এরপর হঠাত একদিন তার দেখা মেলে, তখন তাকে ডুমুরের ফুল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
চোখের বালি
চোখে বালুকণা পড়লে চোখ খচখচ করে, চোখে পীড়া অনুভূত হয়। একইভাবে, কোনো কোনো মানুষ চোখের সামনে পড়লে বিরক্তি তৈরি হয়। যেসব মানুষকে দেখলে অস্বস্তি লাগে কিংবা চোখে বালিকণা পড়ার মতো পীড়া অনুভব হয়, তাদের বলে চোখের বালি। একই অর্থে চক্ষুশূল শব্দেরও প্রয়োগ আছে। অর্থাত যাকে দেখলে চোখে শূল বা বেদনার অনুভূতি হয়।
চোখের পর্দা
চোখের পর্দা অর্থ লজ্জা বা সংকোচ। চোখের পর্দা, চোখের পাতা, চোখের চামড়া—এগুলো সব অনুরূপ অর্থে প্রয়োগ করা হয়। চোখের ওপর পাতা বা নেত্রপল্লব সবারই থাকে। লজ্জা পেলে মানুষের চোখের পাতা এমনিতেই নেমে আসে। চোখে পাতা বা পর্দা থাকার কারণে লজ্জাজনক কাজ করতে মানুষ সংকোচ বোধ করে। কিন্তু বাগ্ধারায় বলা হয়, যে মানুষের চোখে পর্দা নেই, তার লজ্জা বলেও কিছু নেই।
চোখ ফোটা
বিড়াল, কুকুর, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি প্রাণী জন্মের পর দেখতে পায় না। এদের চোখের ওপর একধরনের পাতলা আবরণ থাকে। কয়েক দিন পর ওই আবরণ সরে গেলে চারপাশের সবকিছু দেখতে পায়। এভাবে চোখ ফুটতে প্রাণীভেদে ছয় দিন থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। মানবশিশু অবশ্য জন্মের পর থেকেই সবকিছু দেখতে পায়। তবে কোনো মানুষ যখন প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে বা বুঝতে পারে, তখন বলা হয়, এত দিনে চোখ ফুটেছে।
কলকে পাওয়া
নারকেলের খোল, মাটির পাত্র ও কাঠের নল দিয়ে তৈরি তামাক খাওয়ার বিশেষ উপকরণকে বলা হয় হুঁকা বা কলকে। গ্রামগঞ্জে অবসরে তামাক খাওয়ার সময় একটি কলকেই এক হাত থেকে আরেক হাতে ঘুরতে থাকে। কারও হাতে কলকে না এলে মনে করা হয়, সে সম্মান পেল না বা উপেক্ষিত থেকে গেল। তাই কলকে পাওয়া বাগ্ধারার অর্থ সম্মান পাওয়া বা উপেক্ষিত না হওয়া।
কাকতালীয়
পরস্পর সম্পর্কহীন দুটি ঘটনা একসঙ্গে ঘটলে তাকে বলা হয় কাকতালীয় ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে মনে হয়, একটির কারণে যেন আরেকটি ঘটনা ঘটেছে! কাকতালীয় শব্দের মধ্যে আছে ‘কাক’ ও ‘তাল’—এই দুটি শব্দ। ধরা যাক, একটি কাক উড়ে এসে তালগাছে বসল; আর তখনই তালগাছ থেকে তাল পড়ল। এই আকস্মিক ঘটনা দুটির মধ্যে আদৌ কোনো সম্পর্ক বা কার্যকারণ নেই। একইভাবে, কাকতালীয় ব্যাপারেও দুটি ঘটনা সম্পর্ক ছাড়াই একত্রে ঘটে।
আক্কেল গুড়ুম
আরবি ‘আকল’ থেকে আক্কেল শব্দটি এসেছে। এর অর্থ বুদ্ধি, বিবেচনা, কাণ্ডজ্ঞান। আর ‘গুড়ুম’ হলো কামান থেকে গোলা বের হওয়ার শব্দ। আকস্মিক কোনো ঘটনায় আমাদের বুদ্ধি, বিবেচনা মাঝেমধ্যে লোপ পায় বা হারিয়ে যায়। হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়ার এই পরিস্থিতিকে বলা হয় আক্কেল গুড়ুম অবস্থা। কামানের গোলা লেগে বুদ্ধি হঠাত উড়ে গেলে যে অবস্থা হয়, আরকি!
টিপ্পনী কাটা
অনেকে অন্যের কথার মাঝখানে বাড়তি কথা বলে কিংবা মন্তব্য যোগ করে। এভাবে কথার মাঝখানে কথা বলাকে টিপ্পনী কাটা বলে। কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে কিংবা বাড়তি তথ্য যোগ করার জন্য বিভিন্ন লেখায় টীকা–টিপ্পনী যোগ করা হয়। টীকা হলো কোনো শব্দ বা বিষয়ের ব্যাখ্যা। আর টিপ্পনী হলো যে বিষয়ের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, তার ওপরে ব্যবহৃত বিশেষ চিহ্ন
ঘোল খাওয়ানো
দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। এরপর সেটিকে ৮–১০ ঘণ্টা জমিয়ে রাখলে দই হয়ে যায়। এই দই ফেটিয়ে মাখন আলাদা করা হয় ঘি বানানোর জন্য। আর বাকি অংশে পানি মিশিয়ে ভালো করে ঘুঁটে তৈরি করা হয় ঘোল। ঘোলে দুধের মূল উপাদান ননি বা মাখন থাকে না। ফলে ঘোল খাওয়ানো বলতে কাউকে ঠকানো বোঝায়।
খেই হারানো
সুতা ও এ–জাতীয় জিনিসের মুখ বা প্রান্তকে বলা হয় খেই। অনেক সময় সুতার প্রান্তভাগ বা আগা খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন কাটিম থেকে সুতা বের করতে সমস্যা হয়। আবার মানুষ কথা বলার সময় কিংবা গল্প করার সময় অনেক ক্ষেত্রে বিষয় বা প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলে। কাটিমের সুতার মতো এভাবে কথার সূত্র হারিয়ে ফেললে বলা হয় খেই হারানো।
চুনোপুঁটি
পুঁটি মাছ এমনিতেই আকারে ছোট হয়। জাতভেদে পূর্ণবয়স্ক একটি পুঁটির আকৃতি আড়াই থেকে ছয় ইঞ্চি হয়ে থাকে। কোনো কোনো পুঁটি মাছের
প্রজাতি দুই ইঞ্চির বড় হয় না। খালে–বিলে অল্প পানিতে এই মাছ বাস করে।
চুনো মানে ছোট; ফলে চুনোপুঁটি বলতে ছোট পুঁটি মাছকে বোঝানো হয়।
আর তাই নগণ্য বা গুরুত্বহীন কোনো মানুষকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয় চুনোপুঁটি বাগ্ধারাটি।
কই মাছের প্রাণ
কই মাছ পানি থেকে তোলার পরও ছয় থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকে। সাধারণ মাছেরা পানিতে ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকাজ চালায়।
কই মাছের শ্বাস নেওয়ার জন্য ফুলকা ছাড়াও বিশেষভাবে অভিযোজিত কানকো রয়েছে। মাথার দুই পাশে থাকা এই কানকোর সাহায্যে সে বায়ুমণ্ডল থেকেও দীর্ঘ সময় ধরে অক্সিজেন নিতে পারে। কঠিন প্রাণ কিংবা যা সহজে মরে না—এমন কোনো ব্যক্তি ও প্রাণী বোঝাতে কই মাছের প্রাণ বাগ্ধারাটির প্রয়োগ হয়।
রাঘববোয়াল
রামের বাবার নাম দশরথ। রাজা দশরথের ঠাকুরদাদার নাম রঘু। রঘু বংশে জন্ম যাদের, তাদের বলা হয় রাঘব। এই অর্থে রামের আরেক নাম রাঘব। ‘রাম’ শব্দটি বাংলায় বড় অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন, রামছাগল বলতে বড় ছাগল, রামদা বলতে বড় বা বিশাল আকারের দা বোঝানো হয়। একইভাবে, ‘রাঘব’ শব্দটিও বড় অর্থে ব্যবহৃত হয়। রাঘববোয়াল মানে তাই বড় আকারের বোয়াল মাছ। কিন্তু বাগ্ধারায় প্রভাবশালী বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে রাঘববোয়াল বলে।
শ্বেতহস্তী পোষা
শ্বেতহস্তী শব্দের সাধারণ অর্থ সাদা হাতি। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড—এসব দেশে সাদা হাতিকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব হাতিকে কোনো পরিশ্রম করানো হয় না। মনে করা হয়, সাদা হাতি রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখে। রাজার ন্যায়বিচার ও ক্ষমতার চিহ্নও এগুলো। সাদা হাতিকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে প্রতিপালন করা হয়। কোনো কাজে যদি অনেক খরচ হয়, অথচ কোনো অর্থকরী লাভ হয় না, তখন শ্বেতহস্তী পোষার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ষোলোকলা
ষোলোকলা অর্থ পুরোপুরি। অমাবস্যার পর চাঁদ একটু একটু করে বাড়তে থাকে। প্রাচীন ভারতীয়রা মনে করত, চাঁদের আকার পরিবর্তন করেন ষোলোজন দেবী। এঁরা থাকেন সূর্যে। প্রতিরাতে একজন করে চাঁদে আসতে থাকেন। ফলে চাঁদের আকারও বাড়তে থাকে। চাঁদের একেকটি আকারকে বলা হয় কলা। যেদিন ষোলোজন দেবীর সবাই চাঁদে এসে পৌঁছান, সেদিন পূর্ণিমা হয়। আর চাঁদের ষোলোকলাও পূর্ণ হয়। চাঁদের এই ষোলোকলার নাম—পূষা, যশা, সুমনসা, রতি, প্রাপ্তি, ধৃতি, ঋদ্ধি, সৌম্যা, মরীচি, অংশুমালিনী, অঙ্গিরা, শশিনী, ছায়া, সম্পূর্ণমণ্ডলা, তুষ্টি ও অমৃতা।
হাতের পাঁচ
একসময় জমিদারেরা স্ত্রীদের সঙ্গে তাসের বিন্তি খেলতেন। অন্দরমহলের নারীরাও নিজেরা বিন্তি খেলতেন। সাত ফোঁটা থেকে শুরু করে বড় তাসগুলো নিয়ে বিন্তি খেলা হয়। একই ক্রমের পরপর তিনটি তাস দেখাতে পারলে বিন্তি হয়। তখন প্রতিপক্ষকে ৬৭ ফোঁটা দেখাতে হয়। বিন্তি খেলায় যে শেষের পিঠ পায়, তার পাওনা হয় পাঁচ ফোঁটা। এই পাঁচ ফোঁটা থেকে হাতের পাঁচ বা শেষ সম্বল বাগ্ধারা এসেছে।
বাজখাঁই
অত্যন্ত কর্কশ ও উচ্চকণ্ঠকে বলা হয় বাজখাঁই। ষোলো শতকে উত্তর ভারতে বাজবাহাদুর খান বা সংক্ষেপে বাজ খাঁ নামে একজন শাসক ছিলেন। তিনি উঁচু গলায় গান গাইতে পারতেন।
মোগল সম্রাট আকবরের কাছে তিনি যুদ্ধে পরাজিত হন। তারপর তাঁর জায়গা হয় আকবরের দরবারে। সংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি বিশেষ পরিচিতি পান। চাপা গলায় অস্বাভাবিক উঁচু সুর তৈরি করতে পারতেন এই বাজ খাঁ। তাঁর নাম থেকেই বাজখাঁই বাগ্ধারাটি এসেছে।
ঢিমেতাল
তবলার অনেক রকম তাল আছে। এর মধ্যে ধীরগতির তাল আছে, দ্রুতগতির তালও আছে। ‘ঢিমে’ শব্দের অর্থ ধীর বা মন্থর। তেতাল বা তিনতাল একটি ধীরগতির তালের নাম। তবলার ধীরলয়ের তেতালের মতো কিছু লোকের কাজকর্মও হয় অতি ধীরগতির। অলস ও উদ্যমহীন লোকের চলাফেরা বা কাজকর্ম দেখে বলা হয় ঢিমেতাল। এ রকম লোক ঢিমেতালে চলে বা ঢিমেতালে কাজ করে।
ডানপিটে
‘ডান’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দণ্ড বা বাংলা ‘ডান্ডা’ থেকে। এর অর্থ লাঠি। আর ‘পিটে’ এসেছে পেটানো থেকে। যে ডান্ডা বা লাঠি দিয়ে কিছু পেটায়, তাকে ডানপিটে বলে। ডাংগুলি খেলার ‘ডাং’ অর্থও লাঠি। একসময় গ্রামাঞ্চলে ডাংগুলি খেলার খুব প্রচলন ছিল। দুরন্ত ছেলেরা কাজ ফেলে, পড়াশোনা না করে সারা দিন ডাংগুলি খেলে বা ডাং দিয়ে গুলি পিটিয়ে সময় কাটাত। এখান থেকে ডানপিটে বাগ্ধারার জন্ম। দুরন্ত স্বভাবের কিংবা শাসন মানে না, এমন ছেলেমেয়েদের ডানপিটে বলা হয়।
সূত্র: তারিক মনজুর: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments:
Post a Comment