প্রাণিজগতের ওপর মানুষের আধিপত্যের অনেক কারণের একটি হলো হাতিয়ার তৈরির ক্ষমতা। যেদিন মানুষ হাতিয়ার আবিষ্কার করেছে, সেদিন থেকেই সে হাতির চেয়ে শক্তিধর ও চিতার চেয়ে গতিশীল। যদিও এ শক্তি ও গতিকে কেবল নিজের বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করেনি মানুষ, করেছে শত্রুকে ঘায়েল করতেও। বস্তুত কাউকে আঘাত করা যায়, এমন যেকোনো কিছুই মানব ইতিহাসে ব্যবহূত হয়েছে অস্ত্র হিসেবে। ফলে খাবার টেবিলের উপাদেয় মরিচটারও টেবিল ছেড়ে যুদ্ধের মাঠে যাওয়ার ইতিহাস রয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
১৪৯৪ সাল। আমেরিকার স্থানীয় তাইনো জনগণের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে উপনিবেশ বিস্তারকারী দেশ স্পেন। প্রথম দিকে সাদাসিধা বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকলেও ক্রমে তা নেতিবাচক দিকে মোড় নিতে থাকে। নিজেদের অযোগ্যতায় সৃষ্টি হওয়া সংকটের সমাধানে তারা হামলে পড়ে তাইনো জনগোষ্ঠীর গুদামগুলোয়। শান্ত মানুষ হিসেবে পরিচিত তাইনো জনগণ। এমনকি কলম্বাসও তাদের সততা ও দয়ার্দ্রতার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি নিজের ডায়েরিতে। কিন্তু যুদ্ধ তো যুদ্ধই। স্প্যানিশদের ইস্পাতের তরবারির সঙ্গে টক্কর দেয়ার মতো কোনো অস্ত্র নেই তাইনোদের। তাই বলে কি দখলদারের হাতে ছেড়ে দেবে পরিস্থিতি? তারা দেখাল নতুন অস্ত্রের সন্ধান, এর আগে যার সঙ্গে পরিচিত নয় স্প্যানিশ শিবির। লাউয়ের খোলসের ভেতর ছাইয়ের সঙ্গে মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে ছড়িয়ে দেয়া হলো বাতাসে। পরিণামে যেটা প্রত্যাশিত, সেটাই ঘটেছে। মরিচের সে গুঁড়া গিয়ে লাগল স্প্যানিশ সৈন্যদের চোখ ও ঠোঁটে। কেউ অন্ধ হয়ে গেল, কেউ পড়ে থাকল নিশ্বাস বন্ধ হয়ে। হঠাৎ হতভম্ব হয়ে যাওয়া বাকি সেনাদের জন্য তখন এগিয়ে এসেছে তাইনো আক্রমণকারী। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে না পারলেও মরিচই তৈরি করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেয়াল। লাউয়ের খোলসের মধ্যে পানি ও মরিচ দিয়ে বোমা বানানোর কৌশল আদি আমেরিকার অন্যান্য সংস্কৃতিতেও দেখা যায়। সে বোমা শত্রুশিবিরে নিক্ষেপ করত অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতার যোদ্ধারা। পানির মধ্যে মরিচ সক্রিয় হয়ে উঠত। সে সক্রিয় উপাদানের মিশেলে তৈরি হওয়া বোমা নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে ঘটত বিস্ফোরণ। নির্গত হতো ক্ষতিকর গ্যাস। শত্রু শিবির সামনে এগিয়ে আসবে কী! নিশ্বাস নিতে না পেরেই কাবু হয়ে যেত মুহূর্তের মধ্যে। তবে যেখানে এভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার চর্চা ছিল না, তারাও পিছিয়ে থাকেনি। সে সংস্কৃতিতে চর্চিত হয়েছে অন্য ঐতিহ্য। মরিচ পুড়িয়ে তার ধোঁয়া প্রবাহ করে কাবু করা হয়েছে শত্রুপক্ষকে। ঔপনিবেশিক পর্তুগিজরা ব্রাজিল ও পেরুতে অভিযান চালানোর সময় এ অদ্ভুত যুদ্ধনীতির সাক্ষী হয়। বিশেষ করে পেরুতে থাকা ইনকা জনগণের মধ্যে মরিচের এ ব্যবহারে মুনশিয়ানা ছিল।
রণাঙ্গনে প্রথম কখন মরিচ নেমেছিল, লিখিত ইতিহাসে তার নিশানা নেই। ইউরোপীয়দের সঙ্গে যুদ্ধের সময় আদি আমেরিকানরা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছে মরিচ। ফলে এ কথা দাবি করলে মোটেও ভুল হবে না, ইউরোপীয়রা প্রবেশেরও বহু আগে থেকেই মরিচের সামরিক ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল স্থানীয় জনগণের মাঝে। ১৪৫০-এর দশকেই অ্যাজটেক সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ করে মূলত কুয়েত লাক্সমান শহরের কয়েকজন গোত্রপতি ও মানুষ। স্থানীয় গভর্নরকে হত্যা করে ফেলে তারা। যথারীতি খাজনার সময় সম্রাট মন্তেজুমার (১৩৯৮-১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দ) দরবার থেকে দূত আসে। চুপ করে তাদের আপ্যায়ন করলেন গোত্রপতিরা, যেন কিছুই ঘটেনি এখানে। অঘটন ঘটল রাতে। স্থানীয় গোত্রপতিরা প্রথমে একত্র হলেন। তারপর যে কক্ষগুলোয় খাজনা আদায়কারী দূতেরা ঘুমে বিভোর, সে কক্ষগুলোর বাতাস চলাচল বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। খুব সাবধানে আগুন দিলেন মরিচের স্তূপে। মরিচপোড়া ধোঁয়া প্রবেশ করল কক্ষে। ঘুমন্ত দূতেরা খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে চিরতরে। জানা ইতিহাসে প্রথম গ্যাস চেম্বারের উদাহরণ হিসেবে এ মরিচের ব্যবহারকে সামনে আনা যেতে পারে। অবশ্য ছোটখাটো শাস্তিদানের ক্ষেত্রেও মরিচ ছিল প্রশংসনীয় ওষুধ। অবাধ্য সন্তানকে শাস্তি দেয়ার জন্য মরিচের ব্যবহারের বিধান অ্যাজটেক আইন সংহিতা কোডেক্স মেন্দোজায় লিখা রয়েছে। এগারো বছর বয়সের মধ্যে অ্যাজটেক ছেলে ও মেয়েকে কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তী হতে হতো। সমসাময়িক স্প্যানিশ লেখকেরা সে চিত্র তুলে ধরেছেন নিজেদের লেখায়। সেখানে পিতা-মাতার সঙ্গে অবাধ্য আচরণ করা সন্তানকে শুকনো মরিচের ধোঁয়া দিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। পিতা তার উলঙ্গ পুত্রকে আগুনে পুড়তে থাকা মরিচের ওপর ধোঁয়ার মধ্যে ধরে রাখতেন। মরিচপোড়া ধোঁয়ায় নিশ্বাস নেয়ানোকে গণ্য করা হতো নিষ্ঠুর শাস্তি হিসেবে। ফলে এ শাস্তি কয়েক সেকেন্ডের বেশি হতো না। মেয়েদের জন্য মাত্রাটা ছিল আরো কম। বহু বছর পরেও স্থানীয় আমেরিকানদের মধ্যে জারি ছিল মরিচ ব্যবহারের এ চর্চা। উনিশ শতক পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী ধরে চলমান আমেরিকান ইন্ডিয়ান যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে নিয়মিত ব্যবহূত হয়েছে মরিচ। ১৮৮০-এর দশকে স্থানীয় অ্যাপাচি নারী ও শিশুদের উদ্ধার করার জন্য মেক্সিকোর খনিজীবীদের বিরুদ্ধে মরিচ নির্মিত বোমা ছোড়ে যোদ্ধারা। সেখানে মরিচের পাশাপাশি ব্যবহার হয়েছে জ্বলন্ত কাঠ ও পাইনের রস।
বিশ শতক থেকে মানুষ বোমা ও বারুদের ব্যবহারে অসম্ভব আধিপত্য দেখিয়েছে। কেবল তৈরির ক্ষেত্রে না, সে আধিপত্য ছড়িয়ে থেকেছে ব্যবহারের ক্ষেত্রে। খুব অল্প সময়ে কয়েকশ গুণ বেশি আতঙ্ক ছড়াতে সক্ষম এসব বোমা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব দেখেছে মানুষের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। শিল্পোন্নত দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। প্রতিযোগিতা এতটাই ভয়াবহ রূপ নিল যে পরস্পরের সঙ্গে নানা রকম যুদ্ধবিরোধী চুক্তিতে আসতে হয়েছে দেশগুলোর। তার পরও অস্ত্রের ঝনঝনানি কমেনি। অস্ত্র তৈরি করে মজুদ করা হচ্ছে যথা সময়ে ব্যবহার করার জন্য। সেখানে ভারী মারণাস্ত্রের পাশাপাশি কম মাত্রার অস্ত্রও জায়গা পেয়েছে। ভারী অস্ত্রগুলো যুদ্ধের মাঠে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হলেও সমাবেশ ও বিক্ষোভ দমনে ভূমিকা রাখে গবেষণাগারে উৎপাদিত কম মাত্রার রাসায়নিক অস্ত্র। ‘লেস-দ্যান-লিথাল’ বা ‘নন-লিথাল উইপন’ নামে পরিচিত অস্ত্রগুলো প্রস্তুত করা হয় বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ উপাদান ঘনীভূত করে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে থাকে মরিচ। তবে অস্ত্র হিসেবে মরিচের ব্যবহার ভিন্ন মাত্রা পায় ১৯২০-এর দশকে। প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করতে এ সময় আমেরিকান আর্মির ‘অ্যাজউড আর্সেনাল ফ্যাসিলিটি’ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে এ ধরনের অস্ত্রকে। তাকে ছাড়িয়ে যায় ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ গবেষণায় প্রস্তুতকৃত সিএস গ্যাস। টিয়ার গ্যাস বা কাঁদানে গ্যাস হিসেবে জনপ্রিয় হতে থাকে ব্যবহার। সেখানে যথারীতি কাঁচামাল হিসেবে জায়গা দখল করেছিল মরিচ। পরবর্তী কয়েক দশকজুড়ে সিএস গ্যাসে জয়জয়কার ছিল বিভিন্ন দেশে। ১৯৭০-সালের পর কাঁচামরিচ থেকে ওলেওরেসিন ক্যাপসিকাম (ওসি) প্রস্তুতির পর কিছুটা পরিবর্তন আসে। জনগণের বিশৃঙ্খলা প্রশমনে সিএস গ্যাসের বদলে পুলিশ ‘ওসি’ ব্যবহার করতে থাকে তখন থেকে। তাদের ব্যবহূত স্প্রেতে ১৫ শতাংশ কাঁচামরিচ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উপাদান থাকে। বাজারে বিক্রির জন্য যেসব গ্যাস উৎপাদিত হয়, তাতে অবশ্য ১ শতাংশের বেশি থাকে না। নাক, চোখ, ফুসফুস এমনকি ত্বকের ওপরও এ গ্যাসের সরাসরি প্রভাব রয়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লাগতে পারে ৪৫ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত। বিভিন্ন দেশে মরিচ থেকে তৈরি স্প্রে বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে নব্বইয়ের দশকে। সবার জন্য ব্যবহারে বিধিনিষেধ থাকলেও ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে দুই পক্ষের সংঘাতে এ স্প্রে দৃশ্যমান হয়। ব্যক্তিগতভাবে একদিকে হয়রানিকারীদের বিরুদ্ধে নারীরা ব্যবহার করে। অন্যদিকে লোকালয়ে দুষ্ট কুকুর কিংবা বনে চলাচলের সময় হিংস্র প্রাণীর বিরুদ্ধেও ব্যবহূত হয় প্রায়ই। ১৯৯৭ সালের ‘কেমিক্যাল উইপন কনভেনশন’-এ এমন অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যা-ই হোক, ২০১০ সালে ভারতের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন মরিচ থেকে নতুন এক ধরনের গ্রেনেড তৈরির ঘোষণা দেয়। সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী দমনে গ্রেনেডটি কার্যকর বলে দাবি করা হয়েছে। তৈরি হওয়া বিপুল ধোঁয়া নব্বই মিটার দূর পর্যন্ত কার্যকর থাকতে সক্ষম। এরই মধ্যে এটি কাশ্মীরে আজাদি আন্দোলনকারীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধেও এ গ্রেনেড ব্যবহার করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।
মরিচের সঙ্গে মানুষের দীর্ঘ সম্পর্ক খাবারের টেবিলে। তবে সেটা কেবল একটা দিক। অন্য দিকটা মোটেও সুখকর না। মরিচ সেখানে জড়িত সংঘাত আর রক্তের ইতিহাসে। হয়তো মানুষের ইতিহাসই এমন।
সূত্র: আহমেদ দীন রুমি
বণিক বার্তা
No comments:
Post a Comment