সাহাবিদের সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর আচরণ
মহান আল্লাহ রাসুল (সা.)-এর মধ্যে আমাদের জন্য রেখেছেন উত্তম আদর্শ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুকরণ করতে পারবে, আল্লাহ ও রাসুলের আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে পারবে, তারাই সফলকাম হবে।
মহানবী (সা.) যেমন একজন শ্রেষ্ঠ নবী ছিলেন, তেমনি তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। তাই যারা নেতৃত্বের গুণ অর্জন করতে চায়, তাদের জন্যও মহানবীর জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তিনি দেখিয়ে গেছেন নেতৃত্বের বলে অন্যের ওপর অহেতুক অত্যাচারের খড়্গ না চালিয়েও ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী নেতা হওয়া যায়।
সাহাবায়ে কেরামের প্রতি রাসুল (সা.) অত্যন্ত সদয় ছিলেন। তাঁর নম্র আচরণে মুগ্ধ হয়েই অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। দুই জাহানের বাদশা হয়েও তিনি এতটাই সাধাসিধে জীবন যাপন করতেন যে যে কেউ খুব সহজে তাঁর কাছে যেতে পারত। তিনি সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আউফা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) জিকির অত্যধিক পরিমাণে করতেন এবং অনর্থক কাজ একেবারেই করতেন না; আর নামাজ দীর্ঘ করতেন ও খুতবা সংক্ষেপ করতেন। তিনি বিধবা ও গরিবদের সঙ্গে চলা-ফেরায় সংকোচ বোধ করতেন না; যাতে তিনি তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন। (নাসায়ি, হাদিস : ১৪১৪)
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে কোনো দিন আমাকে বাধা প্রদান করেননি এবং যখনই আমাকে দেখেছেন, মুচকি হাসি দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ৩৮২২)
তাঁর সঙ্গে কেউ কথা বলতে গেলে তিনি তাঁকে খুব গুরুত্ব দিতেন। পারস্পরিক আলোচনার সময় অন্যের কথা মনোযোগসহ শুনতেন। অপরজন চেহারা না ফেরানো পর্যন্ত তিনি তার দিক থেকে চেহারা ফেরাতেন না। আর কেউ তাকে কানে কানে কিছু বলতে চাইলে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি মাথা সরাতেন না। (সহিহুল জামে : ৪৭৮০)
অথচ আমরা কারো সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের দৃঢ় ব্যক্তিত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে তার সঙ্গে এমন আচরণ করে বসি যে অনেক ক্ষেত্রে আগন্তুকের জন্য তা অপমানের পর্যায়ে চলে যায়। ইসলাম এ ধরনের কাজকে পছন্দ করে না।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা ছিলেন রাসুল (সা.)। তাঁর উপমা তিনি নিজেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেতা হয়েও তিনি তাঁর সঙ্গীদের ছোটখাটো কাজেও আত্মনিয়োগ করতে সংকোচ করতেন না। বারাআ (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) খন্দক যুদ্ধের দিন মাটি বহন করেছিলেন। এমনকি মাটি তাঁর পেট ঢেকে ফেলেছিল অথবা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) তাঁর পেট ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। (বুখারি, হাদিস : ৪১০৪)
আবার মুসলিম সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে তিনি কখনো কখনো কঠোরও হয়েছেন। মুসলিম বাজারে মানসম্মত খাবার বিক্রয় হচ্ছে কি না তা নজরদারি করতে তিনি নিজেই বাজারে গিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) খাদ্য শস্যের একটি স্তূপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি স্তূপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন ফলে হাতের আঙুলগুলো ভিজে গেল। তিনি বলেন, হে স্তূপের মালিক, এ কী ব্যাপার? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসুল, এতে বৃষ্টির পানি লেগেছে। তিনি বলেন, সেগুলো তুমি স্তূপের ওপরে রাখলে না কেন? তাহলে লোকেরা দেখে নিতে পারত। জেনে রাখো, যে ব্যক্তি ধোঁকাবাজি করে, আমার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। (মুসলিম, হাদিস : ১৮৫)
আনাস ইবনে মালেক (রা.) রাসুল (সা.)-এর গৃহকর্মী ছিলেন। তিনি কারি, মুফতি ও মুহাদ্দিস সাহাবি ছিলেন। হিজরতের ১০ বছর আগে মদিনাতে তাঁর জন্ম। তাঁর বয়স যখন ৮-৯ বছর তখন তাঁর মা ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রী ও পুত্রকে ছেড়ে সিরিয়া চলে যান এবং সেখানেই কুফরি অবস্থায় মারা যান। স্বামীর ইন্তেকালের পর পুত্র আনাসের লালন-পালনের কথা ভেবে উম্মে সুলাইম কিছুকাল অন্যত্র বিবাহ বসেননি। পরবর্তী সময়ে সাহাবি আবু তালহা আনসারি (রা.)-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
রাসুল (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখনই আনাস (রা.) রাসুল (সা.)-এর সাক্ষাত করে সাহাবিয়্যাতের মর্যাদা লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স ১০ বছর। কিছুদিন পর তাঁর মা তাঁকে হাতে নিয়ে উপস্থিত হলেন রাসুল (সা.)-এর দরবারে। বলেন, আনসারদের নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই আপনাকে কিছু না কিছু হাদিয়া দিয়েছে; আমি তো কিছু দিতে পারিনি। আমার আছে এই ছেলে। সে লিখতে জানে। আপনার খেদমতের জন্য একে কবুল করে নিন। সেদিন থেকে আনাস (রা.) রাসুল (সা.)-এর খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন এবং রাসুল (সা.)-এর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একটানা ১০ বছর খেদমত আঞ্জাম দেন। (আনসাবুল আশরাফ ১/৫০৬; উসদুল গাবাহ ১/১৫২)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ১০ বছর ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেবা-যত্ন করেছি। তিনি আমার প্রতি কখনো ‘উহ্’ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি (অসন্তোষ প্রকাশ করেননি)। তিনি আমার কোনো কাজে কখনো অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেননি যে এটা তুমি করলে কেন অথবা কোনো কাজ ছুটে যাওয়ার কারণেও তিনি বলেননি যে এটা তুমি কেন করলে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সবচেয়ে উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ। আমি রেশম এবং পশম মিশিয়ে বানানো কাপড়ও নিজ হাতে ছুয়ে দেখেছি এবং খাঁটি রেশমি কাপড়ও ছুয়েছি; কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাতের চেয়ে বেশি নরম ও মসৃণ কোনো কিছু স্পর্শ করিনি। আমি মৃগনাভির গন্ধও গ্রহণ করেছি এবং আতরের গন্ধও গ্রহণ করেছি; কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শরীরের ঘামের চেয়ে বেশি সুগন্ধি কোনো কিছুতে পাইনি। (তিরমিজি, হাদিস : ২০১৫)
No comments:
Post a Comment