জান্নাতে প্রবেশের নিশ্চিত চাবি কোনটি?
আমরা কি কখনো গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখছি, কার্যত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একদম ভুল ব্যাখ্যা সাধারণ জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। প্রচলিত ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, পাঁচটি কাজ বা দায়িত্ব পালনের নাম ইসলাম। আসলে হাদিসে উপমাটি দিয়ে ইসলামকে একটি বাড়ির সাথে তুলনা করে ধারণা দেয়া হয়েছে : স্তম্ভ ছাড়া যেমন কোনো বাড়ির কল্পনাও সম্ভব নয়, তেমনি ইসলাম পাঁচ (ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত) স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
প্রশ্ন আসে : শুধু স্তম্ভ থাকলেই কি বাড়ির অস্তিত্ব বাস্তবে কখনো কল্পনা করা সম্ভব? বাড়ির পরিপূর্ণতার জন্য দরকার ছাদ, দেয়াল, জানালা-দরজা, আসবাবপত্র, রান্নাঘর, শোবার ঘর আরো কত কী? এ সব কিছু মিলেই না হয় একটা বাড়ি! তবে সব কিছুর আগে দরকার স্তম্ভ, যার ওপর গড়ে উঠবে বাড়িটি। ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত সামগ্রিক ইসলামের বুনিয়াদ বা ভিত। কুরআনে একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যেখানে বলা হয়েছে, এই পাঁচটি কাজের মাধ্যমে জান্নাত পাওয়া যাবে?
কুরআন পাকে জান্নাতে যাওয়ার শর্ত হিসেবে যত আয়াত দেখা যায়, সেগুলোতে বলা হয়েছে মূলত দুটি গুণের অধিকারী হতেই হবে জান্নাতের জন্য। না হলে জান্নাত কারো কপালে কখনো জুটবেই না। জান্নাত লাভের জন্য তাকে অবশ্যই ঈমানের সাথে সাথে সতকর্মশীল হতেই হবে। মূলত নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সতকর্মশীল হিসেবে তৈরি করা। জান্নাত লাভের শর্ত হিসেবে বিশ্বাসের সাথে সর্বত্র সতকর্মের কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে। জান্নাত লাভের সব আয়াতেই বিশ্বাসের সাথে সতকর্মশীল হওয়াটা একান্ত আবশ্যকীয় ধরা হয়েছে। এটা ছাড়া কোনো অবস্থাতেই আর কোনোভাবে ফাঁকি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ রাখা হয়নি।
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বা বিষয় হচ্ছে সতকর্মশীল ব্যক্তিকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এবং কাজে সত হতে হবে। সতকর্মশীলতার প্রতিযোগিতা সারাজীবন করে যেতে হবে। দিনের আংশিক কিছু সময় সত থেকে অন্য সময় অসত থাকলে সতকর্মশীল হিসেবে পরিচয় দেয়ার সুযোগ নেই। দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই সত হতে হবে। সতকর্মশীল মানুষ সারাজীবন সতকর্মের ওপর অবিচল থাকবে। শেষ বিচারের দিন সব ফাঁস হয়ে পড়বে।
মসজিদের দেশ যার প্রতিটি জায়গায় আজানের ধ্বনি শোনা যায়, সে দেশ যদি কখনো দুর্নীতিতে বিশ্ব শিরোপা লাভের সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে, তার অর্থ দাঁড়ায় বিশ্বের সব দেশ থেকে বেশি অসতকর্মশীল মানুষ এ দেশে। অবাক কাণ্ড : মসজিদের দেশ কী করে দুর্নীতিবাজদের ঘাঁটি হয়? জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে সতকর্ম। আর সব গুণ থাকলেও অসতকর্মশীল ব্যক্তি জান্নাতের সীমানার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারবে না। নামাজি, দ্বীনদার হওয়ার মূল কথা হচ্ছে সতকর্মশীল হওয়া। বাহ্যিকভাবে যত বড় বুজুর্গ, পীর, মস্তবড় দ্বীনদার হোক না কেন একমাত্র ঈমানদার ও সতকর্মশীলরাই জান্নাতে জায়গা পাবে।
জান্নাতে যাওয়ার শর্ত হচ্ছে সারাজীবন সতকর্মশীল হতে হবে। কারণ প্রতিটি কাজের, মুহূর্তের এবং নিয়তের ওপরই নির্ভর করবে সে কোন ধরনের সতকর্মশীল। সুবিধাবাদী সতকর্মশীল না মন-মানসিকতা আর কাজে ও কর্মে প্রকৃত অর্থে জীবনের সব সময়ে ও ততপরতায় সার্বক্ষণিকভাবে সতকর্মশীল : শেষ বিচার দিবসে এ সবই পরখ করে দেখা হবে।
অসত ব্যক্তির ইবাদত মূল্যহীন আর জান্নাত লাভের জন্য ঈমানের সাথে সতকাজ করার দৃঢ় মানসিকতা অবশ্য থাকতেই হবে যেটা কুরআন পাকে বিভিন্ন আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। প্রশ্ন আসে বিশ্বের অন্যান্য জাতির চেয়ে মুসলমানরা কী করে ক্ষেত্র বিশেষে অধিকতর অসত ও দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারে? এর একটি সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে : সাধারণ মুসলমানরা কুরআন আবৃত্তি করে কিন্তু বুঝে পড়ার সংস্কৃতি সমাজে গড়ে ওঠেনি। ইমাম হাসান আল বসরী (৬৪২-৭২৮ খ্রি:) বলেন : ‘কুরআনকে নাজিল করা হয়েছে এর নির্দেশনাবলির ভিত্তিতে কাজ করার জন্য কিন্তু তা না করে তারা এর আবৃত্তিকে কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছে।’ দুনিয়ার বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তুলনামূলকভাবে পশ্চিমা বিশ্বের লোকদের মুসলিম সমাজের চেয়ে অধিক সামাজিক এবং সতকর্মশীল হিসেবে মনে করা হয়ে থাকে।
যারা ইউরোপ, আমেরিকা গিয়েছেন বা থাকেন, তাদের ধারণাও নিঃসন্দেহে এমনটিই হয়ে থাকার কথা। প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক, আমাদের চলমান ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতি কেন আমাদেরও সেভাবে তৈরি করতে আপাত ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছে, কোনোভাবেই কেন যেন পাশ্চাত্যের সাথে প্রতিযোগিতায় পারছি না। গভীর বিশ্লেষণে দেখা যাবে মূল কারণ কিন্তু অতি সূক্ষ্ম এক স্থানে : বেহেশত লাভের ত্রুটিপূর্ণ গতানুগতিক ভুল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শিক্ষা, প্রথা ও নির্দেশনা।
ফলে প্রচলিত সংস্কৃতির ঘূর্ণিপাকে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে সমাজের সবাই। অসত কর্মশীল হয়ে জান্নাত লাভের কোনো রকম সুযোগ ইসলামে না থাকার পরেও কেন যেন এক শ্রেণীর মুসলিমদের ভেতরে চলে আসছে দাড়ি, টুপি, নামাজি, হাজি সেজে অঘোষিত এই দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় নামতে। জীবনে একবার হজ করলেই যেন কেল্লাহ ফতেহ। আসমান উঁচু পরিমাণ নেকি অর্জন করেও সঠিক কথা হচ্ছে, সারা জীবন যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে নিজের অর্জিত মূলধন নেকি দিয়ে তাদের সাথে বিনিময় করতে হবে। আর এভাবে পরিশোধ করতে করতে আগেই নেকি সব শেষ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে প্রাপকের গুনাহ নিজের কাঁধে নিয়ে দোজখে যেতে হবে। প্রথমে দেখা যাক কুরআনের আলোকে সতকাজের ব্যাখ্যা।
পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারা আয়াত ১৭৭ তে বলা হয়েছে : ‘সতকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিম দিকে মুখ করবে, বরং বড় সতকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর, কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সব নবী-রসূলের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, এতিম-মিসকিন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্য। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য ধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেজগার।’
এখন আমরা স্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য বিশ্লেষণ করতে পারি, আমাদের কি বার্তা পরিবেশন করছে জান্নাত লাভের আয়াতসমূহ? সব আয়াতেই কিন্তু পরিষ্কারভাবে নির্দেশনা রয়েছে : ঈমানদার সতকর্মশীলদের জন্যই শুধু জান্নাত। ঈমানের সাথে সতকর্মশীল না হলে আর সব গুণ থাকলেও কিন্তু কারো কপালে কস্মিনকালেও জান্নাত জুটবে না।
-অন্যএকদিগন্ত
No comments:
Post a Comment