Analysis
of the Word “MAN”
অন্যের প্রতি দয়া করা মনুষ্যত্ববোধের প্রকাশ। আল্লাহতায়ালা
কুরআন মাজিদে মানুষ নিয়ে বেশ কয়েকটি আয়াত দিয়েছেন তার একটি হলো- ‘খালাকাল ইনসানা
মিন আলাক্ব।’ যিনি সৃষ্টি করেছেন ইনসান তথা মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। আরেক আয়াতে
তিনি বলেছেনঃ যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও
সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন। এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন
তোমাকে গঠন করেছেন৷ আল্লাহ আবারো বলেছেনঃ
আমি মানুষকে পয়দা করেছি
সর্বোত্তম কাঠামোয়। এ ইনসান কেমন হবে তার নমুনা করেছেন নবী(সা.)কে।
প্রাণি বিজ্ঞানী সি.পি হিকম্যান মানুষের সংজ্ঞা লিখতে গিয়ে
লিখেছেনঃ
A
man is a physico-chemical system with a specific and varying level of
organization pattern, self-regulative, self-perpetuating in continuous
adjustment with the environment. - C.P.
Hickmann
১. ‘আল ইনসান’ الۡاِنۡسَانِ শব্দের প্রথম হরফ ‘আলিফ’- তা দিয়ে ইমান
বুঝানো হয়েছে। ইমান যার যত বেশি মজবুত তিনি তত বড় ইনসান। জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়-
‘আল্লাতে যার পূর্ণ ইমান কোথা সে মুসলমান, কোথা সে মুসলমান।’
২. আল ইনসানের দ্বিতীয় হরফ ‘লাম’- লাম দিয়ে ‘লুতফ’ বা
অনুগ্রহ, দয়া, লিনত বা নম্রতা-ভদ্রতা
বুঝায়। যার দয়া নেই, অন্যের প্রতি অনুগ্রহ নেই, নম্রতা
নেই, ভদ্রতা নেই সে আর যাই হোক মানুষ নামের যোগ্য নয়। কোরআনের
ভাষায়- ‘উলাইকা কাল আনআমে বালহুম আদ্বাল্ল।’ তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো বরং তার
চেয়েও নিকৃষ্ট।
৩. আল ইনসানের তৃতীয় হরফ ‘আলিফ’- এর মাধ্যমে সৌহার্দ, উনসিয়ত
বা মনের টান বুঝানো হয়েছে। আজকের সমাজে মনের টান,
সৌহার্দ প্রায় অনুপস্থিত।
৪. আল ইনসানের চতুর্থ হরফ ‘নুন’। এ নুন দিয়ে নিয়াবত বা
প্রতিনিধিত্ব বুঝায়। মানুষ আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি। তার চরিত্র হবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থ, পররাষ্ট্রনীতিসহ
জীবনের সব ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। ‘তাখাল্লাকু বি আখলাকিল্লাহ’ তথা
আল্লাহর চরিত্রে চরিত্রবান হও। ‘সিবগাতাল্লাহ’ বা আল্লাহর রঙে রঙিন হওয়ার অর্থ হল
আল্লাহ রহমান, রহিম- পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু। করুণা ও দয়ার
প্রতিবিম্ব হবে মানুষ। যার জীবনচরিত দেখে মানুষ তাকে বলবে আল্লাহওয়ালা। যার আছে
দয়া, মায়া, মানবপ্রেম, সৃষ্টিপ্রেম।
যে চরম শত্রুকেও আপন করে নিতে পারে। যার নমুনা ছিলেন প্রিয় নবীজি (সা.)। এক চরম
শত্রু ইহুদি সিদ্ধান্ত নিল নবী মুহাম্মাদ (সা.)কে হত্যা করতে হবে। রাতের বেলায় সে
প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মেহমান হল। বারবার চেষ্টা করেও তার মিশন সফল করতে পারেনি।
ধারালো চাকু নিয়ে এসেছিল প্রিয় নবীজিকে আঘাত করতে। যার পাহারার দায়িত্ব আল্লাহ
নিয়েছেন তাকে আঘাত করার সাধ্য কার? ইহুদি প্রিয় নবীজি
(সা.)-এর মেহমানদারি, আপ্যায়ন গ্রহণ করার পর
তাকে ভালো বিছানায় শোয়ার ব্যবস্থা করলেন। শত্রুকে আঘাত করতে না পেরে রাগে-ক্ষোভে
শেষ রাতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিছানায় পেশাব-পায়খানা করে অন্ধকার থাকতেই পালিয়ে যায়।
যাওয়ার সময় ভুলে তার চাকুটি ফেলে যায়। কিছু সময় পর সে চাকু নিতে ফিরে এসে দেখে
প্রিয় নবী (সা.) ময়লা সাফ করে বিছানার চাদর ধুয়ে দিচ্ছেন। দূর থেকে ইহুদি এ ঘটনা
দেখে কেঁপে উঠলেন। একটু কাছে যেতে প্রিয় নবীজি (সা.) তার সামনে এসে বললেন, ‘ভাই! রাতে আপনার খুব কষ্ট হয়েছে। আমি আপনার সেবা করতে পারিনি এ জন্য
ক্ষমাপ্রার্থী।’ মানুষের প্রতি এ দয়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা, মেহমানদারির
নজির কি কোথাও আছে? জানের দুশমন মুহূর্তে
পরিণত হল অন্তরঙ্গ বন্ধুতে। পড়ে নিল কালেমা।
৫. আল ইনসানের পঞ্চম হরফ ‘সিন’। এর অর্থ সায়াদাত বা
সৌভাগ্যবান হওয়া। জীবনের চাওয়া-পাওয়া সব পেয়ে মানুষ যখন সৃষ্টিপ্রেমে বিভোর হয়ে
আল্লাহপ্রেমের সদর দরজায় পৌঁছে যায় তখনই সে হয় সৌভাগ্যবান। যার রূপরেখা দিতে গিয়ে
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) লিখেছেন, ‘কিমিয়ায়ে সায়াদাত’ বা
সৌভাগ্যের পরশমণি। আল্লামা ইকবাল (রহ.) তাই তো বলেছেন, ‘খুদি কো কর এতনা বুলন্দ তাকদির সে পহেলে- কে খোদা পুসে তুজেহ বাতা তেরি রেজা
কেয়া হ্যায়।’ আত্মমর্যাদাকে এত উঁচুতে নিয়ে যাও তাকদিরের গণ্ডিরও ওপরে। খোদা যেন
জিজ্ঞেস করে, বান্দা বলো কী পেলে তুমি সন্তুষ্ট হবে। আজকের মানুষ পার্থিব মোহে,
রিপুর তাড়নায় চরম
দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্য মনে করছে। কিছুদিন ক্ষমতার দাপট, বিত্ত-বৈভবের
অহঙ্কারে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। কিছুদিন পর দেহ বেলুনের বাতাস বের হয়ে গেলে লাশ
হচ্ছে। লোভ-লালসা নয়, পার্থিব সম্পদ নয়- সৌভাগ্যের
অধিকারী হতে হলে সম্পর্ক করতে হবে সৌভাগ্যের চাবিকাঠি যার হাতে, তিনি
আর কেউ নন, তিনি আমার-আপনার প্রেমময় খোদা। মাওলানা রুমি (রহ.) তাই তো
বলেছেন, হারকে খাহাদ যিস্তান বা আবরু-যিকরে উ কুন যিকরে উ কুন যিকরে
উ। যে চাইবে সম্মানের জীবন লাভ করে অমর হতে, তাঁর জিকির কর, তাঁর
জিকির কর অমরত্ব মিলবে তাতে।
৬. আল ইনসানের ষষ্ঠ হরফ ‘আলিফ’- এর মাধ্যমে উনসিয়্যাত বা
মনের টান সৃষ্টি করা, উখুয়্যাত বা ভ্রাতৃত্ববোধ
জাগিয়ে তোলা। এক সৃষ্টির প্রতি অপর সৃষ্টির মনের টান বা মমত্ব যদি না থাকে, একটি
বিড়াল, একটি ক্ষুদ্র প্রাণীর প্রতি দয়া যদি না থাকে তাহলে এ
মানুষটি সুরতে মানুষ হতে পারে কিন্তু তাকে প্রকৃত মানুষ বলে না। প্রিয় নবীজি (সা.)
গোশত বা মাছ খাওয়ার পর যে হাড্ডি বা কাঁটা থাকত তা সংরক্ষণ করে বলতেন, খবরদার
এ হাড্ডিতে বা কাঁটাতে পানি ফেল না। কারণ এটি অন্য প্রাণী খাবে। যদি তাতে পানি ঢাল
তাতে তার স্বাদ কমে যাবে। অন্য প্রাণী খেয়ে তৃপ্তি পাবে না। সৃষ্টির প্রতি এ প্রেম, এ
দয়ার নীতি কোনোদিন কেউ শুনেছে বা দেখেছে? আল্লামা ইকবাল তাই তো
বলেছেন, ‘সবক পড় ফের সাদাকাত কা, আমানাত কা, সুজায়াত
কা লিয়া যায়েগা ফের তুঝসে দুনিয়া কি ইমামত কা।’ সবক পড় ফের সত্যবাদিতার, আমানত
এবং বীরত্বের; দুনিয়ার নেতৃত্ব তোমার হাতে ফের আসবে ।
৭. আল ইনসান শব্দের শেষ হরফ ‘নুন’। এর অর্থ হল নুর বা আলো।
মানুষ লাভ করবে আলোকিত জীবন। নিজ খুদী হবে আলোকিত,
সমগ্র সৃষ্টিজগতকে করবে
আলো দান। যে মানুষ নিজে আলোকিত নন, অন্য সৃষ্টি যার অস্তিত্ব, ব্যক্তিত্ব, মমত্ব
থেকে আলো নিতে পারে না সে আর যাই হোক, আলোকিত মানুষ নন। নয় সে
ইনসান। কোরআনের ভাষায়- ‘উলাইকা হুম শাররুল বারিয়্যাহ।’ তারাই সবচেয়ে নিকৃষ্ট
সৃষ্টি। এক কথায় ইনসানে কামেল বা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে হলে থাকতে হবে সুদৃঢ়, ইমান, অনুগ্রহ, দয়া, নম্রতা, ভদ্রতা, সৌহার্দ।
তখন গোটা জীবন হবে আলোকিত।
রেফাঃ আল কুরআন
অধ্যক্ষ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল
মাদ্রাসা
C.P.
Hickmann, প্রফেসর, ইন্ডিয়ানা
ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
নিজ পাঠ
No comments:
Post a Comment