আল কুরআনের আলোকে রোগ-ব্যাধি
ও নিরাময়
১. হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ
থেকে নসীহত এসে গেছে৷ এটি এমন জিনিস যা অন্তরের রোগের নিরাময় এবং যে তা গ্রহণ করে
নেয় তার জন্য পথনির্দেশনা ও রহমত৷(সূরা ইউনূস আয়াত ৫৭)
Yaaa aiyuhan naasu qad jaaa'atkum maw 'izatum mir Rabbikum wa
shifaaa'ul limaa fis sudoori wa hudanw wa rahmatul lilmu'mineen
২. আমি এ কুরআনের অবতরণ প্রক্রিয়ায় এমন সব বিষয় অবতীর্ণ
করছি যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত এবং জালেমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি
করে না৷(সূরা বণী ইসরাঈল আয়াত ৮২)
অর্থাত যারা এ কুরআনকে নিজেদের পথপ্রদর্শক এবং নিজেদের জন্য
আইনের কিতাব বলে মেনে নেয়, তাদের জন্য তো এটি আল্লাহর রহমত এবং তাদের যাবতীয়
মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নৈতিক ও তামাদ্দুনিক রোগের নিরাময় ৷ কিন্তু যেসব জালেম একে
প্রত্যাখ্যান করে এবং এর পথনির্দেশনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের ওপর
জুলুম করে এ কুরআন তাদেরকে এর নাযিল হবার বা একে জানার আগে তারা যে অবস্থায় ছিল
তার ওপরও টিকে থাকতে দেয় না ৷ বরং তাদেরকে আরো বেশী ক্ষতির মধ্যে ঠেলে দেয় ৷ এর
কারণ, যতদিন কুরআন আসেনি অথবা যতদিন তারা কুরআনের সাথে পরিচিত হয়নি ততদিন তাদের
ক্ষতি ছিল নিছক মূর্খতা ও অজ্ঞতার ক্ষতি ৷
কিন্তু যখন কুরআন তাদের সামনে এসে গেলো এবং সে হক ও বাতিলের পার্থক্য
সুস্পষ্ট করে দেখিয়ে দিল তখন তাদের ওপর আল্লাহর দাবী অকাট্যভাবে সঠিক প্রমাণিত হয়ে
গেলো ৷ এখন যদি তারা তাকে প্রত্যাখ্যান করে গোমরাহীর ওপর অবিচল থাকার জন্য জোর দেয়
৷ তাহলে এর অর্থ হয় তারা অজ্ঞ নয় বরং জালেম ও বাতিল পন্থী এবং সত্যের প্রতি বিরূপ
৷ এখন তাদের অবস্থা হবে এমন ব্যক্তির মতো যে বিষ ও বিষের প্রতিশেধক উভয়টি দেখে
বিষকে বেছে নেয় ৷ নিজেদের গোমরাহী ও ভ্রষ্টতার জন্য এখন তারা নিজেরাই হয় পুরোপুরি
দায়ী এবং এরপর তারা যে কোন পাপ করে তার পূর্ণ শাস্তির অধিকারীও তারাই হয় ৷ এটি অজ্ঞতার
নয় বরং জেনে শুনে দুষ্টামি ও দুষ্কৃতিতে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতি এবং অজ্ঞতার ক্ষতির
চাইতে এর পরিমাণ বেশী হওয়া উচিত ৷ একথাটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
একটি ছোট তাতপর্যবহ বাক্যের মধ্যে বর্ণনা করেছেন ৷
Wa nunazzilu minal quraani maa huwa shifaaa'unw wa rahmatul
lilmu;mineena wa laa yazeeduz zaalimeena illaa khasaaraa
৩. এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে রোগমুক্ত করেন৷(সূরা আশ শুয়ারা
আয়াত ৮০)
একমাত্র
আল্লাহর বন্দেগী করার স্বপক্ষে এটি হচ্ছে দ্বিতীয় যুক্তি(প্রথম যুক্তি হলো যিনি আমাকে
সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনিই আমাকে পথ দেখিয়েছেন৷)৷ যদি
তিনি মানুষকে কেবল সৃষ্টি করেই ছেড়ে দিতেন এবং সামনের দিকে তার দুনিয়ার জীবন যাপনের
সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক না রাখতেন তাহলেও মানুষের তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সহায়তা
চাওয়ার কোন যুক্তিসংগত কারণ থাকতো৷ কিন্তু তিনি তো সৃষ্টি করার সাথে সাথে পথনির্দেশনা,
প্রতিপালন, দেখাশুনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজন পূর্ণ করার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন৷ যে
মুহূর্তে মানুষ দুনিয়ায় পদার্পণ করে তখনই তার মায়ের বুকে দুধের ধারা সৃষ্টি হয়৷ অন্যদিকে
কোন অদৃশ্য শক্তি তাকে স্তন চোষার ও গলা দিয়ে দুধ নিচের দিকে নামিয়ে নেবার কায়দা শিখিয়ে
দেয়৷ তারপর এ প্রতিপালন, প্রশিক্ষণ ও পথ প্রদর্শনের কাজ প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে মৃত্যুর
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বরাবর চালু থাকে৷ জীবনের প্রতি পর্যায়ে মানুষের নিজের অস্তিত্ব,
বিকাশ , উন্নয়ন ও স্থায়ীত্বের জন্য যেসব ধরনের সাজ-সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় তা সবই তার
স্রষ্ট পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সর্বত্রই সঠিকভাবে যোগান দিয়ে রেখেছেন৷ এ সাজ-সরঞ্জাম
থেকে লাভবান হবার এবং একে কাজে লাগাবার জন্য তার যে ধরনের শক্তি ও যোগ্যতার প্রয়োজন
তা সবও তার আপন সত্তায় সমাহিত রাখা হয়েছে৷ জীবনের প্রতিটি বিভাগে তার যে ধরনের পথনির্দেশনার
প্রয়োজন হয় তা দেবার পূর্ণ ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছেন৷ এর সংগে তিনি মানবিক অস্তিত্বের
সংরক্ষণের এবং তাকে বিপদ-আপদ, রোগ-শোক , ধ্বংসকর জীবাণু ও বিষাক্ত প্রভাব থেকে রক্ষা
করার জন্য তার নিজের শরীরের মধ্যে এমন শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন মানুষের জ্ঞান
এখনো যার পুরোপুরি সন্ধান লাভ করতে পারেনি৷ আল্লাহর এ শক্তিশালী প্রাকৃতিক ব্যবস্থা
যদি না থাকতো, তাহলে সামান্য একটি কাঁটা শরীরের কোন অংশে ফুটে যাওয়াও মানুষের জন্য
ধ্বংসকর প্রমাণিত হতো এবং নিজের চিকিতসার জন্য মানুষের কোন প্রচেষ্টাই সফল হতো না৷
স্রষ্টার এ সর্বব্যাপী অনুগ্রহ ও প্রতিপালন কর্মকাণ্ড যখন প্রতি মুহূর্তে সকল দিক থেকে
মানুষকে সাহায্য করছে তখন মানুষ তাকে বাদ দিয়ে অন্য কোন সত্তার সামনে মাথা নত করবে
এবং প্রয়োজন পূরণ ও সংকট উত্তরণের জন্য অন্য কারো আশ্রয় গ্রহণ করবে, এর চেয়ে বড় মূর্খতা
ও বোকামী এবং এর চেয়ে বড় অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে ?
Wa izaa mardtu fahuwa
yashfeen
৪. এদের বলো, এ কুরআন মু’মিনদের জন্য হিদায়াত ও রোগ মুক্তি বটে৷ কিন্তু
যারা ঈমান আনে না এটা তাদের জন্য পর্দা ও চোখের আবরণ৷ তাদের অবস্থা হচ্ছে এমন যেন দূর
থেকে তাদেরকে ডাকা হচ্ছে৷ (সূরা হামীম আস্ সাজদা আয়াত ৪৪)
অর্থাত দূর থেকে
যখন কাউকে ডাকা হয় তখন তার কানে একটা আওয়াজ প্রবেশ করে ঠিকই তবে আওয়াজ দাতা কি বলছে
তা সে বুঝতে পারে না৷ এটা এমন একটা নজির বিহীন উপমা যার মাধ্যমে হঠকারী বিরোধীদের পুরো
মনস্তাত্ত্বিক চিত্র চোখের সামনে ফুটে ওঠে৷ বিদ্বেষ বা পক্ষপাত দোষ মুক্ত লোকের সামনে
যদি আপনি কথা বলেন, তাহলে সে তা শোনে, বুঝার চেষ্ট করে এবং যুক্তিসংগত কথা হলে খোলা
মনে তা গ্রহণ করে৷ এটাই স্বভাবিক৷ পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে শুধু বিদ্বেষই
পোষণ করেনা, বরং শত্রুতাও পোষণ করে তাকে আপনি আপনার কথা যতই বুঝাতে চেষ্টা করবেন সে
আদৌ সে কথার প্রতি মনোযোগী হবে না৷ আপনার সব কথা শোনার পরও এত সময় ধরে আপনি তাকে কি
বললেন তা সে বুঝবে না৷ আপনিও মনে করবেন যেন আপনার কথা তার কানের পর্দায় ধাক্কা খেয়ে
বাইরে দিয়েই চলে গেছে, মন ও মগজে প্রবেশ করার মত কোন রাস্তাই খুঁজে পায়নি৷
qul
huwa lillazeena aamanoo hudanw wa shifaaa'unw wallazeena la yu'minoona feee
aazaanihim waqrunw wa huwa 'alaihim 'amaa; ulaaa'ika yunaadawna mim maakaanim
ba'eed
৫. আমরা রোগাক্রান্ত হই। আমরা রোগের চিকিতসার জন্য চিকিতসকের
দ্বারস্থ হই ও চিকিতসা করি। আল্লাহর রহমতে আমরা রোগমুক্ত হই। মূলত: আল্লাহ পাক হচ্ছেন
আমাদের রোগনিরাময়কারী। মহান আল্লাহপাক সকল রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
‘তিনি
মুমিনদের অন্তরের রোগ নিরাময়কারী’ (সূরা তওবা: আয়াত ১৪) ।
Qaatiloohum yu'az
zibhumul laahu bi aideekum wa yukhzihim wa yansurkum 'alaihim wa yashfi sudoora
qawmim mu 'mineen
৬.
‘উহার উদর হতে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয় যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য’ (সূরা
নাহল: আয়াত ৬৯) ।
yakhruju mim butoonihaa sharaabum mukh talifun alwaanuhoo
feehi shifaaa'ul linnaas,
৭.
রোগ মুমিনের জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের বিভিন্ন প্রকার রোগের
মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন: “আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করব ভয়-ভীতি, ক্ষুধা, জান-মাল
ও ফসলের স্বল্পতা দ্বারা, (হে রাসূল!) তুমি ধৈর্য্যশীলদের সুসংবাদ দাও।” (সূরা আল-বাকারাহ:
১৫৫)
Wa lanablu wannakum
bishai'im minal khawfi waljoo'i wa naqsim minal amwaali wal anfusi was
samaraat; wa bashshiris saabireen
০৮.
আর (এ একই
বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান) আমি আইয়ুবকে দিয়েছিলাম৷ স্মরণ করো, যখন সে
তার রবকে ডাকলো, “আমি রোগগ্রস্ত হয়ে গেছি এবং তুমি করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ
করুণাকারী৷” (সূরা আল আম্বিয়া আয়াত ৮৩)
Rabbahooo annee massaniyad durru wa Anta arhamur raahimeen
দোয়ার ধরন অত্যন্ত পবিত্র, সূক্ষ্ম ও নমনীয়! সংক্ষিপ্ত বাক্যের
সাধ্যমে নিজের কষ্টের কথা বলে যাচ্ছেন এবং এরপর একথা বলেই থেমে যাচ্ছেন- "তুমি
করুণাকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ৷" পরে কেন অভিযোগ ও নালিশ নেই, কোন জিনিসের
দাবী নেই৷ দোয়ার এই ভংগিমা যে উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন চিত্রটি তুলে ধরে তা হচ্ছে এই
যে, কোন পরম ধৈর্যশীল, অল্পে তুষ্ট, ভদ্র ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি দিনের পর
দিন অনাহার ক্লিষ্টতার দুঃসহ জ্বালায় ব্যাকুল হয়ে কোন পরমদাতা ও দয়ালু ব্যক্তির সামনে
কেবলমাত্র এতটুকু বলেই ক্ষান্ত হয়ে যায়, "আমি অনাহারে আছি এবং আপনি বড়ই দানশীল৷"
এরপর সে আর মুখে কিছুই উচ্চারণ করতে পারে না৷
০৯. আমি তার দোয়া কবুল করেছিলাম, তার যে কষ্ট ছিল তার দূর করে দিয়েছিলাম।-(সূরা
আল আম্বিয়া আয়াত ৮৪)
Fastajabnaa lahoo
fakashaf naa maa bihee min durrinw wa aatainaahu ahlahoo wa mislahum ma'ahum
rahmatam min 'indinaa wa zikraa lil'aabideen
সম্ভবত:
হযরত আইয়ূব কোন কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাইবেলও একথাই বলে যে, তাঁর সারা
শরীর ফোঁড়ায় ভরে গিয়েছিল। এ রোগে আক্রান্ত হবার পর হযরত আইয়ূবের স্ত্রী ছাড়া আর
সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, এমন কি সন্তানরাও তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
রোগের
প্রচণ্ডতা, ধন-সম্পদের বিনাশ এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণে তিনি যে
কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তার চেয়ে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা ছিল এই
জন্য এই যে, শয়তান তার প্ররোচনার মাধ্যমে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় শয়তান,
আইয়ূব (আ.)কে মহান রব থেকে হতাশ করার চেষ্টা করে, মহান রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ করাতে
চায় এবং তিনি যাতে অধৈর্য্য হয়ে উঠেন সে প্রচেষ্টায় রত থাকে। কিন্তু আইয়ূব আ.
শয়তানের প্ররোচনার ফাঁদে পা দেন নি। তিনি নিজের শারীরিক কষ্টের কোন অভিযোগ করেন
নি। অবৈধ বা শির্কের পথে পা বাড়াননি।
এখনও
শয়তান আমাদের অনেকের জীবনের অসুস্থতা বা বিপদের সুযোগ নিয়ে শির্কের পথে (মাজার,
অবৈধ পীর বা তাবিজ, শরীয়ত বিরোধী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে) সহজে নিয়ে যেতে প্রচেষ্টা
চালায়। অনেক মুসলিম ভাই বোনেরা অজ্ঞতার কারনে বা অধৈর্যের বশবর্তী হয়ে শয়তানের
ফাঁদে পা বাড়িয়ে ফেলেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
No comments:
Post a Comment