Sunday, September 3, 2017

ইসলামে আসার গল্প : শাইখ মির্জা ইওয়ার বেইগ

ইসলামে আসার গল্প : শাইখ মির্জা ইওয়ার বেইগ

আমি হার্টফোর্ড থেকে লস অ্যাঞ্জেলে যাওয়ার জন্য নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করছিলাম ডেট্রয়েটে ওদের একটি হাব আছে তাই বিমান সেখানে থামল দুর্ভাগ্যবশত আমার সিটটি ছিল মাঝখানে চিন্তা করুন, অ্যামেরিকার মধ্যে ঘণ্টার বেশি সময় ইকনমি ক্লাসের তাও আবার মাঝের সিটে বসে ভ্রমণ করার বিষয়টি কতখানি বিরক্তিকর হতে পারে দিনটি ছিল শুক্রবার আমি একটি লম্বা সাদা জুব্বা পরাছিলাম, তার উপর ছিল (জুব্বার উপর পরিধানের) একটি মিশলাহ এবং মাথায় ছিল সাদা পাগড়ী হার্টফোর্ড এয়ারপোর্টে এক মহিলা আমার কাছে এসে বলল, ‘আপনি কী সুলতান?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘জি না, ম্যাডাম, এখনো হইনিতারপর দুজনেই হাসলাম আমরা বিমানে উঠলাম এবং ডেট্রয়েটে দিকে এটা উড়া শুরু করল জানালার পাশের লোকটি ডেট্রয়েটে নেমে গেলো তারপর একজন সাদা চামড়ার অ্যামেরিকান মহিলা এসে বসল

বিমান যখন আবার উড়া শুরু করল আমি কুরআনটা বের করে সূরা আল-কাহাফ পড়া শুরু করলাম শুক্রবারে সূরা কাহাফ পাঠ করা সুন্নাহআমি খেয়াল করছিলাম জানালার পাশের সেই মহিলাটি পাশ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং আমি কী পড়ছি তা দেখার চেষ্টা করছেকয়েক মিনিট পর সে আমাকে বলল, ‘আপনি কী পড়ছেন?’
ম্যাডাম, আমি কুরআন পড়ছি
এটা কোন ভাষা?’
আরবী
তারপর মহিলাটি কাত হয়ে সামনের সিটের নিচে রাখা তার হাতব্যাগটি থেকে একটা লকেট বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘আপনি কী এটা পড়তে পারেন?’

লকেটটা ছিল রুপার যার এপাশে লেখা ছিল সুবহান আল্লাহ এবং অন্য পাশে আলহামদুলিল্লাহআমার জানার কৌতূহল হলো যে সে এটা কোথায় পেয়েছেআমি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ‘এর মানে সকল প্রশংসা আল্লাহরএবং এর মানে সকল প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্যতারপর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি এটা কোথায় পেয়েছেন?’ সে হেসে আমাকে একটা চমৎকার গল্প বললআমার যতটুকু মনে আছে আমি তা এখানে তা তুলে আনার চেষ্টা করছি
সে বলল, ‘এই লকেটটা আমার দাদী আমাকে দিয়েছেআমার দাদীকে এই লকেটটা তার এক ইরানী বান্ধবী এ কথা বলে দিয়েছিল যে, ‘এটা তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবেএতে কী লেখা আছে তা আমার অজানা ছিল যখন আমি আপনাকে দেখলাম, আমার মনে হয়েছে যে আপনি বলতে পারবেনতাই আমি আপনাকে দেখিয়েছি

তারপর সে বলল, ‘আপনি জানেন, আপনার সাথে আমার দেখা হওয়ার বিষয়টি কোনো আকস্মিক বিষয় নয়আমি লস অ্যাঞ্জেলে থাকিএকটা কনফারেন্সে ডেট্রয়েটে এসেছিগতকাল আমার কনফারেন্স শেষ হয়ে গিয়েছেআমার লস অ্যাঞ্জেলে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলকিন্তু কিছু একটা আমাকে আটকে দিলবলল, আরেকটা দিন থেকে যেতেআমি আমার টিকেট বাতিল করে নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইনসে আজকের টিকেট কিনেছিআমি আগে কখনোই নর্থওয়েস্টে ভ্রমণ করিনিতার কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য সে আমাকে বাতিল করা টিকেটটা দেখালোআমি এত বিস্মিত ছিলাম যে কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলাম না

সে বলল, ‘কাল সন্ধ্যায়, আমি একা একা বসে আমার হোটেলের রুমে টিভি দেখছিলাম আর ভেবে অবাক হচ্ছিলাম যে আমি ডেট্রয়েটে বসে আছি কেনকেন আমি একরাতের জন্য বেশি টাকা ব্যয় করে এখানে রয়ে গিয়েছি? অথচ আমার সব বন্ধু ও সহকর্মীরা যে যার বাড়িতে চলে গিয়েছেতারপর আজ সকালে যখন এই ফ্লাইটে আপনার সাথে দেখা হলো তখন আপনি আমাকে লেখাটির মানে বললেনআপনি যেটা পড়ছিলেন সেটা কি একটু শব্দ করে পড়বেন, প্লীজ? আমার শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে
আমি শব্দ করে সূরা আল কাহাফ পাঠ করলামযখন পাঠ শেষে কুরআন বন্ধ করলাম, সে বিস্মিত হয়ে বলল, ‘চমতকারশেষ হয়ে গিয়েছে? আমি ভেবেছিলাম আপনি বইয়ের শেষ পর্যন্ত পাঠ করবেনআমার চোখ অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠলএকজন মহিলা যে কুরআনের একটি শব্দও বুঝে না তারপরও সে আরও বেশি বেশি শুনতে চাচ্ছেএটাই হলো আমাদের রবের কালামের অলৌকিকত্বযারা বুঝতে পারে না তাদের অন্তরকেও তা ছুয়ে যায়

আমি আল্লাহর কাছে দুআ করলাম, ‘ইয়া রাব্বী, তোমার দ্বীনের প্রতি এই মহিলার অন্তরকে খুলে দাওআমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে তাকে ইসলাম সম্পর্কে বলবদয়াকরে তাকে দিয়ে আমাকে প্রশ্ন করাও
তারপর সে আমাকে বলল, ‘আপনি কি আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলবেন?’
আমি বললাম, ‘ইসলাম হলো কেবলমাত্র আমাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তার ইবাদত করা এবং তাঁর ক্ষমতা, মহমা ও গরিমার ক্ষেত্রে কোনো অংশীদার স্থাপন না করাকারণ তিনি কোনোরূপ সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই সবকিছু একা সৃষ্টি করেছেন এবং কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি একা গোটা সৃষ্টি জগতকে প্রতিপালন করছেন এবং কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি এই সবকিছুকে তিনি ধ্বংস করবেনতারপর আমাদের সবাইকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবেইসলাম হলো মুহাম্মদ (সা.)কে আল্লাহর প্রেরিত নবুওয়াতের ধারার সর্বশেষ নবী হিসেবে মেনে নেওয়া

ইসলাম হলো আল্লাহর রাসুলদের মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য না করে তাদের সবার উপর ঈমান আনাইসলাম হলো তাদের সবাইকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নেওয়াতাদেরকে যে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল তারা তা যথাযথভাবে পালন করেছেনসেটা হলো আল্লাহর সাথে কোনো অংশীদার স্থাপন না করে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করার দায়িত্বআমরা মুসলিমরা নূহ, ইবরাহীম, মুসা এবং যিশু (ঈশা (আ.) এবং আল্লাহর অন্যান্য সব নবী রাসুলকে বিশ্বাস করিআমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র এই কয়েকজন নবী-রাসুলকেই পাঠাননি বরং তিনি পৃথিবীর প্রত্যেকটা স্থানে প্রত্যেক জাতির কাছে নবী-রাসুল পাঠিয়েছিলেনতাদের কতিপয়ের কথা আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেছেন এবং অন্যান্যদের কথা তিনি উল্লেখ করেননিইসলাম হলো মৃত্যুর পরবর্তী জীবনকে বিশ্বাস করা এবং বিচার দিবসের উপর ঈমান আনাসেদিন আমাদেরকে আমাদের কাজের হিসাব দেওয়ার জন্য আহবান করা হবে এবং তার উপর নির্ভর করে আমাদের জান্নাতে অথবা জাহান্নামে পাঠানো হবে

সে মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল এবং এমনভাবে মাথা নাড়াল যেন সে আমার কথায় সম্মতি প্রকাশ করছেযিশু সম্পর্কে আপনারা কী বলেন?’ সে প্রশ্ন করল
আমরা তা-ই বলি যা আল্লাহর কিতাবে বলা হয়েছেআমি বললামআমরা বলি যে তিনি ছিলেন কুমারী মারিয়াম (আ.)এর পুত্রআল্লাহর পুত্র ননআল্লাহ তায়ালা জিবরীল (আ.)কে তার মা মারিয়াম (আ.)এর কাছে পাঠান যিনি ছিলেন একজন ধার্মিক নারীজিবরীল (আ.) তাকে পুত্র সন্তান জন্মের সুসংবাদ দেনমারিয়াম (আ.) বলেন, ‘কীভাবে আমার সন্তান হবে অথচ আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি?’
জিবরীল (আ.) উত্তর দেন, ‘আপনার রবের জন্য এটা সহজতারপর ঈশা (আ.) একজন কুমারী মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করেনঈশা (আ.) ছিলেন আল্লাহর রাসুল যিনি জন্মের পর শৈশবে কথা বলেছেনআল্লাহ তায়ালা তাকে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেনতিনি কুষ্ঠ রোগিদের সুস্থ করতেন, অন্ধদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতেন এবং মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন এবং আরও অনেক অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়েছেনআমরা বিশ্বাস করি যে তিনি এই অলৌকিক কাজগুলো করেছেন আল্লাহর ইচ্ছায়, তার নিজের ক্ষমতায় নয়তিনি এসেছিলেন বনী ইসরাইলদেরকে মুসা (আ.)এর আনিত বিধানের দিকে ফিরিয়ে নিতে এবং তাদেরকে পৃথিবীতে ফিতনা-ফ্যাসাদ ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করতেতারা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা সফল হয়নিআল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়েছেন এবং জীবিত অবস্থায় তার কাছে তুলে নিয়েছেন

আমরা বিশ্বাস করি যে ঈশা (আ.) পৃথিবী ধ্বংসের আগে আবার ফিরে আসবেন এবং তার আগমন হলো কিয়ামতের একটি লক্ষণতিনি দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন তখন মুসলিমরা ঈশা (আ.) এর পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবেআমরা বিশ্বাস করি যে তিনি তখন অন্যান্য মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করবেন, বিয়ে করবেন, মৃত্যু বরন করবেন এবং তাকে কবর দেওয়া হবে
আমার কথাব শুনে সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল এবং বলল, ‘আপনার কথায় যৌক্তিকতা আছেযীশু মানুষের পাপের জন্য ক্রসে ঝুলে মারা গিয়েছে ব্যাপারে আপনাদের মতামত কী?’
আমরা বলি যে আল্লাহ তায়ালা অবিচারক ননঅন্য মানুষের পাপের জন্য একটা নিস্পাপ মানুষকে ভয়ঙ্করভাবে মৃত্যুর শাস্তি দেওয়া একটি বড় ধরনের অবিচারতাছাড়া কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা অন্য কাউকে শাস্তি দিতে বাধ্য ননআল্লাহ যদি ক্ষমা করে দিতেই চান তাহলে তিনি তা এমনিই পারেনকারণ তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারীক্ষমা পাওয়ার জন্য সত্যিকারভাবে অনুতপ্ত হয়ে আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আল্লাহ তায়ালা তাহলেই ক্ষমা করে দিবেনএর জন্য আর বেশি কিছু করার দরকার নেই
সে আরও একবার মাথা নেড়ে বলল, ‘আমি একমতস্রষ্টা কি অন্যদের পাপের জন্য একজন নিস্পাপ মানুষকে শাস্তি দিতে পারেন?’ তারপর সে বলল, ‘আচ্ছা, কীভাবে মুসলিম হতে হয়?’
আমি বললাম, ‘বলতে হবে যে, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদাতের যোগ্য কোনো ইলাহা নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল); এবং অন্তর থেকে এর উপর ঈমান আনতে হবেঅন্তর থেকে সব ধরনের মিথ্যা বিশ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিতে হবেএমনকি এটাও বিশ্বাস করা যাবে না যে যীশু আল্লাহর পুত্রমনে করা যাবে না যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মানুষ, ফেরেশতা অথবা অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য অথবা তারা কোনোভাবে কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ ঘটানোর ক্ষমতা রাখে

এতটুকুই?’ আমি যদি শুধু এতটুকু বলি এবং আমার অন্তর থেকে বিশ্বাস করি তাহলেই আমি মুসলিম হয়ে যাবো?’
জি হ্যাঁ, আপনি এই বাক্য পাঠ করলে আর অন্তর থেকে বিশ্বাস করলেই মুসলিম হয়ে যাবেনআমি উত্তর দিলাম
আমাকে আর কী করতে হবে?’ সে প্রশ্ন করল
আমি বললাম, ‘দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত সালাহ আদায় করতে হবে, আপনার উদ্ধৃত্ত সম্পদের ২.৫ শতাংশ প্রতি বছর দান করে দিতে হবে এবং রমাদান মাসে রোজা রাখতে হবেআর আপনি যদি পারেন তাহলে জীবনে একবার আল্লাহর ঘরে হজ্ব করবেনখাদ্যের ব্যাপারে আল্লাহর বিধানগুলো মেনে চলবেন (শূকরের মাংস খাবেন না, মদ পান করবেন না অথবা কোনো নেশা জাতিয় দ্রব্য সেবন করবেন না), ন্যায়পরায়ণ, দায়িত্বশীল ও নৈতিক জীবন যাপন করবেনসবসময় সচেতন থাকবেন যে আপনাকে আপনার কাজকর্মের হিসাব দিতে হবে


সে জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কি এখনই মুসলিম হতে পারব?’
কথাটা শুনে আমার অন্তর বলে উঠল, ‘ইয়া আল্লাহ, তুমি আমার ও তার রবতুমি আমাকে আজ দেখালে যে কীভাবে তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়েতের পথে আনো কারও সাহায্য ছাড়াইইয়া আল্লাহ, তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কোনো ভাষা আমার জানা নেইআমি তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি সেই শব্দের দ্বারা যা তোমার শান ও মর্যাদার সাথে মানানসই
আমি বললাম, ‘জি, আপনি চাইলে এখনি মুসলিম হতে পারেন
তাহলে বলুন আমাকে কী করতে হবে
আমার সাথে সাথে পাঠ করুন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অয়া আশাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহিসে পাঠ করল এবং ভূমি থেকে ৩৫,০০০ ফুট উপরে বাতাসের মধ্যে যখন আমরা ঘণ্টায় ৯০০ মাইল বেগে চলছিলাম সে অবস্থায় সে ইসলামের প্রশান্তির ছায়াতলে প্রবেশ করলএটাই হলো আমার রবের দয়াআলহামদুলিল্লাহ।

No comments:

Post a Comment