ইতিহাসবিদগণের
মতে ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে লুই বনার নামে এক ফরাসি যুবক বাংলায় নীল চাষের সূচনা করেন।
পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আগ্রাসী বাণিজ্যনীতি ও দেশীয় মুতসুদ্দীদের
প্ররোচনায় নীল চাষ দ্রুত প্রসার লাভ করে। জন রিভস্ ও সি.ডব্লিউ শেরিফের যৌথ
মালিকানায় ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে চুয়াডাঙ্গার সিন্দুরিয়ায় ও জেমস এইচ হিল ১৮০১
খ্রিস্টাব্দে নিশ্চিন্তপুরে নীলকুঠি প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীকোল-বোয়ালিয়ার একজন মহাজন
হরিচরণ সাহাও ক্ষুদ্রাকারে নীলকুঠি প্রতিষ্ঠা করে নীল উতপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
চুয়াডাঙ্গার ইতিহাস গবেষক রাজিব আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী- নীল
চাষের আগে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা অঞ্চল যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও জনাকীর্ণ ছিল। এ জেলার
অধিকাংশ জমি পলি সমৃদ্ধ ও উচ্চতর নদী অববাহিকায় অবস্থিত। নীল পরিবহনের সহজ নদীপথ
মাথাভাঙ্গা এই জনপদের মধ্যস্থল দিয়ে প্রবাহিত। ফলে এখানে কারবার ছিল জমজমাট।
অচিরেই এই অঞ্চলের নীলের খ্যাতি ইংল্যান্ডসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে চুয়াডাঙ্গা এলাকা
কুঠিয়াল ও নীল ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র পরিণত হয়। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে
ইউরোপীয় নীলকরেরা স্বনামে জমি-জায়গা কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার পেয়ে যায়।
জমিদারি পেয়ে প্রজার ওপর প্রভুত্বের নিরঙ্কুশ অধিকার মেলে তাদের। সামরাজ্যজ্যেবাদী
স্বার্থের খাতিরে নীলকর ও প্রশাসনের পারস্পারিক সম্পর্ক এই পর্বে এসে অতীব মধুর।
প্রশাসনের নানাপ্রকার সহায়তায় পুষ্ট হয় নীলকর। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এখানে
নীল ছাড়া অন্যকিছু আবাদ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দু-একটি গ্রাম নিয়ে এক-একটি
নীলকুঠি স্থাপিত হয়। চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে কয়েকটি গ্রাম নিয়েই যে একটি করে নীলকুঠির
স্থাপিত হয়েছিল, তার প্রমান পাওয়া যায় এ অঞ্চলের প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই কুঠির
মাঠ, কুঠির দিয়াড়, কুঠিপাড়া প্রভৃতি নামে জায়গা আছে। ততকালে বর্তমান চুয়াডাঙ্গা
জেলাকে ছয়টি কনসার্নে ভাগ করা হয়েছিল। সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নরুপ-
সিন্দুরিয়া কনসার্ন: সিন্দুরিয়া চুয়াডাঙ্গা জেলার পূর্ব সীমায়
নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। নীল চাষ ও নীল দাঙ্গার ইতিহাসে সিন্দুরিয়া নীলকুঠি
বিশেষস্থান দখল করে আছে। এই কনসার্ন চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ,পাবনা ও ২৪ পরগনা পর্যন্ত
বিস্তৃত ছিল। চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে এর অধীনস্ত কুঠিগুলি হলো- সিন্দুরিয়া, খাড়াগোদা,
জালশুকা, কোটালি, তালতলা, তিতুদহ, খেজুরা, গোবরগাড়া, সাহাপুর, বাটিকাডাঙ্গা,
আইলহাস, তিওরবিলা, বেতবাড়িয়া,সাহেবনগর, ফুলবাড়ী প্রভৃতি। সিন্দুরিয়া নীলকুঠির
প্রথম মালিক ছিলেন জেমস্ আইভান মে। তিনি এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে এখানে
নীলকুঠি স্থাপনের উদ্যোগ পরিত্যাগ করে দেশে ফিরে যান। ১৭৯৩ খ্রীস্টাব্দের তিনি
ম্যানেজার সি.ডব্লিউ. শেরিফ, সহকারী ম্যানেজার আপন ভ্রাতুস্পুত্র টমাস আইজাক মে,
রাজমিস্ত্রি ও মজুরদের সঙ্গে করে কুঠি স্থাপনের জন্য সিন্দুরিয়া ও মর্তুজাপুর
গ্রামের মধ্যবর্তী পাঁচপীরতলায় আসেন। স্থানটিতে কুঠি স্থাপনে গ্রামবাসী আপত্তি
তোলেন কারণ এখানে ইসলাম প্রচারক হজরত দেওয়ান শাহ, কুতুব উদ্দীন শাহ্ ও তার সঙ্গী
নেয়ামত শাহের অবতরনস্থল এবং শেষোক্ত দু’জনের সমাধি-ভূমি। কুঠিয়াল ও হিন্দু
কর্মচারীরা আপত্তি অগ্রাহ্য করলেও কাঠুরিয়া কালিচরণ সর্দার বেঁকে বসেন। সাহেবদের
আদেশ অমান্য করতে দেখে ভ্রাতুষ্পুত্র টমাস আইজাক মে নিজেই কঠার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুহূর্তেই দেখা গেল, আইজাকের কুঠারাঘাত শেওড়াগাছে না লেগে তার বামতল পেট ভেদ করে
চলে গেছে। এতেই কলিকাতা নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার ৩ বছর পর জন রিভস্ মে
নামের এক সাহেব উক্ত স্থান বাদ দিয়ে এখানে কুঠি স্থাপন শুরু করেন কিন্তু সারাদিন
যা নির্মাণ রাতের বেলা নিকটস্থ নবগঙ্গা নদীতে নিক্ষিপ্ত হতো। বাধ্য হয়ে অন্যত্র
স্থানান্তর করা হয়। এই কনসার্নের অধীনে ১৬ হাজার ৬৫২ বিঘা জমিতে বছরে ৯৯৭ মন নীল উতপন্ন
হতো। চাষী ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ৩৬৮ জন।
নিশ্চিন্তপুর
কনসার্ন: ফ্রেডারিক অ্যাসকল নামে এক বণিক সর্বপ্রথম এখানে বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপন
করেন। অ্যাসকল কাসিমবাজার নবাব স্টেটের কাছ থেকে পত্তনি বন্দোবস্ত সূত্রে এ
সম্পত্তি লাভ করেন। এছাড়া অন্যান্য সম্পত্তি একেবারে নিম্নপর্যায়ে খাজনা ধার্যে
এবং রায়তি জোত ও ইজারা মারফত পান। এই কনসার্নের অধীনে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া,
রানাঘাট প্রভৃতি এলাকার ২৪৭ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই কনসার্নের ১৩ হাজার
২শত বিঘা জমিতে ৯ শত মন নীল উৎপন্ন হতো। এখানে চাষী ও কর্মচারীর
সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার।
লোকনাথপুর কনসার্ন: এই কনসার্ন নিশ্চিন্তপুর হিলস্ পরিবারের
সম্পত্তি ছিল। এর অধিকাংশ কুঠি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে অবস্থিত। চুয়াডাঙ্গা
অঞ্চলে এর কুঠি ছিল লোকনাথপুর, জয়রামপুর,
মেমনগর ও পীতাম্বরপুর কনসার্ন: এই কনসার্নের ১০ হাজার বিঘার
জমিতে ৬ শত মন নীল উৎপন্ন হতো। নীল চাষী ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৮৪ হাজার ৩৮ জন।
চন্ডীপুর কনসার্ন: চন্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায় এই
কনসার্নের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক। চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে এর অধীনস্ত কুঠিগুলি হলো- চন্ডীপুর,
ঝিলখালি, নাগদহ, সরিষাবাড়ী ও ফুলবাড়ী। চন্ডীপুর ছাড়া অন্যগুলো ছিল মূলত নীলগাছ উতপাদক
খামার। এই কনসার্নের সাড়ে ৬ হাজার বিঘা জমিতে প্রায় ৩৮৩ মন নীল উতপন্ন হতো।
খাল-বোয়ালিয়া কনসার্ন: পশ্চিবাংলার কৃষ্ণগঞ্জ থানায় চুর্ণী নদীর তীরে এই কনসার্নের
দপ্তর ছিল। এই কনসার্নের আওতায় মোট ১৪টি কুঠি ছিল। চুয়াডাঙ্গার ভিতরে এর কুঠি
ছিল-শিয়ামারী, কুঠিপাড়া, শ্যামপুর, দীননাথপুর, হাসাদহ, রায়পুর ইত্যাদি। এই
কনসার্নে ১২ হাজার ১৪০ বিঘা জমিতে ৫৬৭ মন নীল উতপন্ন হতো। নীল চাষী ও কর্মচারীর
সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬ শত জন।
কাঁচিকাটা কনসার্ন: ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এখানে একটি
বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে নীল চাষ শুরু করে। ডাচ্ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এটা ছিল
দ্বিতীয় বৃহত্তম কুঠি। এই কনসার্নের অধীনস্থ কুঠিগুলো হলো- রতনপুর, আলোকদিয়া,
কানাইনগর, খাদিমপুর, আসমানখালী, ঘোষবিলা, বাঁশবাড়িয়া, ভাঙবাড়িয়া, বোয়ালিয়া ও
শ্রীপুর। এই কনসার্নের চাষী ও কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৩৭ জন।
সর্বমোট ১৫ হাজার ২০৯ বিঘা জমিতে ৭২৩ মন নীল উতপন্ন হতো।
জোড়াদহ কনসার্ন: সিন্দুরিয়া কনসার্নের একই মালিকের মালিকানায়
আরো একটি উল্লেখযোগ্য কনসার্ন জোড়াদহ। মূল কুঠি ঝিনাইদহ অঞ্চলে অবস্থিত হলেও এর
অধীনস্থ অধিকাংশ কুঠি চুয়াডাঙ্গা এলাকায় ছিল। চুয়াডাঙ্গার নীলবিদ্রোহের সঙ্গে এই
কুঠির নীলচাষীদের বিদ্রোহ একীভূত ছিল। এই কনসার্নের আটটি কুঠির মধ্যে ঘোলদাড়ি কুঠি
বিদ্রোহ সংঘটনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ঘোলদাড়ি কুঠির ম্যানেজার ব্রুমফিল্ড
অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। আটটি কুঠির অধীনস্থ ৯ হাজার ৪৫৮
বিঘা জমিতে ৬১২ মন নীল উতপন্ন হতো।
রেফাঃ সংগ্রাম ০৯ এপ্রিল ২০১৮
No comments:
Post a Comment