মিনার প্রামাণিক। দেশের একটি বিখ্যাত ইন্টান্যাশনাল স্কুলে মালীর কাজ করেন।
ফুলের সাথে কথা বলেন, ফুল গাছের নিবিড় পরিচর্যা করেন। একদিন স্কুলের পিওন এস বল্লো,
মিনার তোমাকে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ডেকেছেন। জলদি তার সাথে দেখা করো। পিওনের “জলদি”
কথাটা মিনারের মনের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিল। সে ভাবলো কী এমন হলো, আর আমিই বা কী এমন
ভুল করলাম যার কারণে ম্যাডাম আমাকে তলব করলেন?
মিনার দাস চট-জলদি তার হাত পা ধুয়ে নিলো। মোটামুটি ফ্রেশ মনে প্রিন্সিপ্যাল
ম্যাডামের কামরার দিকে চল্লো। বাগানের ধারেই ম্যাডামের কামরা কিন্তু এইটুক পথ যেনো
আর শেষ হচ্ছেনা। ওর বুকের ধুকধুকানী বেড়ে গেল। মনে হচ্ছে হৃদপিন্ডটা বুকের খাঁচার বাইরে
বেরিয়ে আসতে চাইছে। আসতে আসতে মিনার যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করে দেখলো –এমন কোন অন্যায়
ও করেনি। সে জানে সে কাজে আন্তরিক আর কখনোই কাজে ফাঁকি দেয়নি।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কামরার দরজায় গঙ্গা দরজায় টোকা দিল। প্রিন্সিপ্যাল
ম্যাডাম বল্লেন, মিনার এসেছো? ভেতরে এসো। প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের গলার শাসনের সূর
শুনে মিনার আরো ঘাবড়ে গেল। সোনালী কালো পরিপাটি চুলের ম্যাডাম বসে আছেন। পরনে ফ্রেঞ্চনটের
কাজ করা ক্লাসিক শাড়ি, নাকের ডগায় সোনালী ফ্রেমের চশমা আঁটা। ম্যাডাম মিনারকে লক্ষ্য
করে তার টেবিলে রাখা একটি কাগজের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন।
“কাগজটা পড়ো, মিনার।” ম্যা..ম্যা.. ম্যাডাম, আমি পড়তে জানিনে! ক্ষমা করবেন
ম্যাডাম- খারাপ কোন কিছু করিনিতো? আমার ভয় হচ্ছে খুব। খারাপ কোন কিছু করলে আর একবার
সুযোগ দিন। আমি শুধরে নেবা। আমি আপনার কাছে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞ একারণে যে আপনি আমার
মেয়েকে বিনা বেতনে দেশের সবচেয়ে ভাল ইন্টান্যাশনাল স্কুলে পড়বার সুযোগ করে দিয়েছেন-এ
ঋন আমি সারা জীবনে শোধ করতে পারবো না। আপনি আমার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ
করতে চলেছেন। বলতে বলতে মিনার কাঁপতে থাকে। এবার ম্যাডাম বল্লেন, মিনার তুমি চুপ করো।
অনেক বলেছো। এবার শোন। তোমার মেয়েকে আমি আমাদের স্কুলে পড়বার সুযোগ করে দিয়েছি এ কারণে
যে সে খুবই মেধাবী আর তুমিও বাপু খুবই দক্ষ একজন মালী, কাজে খুবই আন্তরিক, সন্দেহ নেই।
তুমি থাকো এখানেই। আমি একজন শিক্ষিকা ডাকছি সে তোমাকে তোমার ভাষায় ইংরেজী লেখাটা পড়ে
শোনাবে, বুঝেছে? জি, ম্যাডাম। কথা শেষ না হতেই আরেক শিক্ষিকা প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের
কামরায় ঢুকলেন। ইংরেজীতে এই লেখাটি লিখেছে তোমার মেয়ে। মনযোগ দিয়ে বাংলা কথাগুলো শোন
মিনার।
“আজ তোমাদেরকে (মা দিবস)
নিয়ে একটি রচনা লিখতে বলা হয়েছিল।”
“আমার জন্ম বগুড়ার একটি
ছোট্ট গাঁয়ে। সেই গাঁয়ে চিকিতসার কোন সুযোগ তো ছিলই না, স্কুলে গিয়ে ছেলে মেয়েরা পড়া
লেখা করবে সেটা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। মায়েরা ফি বছর সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছে।
এরকম ছিল আমার অভাগী মা। সে ও আমাকে জন্ম দিয়ে তার কোলে নেয়ার আগেই দুনিয়া থেকে বিদায়
নিয়েছে! আমার বাবাই হলো প্রথম ও একমাত্র মানুষ যে কিনা আমাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে
আর সেই হলো একসাথে আমার মা ও বাবা । আমি দুনিয়াতে এলাম। আত্মীয়-স্বজনরা কি আমাকে ঘিরে
আনন্দ করবে তা না করে বলা শুরু করলো আমি নাকি অপয়া, আমি নিজ মা’কে খেয়েছি। আত্মীয়-স্বজনরা
আমার বাবাকে আরেকটা বিয়ে করার জন্য পিড়াপিড়ি করতো। আমার বাবা ছিলেন নির্বিকার। উনি
বিয়ের ব্যাপারে টু শব্দটি করতেন না। আমার দাদা দাদীরা আমার বাবাকে অনেক খারাপ উপদেশ
দিতো। কিন্তু বাবা ও সব কথা কানেই তুলতো না। আসলে আমার দাদা দাদীরা নাতনীর বদলে নাতী
চায়। এটাই তাদের খায়েশ। তারা বাবাকে বলতো আরেকটা বিয়ে না করলে তারা আমার বাবাকে ভু-সম্পত্তির
কোন ভাগই দেবে না। কিন্তু আমার বাবা নারাজ। সে আবার বিয়ে করবেই না। একদিন সে আমাকে
কোলে নিয়ে জমি জমা, গরু বাছুর ছাগল, আরামের বাড়ী সব রেখে বাড়ী থেকে বের হয়ে অজানার
উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।
বাবা আমাকে সাথে করে
নিয়ে চলে এলো আপনাদের এই বড় ঢাকা শহরে। কিন্তু শহুরে জীবন বড়ই নির্মম। বাবা আমাকে বড়
করে তোলার জন্য দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করতো। বাবা কখনোই চাইতো না যে আমার যত্নের এতটুকু
ত্রুটি হোক। বাবা আমাকে এতই ভালবাসতো যে সে তার প্লেটে রাখা রুটির শেষ টুকরোটিও আমাকে
খাইয়ে দিতো। আমার মুখে কথা ফুটলে আমি বাবাকে বলতাম, বাবা তুমি খাচ্ছোনা কেন? বাবা বলতো
আমার খেতে ভাল লাগে না। তুই খেয়েনে মা। আরো বড় হলে বুঝলাম, বাবা আসলে আমাকে বড় করার
জন্যই এইভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আর আমার বাবা আমার ভাল থাকার জন্য তার সাধ্যের
বাইরেও চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আর আপনাদের এই স্কুল- সেটা আমাকে আর আমার বাবাকে দিয়েছে ছোট্ট একটি আশ্রয়,
সুযোগ করে দিয়েছে আমার পড়া লেখার যে অবদান আমি সারা জীবনেও ভুলবো না। তাই “যদি ভালবাসা
আর যত্ন বলতে মাকে বুঝায় তাহলে আমার বাবাই আমার “মা”। আমার বাবাই এই জায়গায় ফিট-অন্য
কেউই নয়। যদি সংবেদনশীল সহানুভুতি মায়েরই হয়ে থাকে সেটাও আমার বাবাই আমাকে দিয়েছে অন্য
কেউ নয়।
যদি উতসর্গ বলতে আমরা মা’কে বুঝি তাহলে এখানেও আমার বাবাই রয়েছে, অন্য কেউ
নয়। তাই আমি বলি যদি মা’কে প্রেম-ভালবাসার জন্য, দয়ার জন্য, উতসর্গের জন্যই সৃষ্টি
করা হয়-তাহলে আমার বাবাই এই দুনিয়াতে আমার সেরা “মা”।
আজকের “মা” দিবসে আমি আমার বাবাকে সেরা অর্ঘ দিই সবচেয়ে ভাল “প্যারেন্ট” হিসেবে।
আমি আমার বাবা তথা এই বিদ্যালয়ের বাগানের মালীকে শ্রদ্ধার স্যালুট জানাই শতবার আর গলা
উঁচু করে বলতে চাই দেখে যাও সেই মানুষকে যার মধ্যে প্রেম, দয়া ভালবাসা আর উতসর্গ সবই
রয়েছে সেটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় বাবা।
আমি জানি, আজকের এই রচনা লেখার জন্য আমাকে কোন নম্বর না দিয়ে বরং ফেল করানো
হবে। কিন্তু আমি জানি নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়া আমার বাবার অমূল্য ভালবাসার তূলনায় এর
মূল্য খুবই সামান্য। আপনাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।”
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কামরায় তখন চলছে এক পিনপতন নীরবতা। কেবল শোনা যাচ্ছে
মিনারের কান্নার শব্দ। বাগানের মালী মিনার। বাইরের প্রখর রোদ্দুর মিনারের শরীর ঘামে
ভেজাতে না পারলেও মেয়ের রচনার ভাব আর ভাষা মিনারের বুকটাকে চোখের জলে নাইয়ে দিয়েছে।
মিনার আরো অনেকক্ষণ প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কামরায় করজোড়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামের কাছ থেকে মিনার রচনার কাজটি নিয়ে নিলো। সেটি সে বুকের
কাছে ধরে আবারো অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম এবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। মিনারকে একটা চেয়ার দিলেন বসবার
জন্য। আরো দিলেন এক গ্লাস পানি। ম্যাডামের গলায় সুমধুর সুর। যেন অপার আনন্দে উনি ভাসছেন।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ম্যাডাম বল্লেন, ‘জানো মিনার, বিশ্ব মা দিবসে আমরা তোমার মেয়েকে এই রচনা লেথার জন্য ১০এ ১০ দিয়েছি যা কেউই পায়নি। স্কুলের বহু বছরের ইতিহাসে এটি একটি অনন্য রেকর্ড। আর এত ভাল করে আজ অব্দি কেউই এমন লেখা লেখেনি।’
প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম ম্যাডাম বল্লেন, ‘জানো মিনার, বিশ্ব মা দিবসে আমরা তোমার মেয়েকে এই রচনা লেথার জন্য ১০এ ১০ দিয়েছি যা কেউই পায়নি। স্কুলের বহু বছরের ইতিহাসে এটি একটি অনন্য রেকর্ড। আর এত ভাল করে আজ অব্দি কেউই এমন লেখা লেখেনি।’
আজ তাই এই আনন্দঘন দিনে
আমাদের স্কুল কমিটি তোমার মত একজন অনন্য মানুষকে
বিশ্ব মা দিবসের অনুষ্ঠানের
প্রধান অতিথি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা জানি আমরা তোমার মত মানুষের কোনই মূল্য দিতে
পারবোনা। আর এটাও জানি যে পারফেক্ট প্যারেন্ট হতে গেলে কেবল মায়ের মত মহিলার দরকার
নেই, বাবাও পারে। তোমার হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা তোমার মেয়েকে ধন্য করেছে। ধন্য করেছে
এই স্কুলকেও যে স্কুল এমন একজন সুকণ্যাকে লালন করে চলেছে। আর গোটা স্কুল তোমার মেয়ের
বাবার মত বাবা পেয়ে আজ ধন্য। মিনার, তুমি শুধু বাগানের মালীই নও। তুমি জীবনের ফুল ফোটানোরও
মালী। তুমি না থাকলে, তুমি দৃঢ়চিত্ত না হলে অনেক মেয়ের মত তোমার মেয়েও রাস্তায় ঝরে
পড়তো! তোমাকে আজ আমার বড়ই ভাল করে দেখতে ইচ্ছে করছে মিনার। তুমি আসলেই এক মহতপ্রাণ
মানুষ। আল্লাহ যেন এই মানুষটিকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখেন অনন্য এক উদাহরণ হিসেবে।
প্রিন্সিপ্যাল ম্যডাম এবার হেসে
বল্লেন, “তাহ’লে মিনার আমাদের স্কুলে বিশ্ব মা দিবসের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হ’তে
রাজী তো?”
No comments:
Post a Comment