Saturday, February 5, 2022

ভয়কে জয়

 গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মানুষের প্রথম গুণ হচ্ছে উদ্দীপনা বা উত্সাহ, যা তাকে সবকিছু সম্ভব করে তোলার প্রেরণা জোগায়। এ দার্শনিকের কথার সূত্র ধরেই স্নায়ুবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, মনের ভয়কে জয় করার জন্যও চাই উদ্দীপনা। মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ উত্সাহে সাড়া দেয়। আর এ সাড়াই পারে মনের ভয়গুলোকে তাড়িয়ে দিতে। নিচের ছয়টি পদ্ধতি অবলম্বন এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়—

নড়বড়ে ভাবনাটাকে বিদায় দিন: জীবনটা খুব নড়বড়ে হয়ে আছে, চাকরির ভয়, রাস্তার ভয়, ছিনতাইয়ের ভয়— এমন শতচিন্তা ভয়কে আরো গাঢ় করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের হটসন গ্র্যাজুয়েট স্কুলের শিক্ষক ব্রেনে ব্রাউন এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে বলেছেন। মনটাকে এসব চিন্তা থেকে ছুটি দেয়াই ভয়কে জয় করার প্রাথমিক পদক্ষেপ। মনে সাহস ও বেঁচে থাকার শক্তি সঞ্চয় করতে পারলে অনেক ভয়কেই তাড়ানো যায়। তাছাড়া যৌক্তিকভাবে কোনো কিছুকে বিচার করতে না পারলে ভয়ের জয়ই হয়।
কিসের এত ভয়: পিপারডেইন বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট ২০১০ সালে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল নিজের ভয়টা কোথায় অথবা কিসের, তা পরিষ্কারভাবে খুঁজে বের করতে। কেউ হয়তো ভয় পায় উঁচু ছাদে উঠলে, কেউ পানিকে, কেউ অন্ধকারকে। কিন্তু কে কোনটা, তা পরিষ্কারভাবে জানতে পারলে অজানা আশঙ্কা থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। ভয়ের কারণ জানা থাকলে তার পরিণতি ও তা থেকে দূরে থাকার মধ্য দিয়েও আতঙ্ক থেকে রেহাই মেলে।
অন্যকেও জানতে দিতে হবে: মনোবিজ্ঞানী নোয়াম স্পেন্সার জানিয়েছেন, অন্যকেও জানতে দিতে হবে ভয়ের কথা। কিসে ভয়, কেন ভয়, তা অন্যকে জানানোর মধ্য দিয়ে নিজের মনেও সাহস ও ভরসা ফিরে আসে। অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপের ফলে ভয়ের ধরন, এর বাস্তবতা অথবা করণীয় বিষয়ে জানা যায়। এতে নিজের মনেও ভয়ের বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়া যায়। আবার অমূলক ভয়কেও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
ইতিবাচক মন: মার্ক টেইলর নামে যুক্তরাষ্ট্রের এক মনোবিজ্ঞানী কাজ করেছেন অ্যাথলিটদের ওপর। এমন দুরন্ত গতিতে দৌড়ে চলা, এত ওপর থেকে ঝাঁপ দেয়া— সব কাজই তারা অবলীলায় কীভাবে করে। এর উত্তরে তিনি জেনেছেন, ইতিবাচক মন থাকার কারণেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তারা জেনেছেন, তাদের লক্ষ্য কী, তারা কীভাবে সেটা অর্জন করতে সক্ষম এবং তাদের বিপদগুলো সম্পর্কেও ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ভয় নিয়েই তাদের ব্যস্ত থাকতে হয়নি। ব্যক্তিজীবনেও এসব কথাই সত্য। আশপাশকে ভালোভাবে জানতে পারলে ভয় এড়ানো সহজ হয়। নিজেকে ইতিবাচক কোনো উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালনা করলে ভয় হারিয়ে যাবে।
ক্লান্তি দূর: ক্লান্তিকে শরীর ও মনে বাস করতে দেয়া যাবে না। ক্লান্ত মন ভয়ের নিরাপদ আবাস। ক্লান্ত শরীর ভীত থাকে এমনিতেই। সুতরাং ক্লেদ, বিরক্তি এসবকে জয় করতে হবে। তার জন্য হয়তো ব্যায়াম করতে হবে, ধ্যান ও নিয়মিত ভালো ভালো খাবারের মধ্য দিয়েও সম্ভব ক্লান্তি দূর করা। ক্লান্তিকে এড়িয়ে চললে ভয়কেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
ঝুঁকি নিন: এমন কোনো কাজ যার প্রতি ভয় জাগে, তার কাছাকাছি এলে মনে সাহস বাড়বে। যেমন পানি বা উঁচু ছাদ। অথবা পাহাড় বাওয়ার কাজ করলেও ভয় যাবে দূরে সরে। অন্ধকার কোনো ঘরে মনে সাহস নিয়ে চুপি চুপি বসে থাকুন অনেক্ষণ, ধীরে ধীরে ভয় কেটে যাবে মন থেকে। মার্কিন মনোবিজ্ঞানী বে ডেন দিয়েছেন এ পরামর্শ। ভয়ের চেহারাটা একবার দেখে আসতে পারলে কিন্তু তার জন্য আর পিছুটান কাজ করবে না। ভয় আর পেছন থেকে টেনে ধরে রাখতে পারবে না।
ভয় পাওয়ার বিষয়টি মনোচিকিতসকরা ব্যাখ্যা করেন মানসিক বিষয় হিসেবে। অনেকে আছেন, যাঁরা একা ঘরে ঘুমাতে ভয় পান, ভূতের সিনেমা দেখে ভয় পান কিংবা রাতে ওয়াশরুমে যেতে ভয় পান। এই আতঙ্কের প্রধান কারণ হলো, আপনি মনের মধ্যে ভয়কে পুষে রেখেছেন, যা আপনিই দূর করতে পারেন। আর হ্যাঁ, এর জন্য মানসিক ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
মনের ছোট ছোট ভয় বা আতঙ্ক দূর করতে ওয়েক আপ ক্লাউড ওয়েবসাইটে দেওয়া পরামর্শগুলো একবার দেখে নিতে পারেন।
১. প্রথমে ভালো করে লক্ষ করুন, কোন বিষয়গুলোতে আপনি ভয় পাচ্ছেন। সেখানে ভয় পাওয়ার মতো কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব আছে কি না। যে ভূতের সিনেমা দেখে আপনি ভয় পাচ্ছেন, সেটার শেষ পর্যন্ত কী ঘটে। আবার ভাবুন, আপনি সিনেমা দেখেই ভয় পাচ্ছেন আর যে নায়ক বা নায়িকা ভূতের চরিত্রে অভিনয় করল, তাদের তো ভয়ে মরেই যাওয়া উচিত, তাই না? যখনই কোনো ভূতের সিনেমা দেখবেন, তখন সেই নায়ক বা নায়িকার কোনো রোমান্টিক সিনেমার গানের কথা ভাবতে থাকুন। দেখবেন, ভয় দূর হয়ে আপনি মনে মনে হাসতে শুরু করবেন।
২. অনেক সময় কৌতূহলের কারণেও মনের ভয় দূর হয়। আপনি যদি মনের মধ্যে ভয় পুষে রাখেন, তাহলে তা কোনো দিনই দূর হবে না। যে বিষয়টাতে আপনি ভয় পাচ্ছেন, সেই বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠুন। দেখবেন, যখন পুরোটা জেনে যাবেন, তখন আর ভয় কাজ করবে না।
৩. ভয় পেলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো না কোনো কাজ করতে থাকুন। কোনোভাবেই চুপচাপ বসে থাকবেন না। কাজের মধ্যে থাকলে ভয়ের কথা আপনি একসময় ভুলে যাবেন।
৪. প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলুন। এটা আপনার ভয় কাটাতে সাহায্য করবে। ইতিবাচক কথাগুলো আপনার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয়কে দূর করবে।
৫. বই পড়ুন। প্রিয় লেখকের বই আপনার সব ধরনের বিষণ্ণতা, ভয়, আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে থ্রিলার বা গোয়েন্দা টাইপের বই পড়ুন, যা আপনার মস্তিষ্ককে অন্যদিকে ধাবিত করবে।
৬. বেশি করে খান। চট করে পছন্দের খাবারটি তৈরি করে ফেলুন। দেখবেন, এক নিমেষেই আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। আর ভয়, সেটা তো রান্না করতে করতেই ভুলে যাবেন।
৭. সাধারণ ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম করুন। দেখবেন, আপনার ক্লান্তি দূর হবে। মস্তিষ্ক সতেজ মনে হবে। দেখবেন, ভয়ের কারণে আপনার শরীরে যে ভার অনুভব করছেন, তখন সেটা অনেক হালকা মনে হবে।
৮. প্রার্থনা করুন। প্রার্থনা ধ্যান করার মতো। দেখবেন, মনের ভয় বা আতঙ্ক সহজেই দূর হয়ে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-
সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান,
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়, নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়॥
সূত্র: Bonik Barta, ntvbd.combn.wikisource.org

No comments:

Post a Comment