কেবল ইসলামের তাকিদেই নয় বরং সামাজিক
দিক থেকেও বন্ধুত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এর করণ এই যে, একজন ব্যক্তির মানষিক গঠন, চিন্তা
শক্তি ও আচার আচরণবিকাশে বন্ধুত্ব বিশেষ ভূমিকা পালন করে। উপরন্তু বন্ধুত্ব একজন ব্যক্তির
আধ্যাত্মিক বিকাশ ও নৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে। তাই এটা থেকে অনুমিত হয় যে, একটা
সমাজের সাফল্য নির্ভর করে সেই সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর।
ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বন্ধুত্ব যদি
আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও প্রগাঢ় বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয় তবে এটা আশীর্বাদ
স্বরুপ। যদি এ সম্পর্ক অন্যান্য নগণ্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয় তবে এটা বেশীদিন
স্থায়ী হয় না। আল কুরআন ও হাদীস যে বন্ধুত্ব মানুষকে অপেক্ষাকৃত ভাল মুসলমান বানাবার
বদলে তাকে সত্য পথ হতে বিচ্যুত করে তার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছে। উদাহরণ স্বরুপ নবী
করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, “ব্যক্তি তার ঘনিষ্ট বন্ধুর জীবনধারা ও চিন্তা-চেতনা অনুসরণ
করে। সুতরাং তোমরা প্রত্যেকেই বন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে সতর্ক হও।”
আল কুরআন এভাবে সতর্ক করে দিয়েছে যে,
শেষ বিচারের দিন অবিশ্বাসীদের মধ্যে অনেকেই নিদারুন মনস্তাপে ভুগবে। কারণ তার অনুধাবন
করবে যে, এধরনের বন্ধুত্বের কারণে তার সত্য পথ হতে বিচ্যুত হয়েছিল। অন্যত্র আল্লাহ
তায়া’লা সতর্ক করে বলেন, অবিশ্বাসী বন্ধুগণ কিয়ামতের দিন শত্রুতে পরিণত হবে।
ধরিত্রীতে
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যেমন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রয়োজন, তেমনি সমাজে বেঁচে
থাকার জন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির। কেননা
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে চলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিই
এমন যে কোনো মানুষ একাকী থাকতে চায় না। সমাজের অন্য সবার সঙ্গে প্রীতির মেলবন্ধনে জড়িয়ে
থাকতে আগ্রহী। এই পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মায়াজাল মানুষের মধ্যে
বন্ধুত্বের আবহ সৃষ্টি করে। মানবজীবনে আদর্শ বন্ধু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়। তাই বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন খুবই জরুরি। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বন্ধুত্ব
গ্রহণ এবং এর মর্যাদা সম্পর্কে বহু বাণী উল্লিখিত হয়েছে। আসলে যে কাউকে বন্ধু বলা যায়
না, বন্ধু বানানো যায় না। মুসলমানদের উচিত সত্যবাদী, নামাজী, দ্বীনদার ও পরোপকারী ব্যক্তিকে
বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করা ।
রেফারেন্সঃ আল কুরআন থেকেঃ
১. জালেমরা সেদিন নিজেদের
হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, “হায়! যদি আমি রসুলের সহযোগী হতাম৷
Wa Yawma ya'adduz zaalimu 'alaa
yadaihi yaqoolu yaa laitanit takhaztu ma'ar Rasooli sabeelaa
২. হায়! আমার দুর্ভাগ্য, হায়! যদি আমি অমুক লোককে
বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম৷
Yaa wailataa laitanee lam attakhiz
fulaanan khaleelaa
৩. তার প্ররোচনার কারণে আমার কাছে আসা উপদেশ আমি মানিনি মানুষের জন্য শয়তান বড়ই বিশ্বাসঘাতক প্রমাণিত হয়েছে৷
Laqad adallanee 'aniz zikri ba'da iz
jaaa'anee; wa kaanash Shaitaanu lil insaani khazoolaa
৪. আর রসূল বলবে, “হে আমার রব! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা এ কুরআনকে হাসি -
ঠাট্টার লক্ষবস্তুতে পরিণত করেছিল ৷
Wa qaalar Rasoolu yaa Rabbi inna
qawmit takhazoo haazal Qur-aana mahjooraa
-সুরা আল ফুরক্কান আয়াত
২৭ থেকে ৩০
৫ কিন্তু
(তার এই সুস্পষ্ট শিক্ষা সত্ত্বেও) বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী পরস্পর মত পার্থক্য করলো৷ যারা
জুলুম করেছে তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক দিনের আযাব৷
Fakhtalafal ahzaabu mim bainihim
fawailul lillazeena zalamoo min 'azaabi Yawmin aleem
৬. এখন এসব লোকেরা কি
শুধু এ জন্যই অপেক্ষমান যে অকস্মাত এদের ওপর কিয়ামত এসে যাক এবং এরা আদৌ টের না পাক?
Hal yanzuroona illas Saa'ata an
taatiyahum baghtatanw wa hum laa yash'uroon
৭. যখন যে দিনটি আসবে তখন মুত্তাকীরা ছাড়া অবশিষ্ট সব বন্ধুই একে অপরের দুশমন হয়ে যাবে৷
Al akhillaaa'u
Yawma'izim ba'duhum liba'din 'aduwwun illal muttaqeen
-সূরা
যুখরফ আয়াত ৬৫ থেকে ৬৭
৮. আর
নিজের অন্তরকে তাদের সংগ লাভে নিশ্চিন্ত করো যারা নিজেদের রবের সন্তুষ্টির সন্ধানে
সকাল-ঝাঁঝে তাঁকে ডাকে এবং কখনো তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরাবে না৷ তুমি কি পার্থিব
সৌন্দর্য পছন্দ করো? এমন কোনো লোকের আনুগত্য করো না যার
অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির কামনা বাসনার অনুসরণ
করেছে এবং যার কর্মপদ্ধতি কখনো উগ্র, কখনো উদাসীন৷-সুরা
কাহাফ: ২৮
Wasbir nafsaka ma'al lazeena yad'oona Rabbahum bilghadaati
wal'ashiyyi yureedoona Wajhahoo wa laa ta'du 'aynaaka 'anhum tureedu zeenatal
hayaatid dunyaa wa laa tuti' man aghfalnaa qalbahoo 'an zikrinaa wattaba'a
hawaahu wa kaana amruhoo furutaa
৯.
মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, এরা সবাই পরষ্পরের বন্ধু ও সহযোগী৷ এরা
ভাল কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়
এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে৷ এরা এমন লোক যাদের ওপর আল্লাহর রহমত
নাযিল হবেই৷ অবশ্যি আল্লাহ সবার ওপর পরাক্রমশালী এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞ৷ –সূরা তাওবা আয়াত ৭১
Walmu'minoona wal mu'minaatu ba'duhum awliyaaa'u ba;d;
yaamuroona bilma'roofi wa yanhawna 'anil munkari wa yuqeemoonas Salaata wa
yu'toonaz Zakaata wa yutee'oonal laaha wa Rasoolah; ulaaa'ika sayarhamuhumul
laah; innallaaha 'Azeezun Hakeem
১০. 'হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী
হও।' (সুরা তাওবা: আয়াত ১১৯)
Yaaa aiyuhal lazeena aamanut taqul laaha wa
koonoo ma'as saadiqeen
১১. 'মুমিনগণ
যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর
সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।' (সুরা আলে ইমরান: ২৮)
Laa yattakhizil mu'minoonal kaafireena awliyaaa'a min doonil
mu'mineena wa mai yaf'al zaalika falaisa minal laahi fee shai'in illaaa an
tattaqoo minhum tuqaah; wa yuhazzirukumul laahu nafsah; wa ilal laahil maseer
রেফারেন্সঃ
হাদীস থেকেঃ
১.
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-'মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে সঙ্গী নির্বাচন করবে না।' (তিরমিজি)
২.
'মানুষ তার বন্ধুর ধর্ম (স্বভাব-চরিত্র) দ্বারা প্রভাবিত। সুতরাং সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব
করছে তা যেন অবশ্যই যাচাই করে নেয়।' (সুনানে আহমাদ, তিরমিজি)
৩. 'ভালো এবং দুষ্ট বন্ধু মিশক্ (সুগন্ধি) বহনকারী ও হাঁপরে
ফুঁকদাতা (কামার) ব্যক্তির মতো। মিশক্ বহনকারী ব্যক্তির অবস্থা তো এমন যে সে হয়তো এ
মিশক্ তোমাকে উপহার দেবে অথবা তুমি তার থেকে তা খরিদ করবে অথবা তুমি তার থেকে এর সুঘ্রাণ
লাভ করবে। আর হাপরে ফুঁকদাতা ব্যক্তি হয়তো সে তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে কিংবা তুমি
তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।' (বুখারি ও মুসলিম)
রেফারেন্স
৩: ড. জামাল আল বাদাবী: (ইসলামী শিক্ষা সিরিজ: প্রকাশনা: বাংলাদেশ ইন্সটিট্যুট অব ইসলামিক
থ্যট-বিআইআইটি: পৃষ্ঠা ২৮০)
রেফারেন্স ৪: বিভিন্ন বিষয় থেকে
“একদা
স্নানের আগারে পশিয়া
হেরিনু
মাটির ঢেলা,
হাতে
নিয়া তারে শুঁকিয়া দেখিনু
রয়েছে
সুবাস মেলা;
কহিলাম
তারে কস্তুরি তুমি? তুমি কি আতর দান?
তোমার
গায়েতে সুবাস মাখানো, তুমি
কি গুলিস্তাঁ?
সে কহিল আমি ওসব কিছূ নই!
আমি অতি নীচু মাটি!
ফুলে সহিত থাকিয়া আমি
সুবাসে হইনু খাঁটি।”
-শেখ সা’দী (রা.)
'বন্ধু হচ্ছে ছায়া দানকারী বৃক্ষের মতো যার প্রভাব তোমাকে
নিবিষ্ট করবেই।'- এস টি কোলরিজ,
দার্শনিক
'প্রত্যেক
নতুন জিনিসকেই উতকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু বন্ধুত্ব যতই পুরনো হয়, ততই উতকৃষ্ট ও সুদৃঢ়
হয়।'-অ্যারিস্টটল, দার্শনিক
'যার
সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। তা হলো-'বুদ্ধিমত্তা ও সত স্বভাবের
অধিকারী হওয়া এবং পাপাচারী, বেদআতি ও দুনিয়াসক্ত না হওয়া।'-হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালি
(রহ.)
পাঁচ
ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমীচীন নয়। তা হলো-মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী
ও কৃপণ ব্যক্তি।' -হজরত ইমাম জাফর আস-সাদিক (রহ.)
'নির্বোধের
বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো। কারণ সে উপকার করতে চাইলেও তার দ্বারা তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে।' -হজরত আলী (রা.)
'বন্ধুত্ব
করার সময় খুবই ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে; কিন্তু
যখন বন্ধুত্ব হয়ে যায় তখন তা দৃঢ়তর ও স্থায়ী
করো।'- সক্রেটিস, দার্শনিক
No comments:
Post a Comment