Monday, June 10, 2019

পোশাক মানব সভ্যতায় কেন গুরুত্বপূর্ণ? আল কুরআনের ব্যাখ্যা


সুরা আল আরাফ আয়াত ২৬ ও ২৭
২৬) হে বনী আদম! তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরক্ষণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি৷ আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম৷ এই আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম, সম্ভবতঃ লোকেরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে৷
Yaa Baneee Aadama qad anzalnaa 'alaikum libaasany yuwaaree saw aatikum wa reeshanw wa libaasut taqwaa zaalika khair; zaalika min Aayaatil laahi la'allahum yaz zakkaroon. 
ইয়া বানী আদামা কা’দ আনঝালনা ‘আলাইকুম লিবাছাইঁ ইউওয়া-রী ছাওাআতিকুম ওয়া রীশাওঁ ওয়া লিবাছুততাকওয়া ওয়া যালিকা খাইর, যালিকা মিন আয়াতিল্লাহি লা আ‘ল্লাহুম ইয়াযযাক্কারূন।
ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতে আদম ও হাওয়ার ঘটনার একটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আরববাসীদের সামনে তাদের নিজেদের জীবনে শয়তানী ভ্রষ্টতা -প্রতারণার একই অত্যন্ত সুষ্পষ্ট প্রভাবের প্রতি অংগলী নির্দেশ করা হয়েছে৷ তারা কেবলমাত্র সৌন্দর্য সামগ্রী হিসেবে ও বিভিন্ন ঋতুর প্রভাব থেকে শারীরিকভাবে আত্মরক্ষা করার জন্যে পোশাক ব্যবহার করতো৷ কিন্তু এর যে প্রাথমিক ও মৌলিক উদ্দেশ্য শরীরের লজ্জাস্থানগুলোকে আবৃত করা, সেটি তাদের কাছে কোন গুরুত্ব লাভ করেনি৷ নিজেদের লজ্জাস্থানগুলোকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে তারা মোটেই ইতস্ততঃ করতো না৷ প্রকাশ্য স্থানে উলংগ হয়ে গোসল করা, পথে ঘাটে যেখানে সেখানে প্রকাশ্য জায়গায় প্রকৃতির ডাকে উদোম হয়ে বসে পড়া, পরণের কাপড় খুলে পড়ে যেতে এবং লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হয়ে যেতে থাকলেও তার পরোয়া না করা ইত্যাদি ছিল তাদের প্রতিদিনের অভ্যাস৷ সবচেয়ে মারাত্মক ছিল হজ্জের সময় তাদের অসংখ্য লোকের কাবার চারদিকে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করা ৷ এ ব্যাপারে তাদের পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই ছিল কিছু বেশী নির্লজ্জ৷ তাদের দৃষ্টিতে এটি ছিল একটি ধর্মীয় কাজ এবং সতকাজ মনে করেই তারা এটি করতো৷ আর যেহেতু এটি কেবল আরবদের বৈশিষ্ট্য ছিল না রবং দুনিয়ার অধিকাংশ জাতি ও নির্লজ্জ বেহায়াপনায় লিপ্ত ছিল এবং আজো আছে তাই এখানে কেবলমাত্র আরববাসীদেরকে সম্বোধন করা হয়নি বরং ব্যাপকভাবে সারা দুনিয়ার মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে৷ এখানে সমগ্র মানব জাতিকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে যে, দেখো শয়তানী প্রতারণার একটি সুষ্পষ্ট আলামত তোমাদের নিজেদের জীবনেই রয়েছে৷ তোমরা নিজেদের রবের পথনির্দশনার তোয়াক্কা না করে এবং নিজেদের নবী -রসূলের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেরাই নিজেদেরকে শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছো৷ আর সে তোমাদেরকে মানবিক প্রকৃতির পথ থেকে বিচ্যুত করে সেই একই নির্লজ্জতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে যার মধ্যে ইতিপূর্বে সে তোমাদের প্রথম পিতা-মাতাকে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল৷ এ ব্যাপারে চিন্তা করলে প্রকৃত সত্য তোমাদের সামনে সুষ্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে৷ অর্থাত রসূলদের নেতৃত্ব ও পথনির্দেশনা ছাড়া তোমরা নিজেদের প্রকৃতির প্রাথমিক দাবীগুলো পর্যন্ত ও বুঝতে এবং তা পূর্ণ করতে অক্ষম৷
২৭) হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনিভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমনভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্যে তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল৷ সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না৷ এ শয়তানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি৷
Yaa Banee Aadama laa yaftinannnakumush Shaitaanu kamaaa akhraja abawaikum minal Jannati yanzi'u 'anhumaa libaasahumaa liyuriyahumaa saw aatihimaaa; innahoo yaraakum huwa wa qabeeluhoo min haisu laa tarawnahum; innaa ja'alnash Shayaateena awliyaaa'a lillazeena laa yu'minoon.
ইয়া বানী আদামা লা-ইয়াফতিনান্নাকুমুশ শাইত্বোয়ানু কামা আখরাজা আবাওয়াইকুম মিনাল জান্নাতি ইয়াংঝি‘উ ‘আনহুমা-লিবা-ছাহুমা-লিইউরিয়াহুমা ছাওাআতিহিমা ইন্নাহু ইয়ারাকুম হওয়া ওয়াকাবীলুহু মিন হাইছু লা তারাওনাহুম ইন্না জা‘আলনাশ শায়াতীনা আউলিয়াআ লিল্লাজীনা লা-ইউমিনুন।
এখানে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সুষ্পষ্ট হয়ে সামনে ভেসে উঠেছেঃ
একঃ পোশাক মানুষের জন্যে কোন কৃত্রিম জিনিস নয়৷ বরং এটি মানব প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী৷ আল্লাহ মানুষের দেহের বহির্ভাগে পশুদের মত কোন লোমশ আচ্ছাদন জন্মগতভাবে তৈরী করে দেননি৷ বরং লজ্জার অনুভূতি তার প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন৷ তিনি মানুষের যৌন অংগগুলোকে কেবলমাত্র যৌনাংগ হিসেবেই তৈরী করেন না বরং এগুলোকে "সাওআত" ও বানিয়েছেন৷ আরবী ভাষায় "সাওআত" এমন জিনিসকে বলা হয় যার প্রকাশকে মানুষ খারাপ মনে করে৷ আবার এ প্রকৃতিগত লজ্জার দাবী পূরণ করার জন্যে তিনি মানুষকে কোন তৈরি করা পোষাক দেননি৷ বরং তার প্রকৃতিকে পোশাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন, যাতে নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করে সে প্রকৃতির এ দাবীটি উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর সৃষ্ট উপাদান ও উপকারণ সমূহ কাজে লাগিয়ে নিজের জন্যে পোশাক তৈরী করতে সক্ষম হয়৷
দুইঃ এ প্রাকৃতিক ও জন্মগত উপলব্ধির প্রেক্ষিতে মানুষের জন্যে পোশাকের নৈতিক প্রয়োজন অগ্রগণ্য৷ অর্থাত প্রথমে সে "সাওআত" তথা নিজের লজ্জাস্থান আবৃত করবে৷ আর তার স্বভাবগত চাহিদা ও প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত৷ অর্থাত তারপর তার পোশাক তার জন্যে "রীশ", অর্থাত দৈহিক সৌন্দর্য বিধান করবে এবং আবহাওয়ার প্রভাব থেকে তার দেহ সৌষ্ঠবকে রক্ষা করবে৷এ পর্যায়েও মানুষ ও পশুর ব্যাপার স্বভাবতই সম্পূর্ণ ভিন্ন৷পশুর শরীরের লোমশ আচ্ছাদন মূলত তার জন্যে "রীশ" অর্থাত তার শরীরের শোভা বর্ধন ও ঋতুর প্রভাব থেকে তাকে রক্ষা করে৷ তার লোমশ আচ্ছাদন তার লজ্জাস্থান ঢাকার কাজ করে না৷ কারণ, তার যৌনাংগ আদতে তার সাওআত বা লজ্জাস্থান নয়৷ কাজেই তাকে আবৃত করার জন্যে পশুর স্বভাবও প্রকৃতিতে কোন অনুভূতি ও চাহিদা থাকে না এবং তার চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে তার জন্যে কোন পোশাকও সৃষ্টি করা হয় না৷ কিন্তু মানুষ যখন শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করলো তখন ব্যাপারটি আর উল্টে গেলো৷ শয়তান তার এ শিষ্যদেরকে এভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো যে, তোমাদের জন্যে পোশাকের প্রয়োজন পশুদের জন্য পোশাকের প্রয়োজনের সমপর্যায়ভুক্ত, আর পোশাক দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার ব্যাপারটি মোটেই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়৷ বরং পশুদের অংগ -প্রত্যংগ যেমন তাদের লজ্জাস্থান হিসেবে বিবেচিত হয় না, ঠিক তেমনি তোমাদের এ অংগ -প্রত্যংগগুলোও লজ্জাস্থান নয় বরং এগুলো নিছক যৌনাংগ৷
তিনঃ মানুষের পোশাক কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান আবৃত করার এবং তার শারীরিক শোভাবর্ধন ও দেহ সংরক্ষণের উপায় হবে, এতটুকুই যথেষ্ঠ নয়৷ বরং আসলে এ ব্যাপারে তাকে অন্ততঃ এতটুকু মহত্তর মানে পৌছতে হবে, যার ফলে তার পোশাক তাকওয়ার পোশাকে পরিণত হয়৷ অর্থাত তার পোশাক দিয়ে সে পুরোপুরি "সতর" তথা লজ্জাস্থান ঢেকে ফেলবে৷ সৌন্দর্য চর্চা ও সাজসজ্জার মাধ্যমে শরীরের শোভা বর্ধন করার ক্ষেত্রে তা সীমা অতিক্রম করে যাবে না বা ব্যক্তির মর্যাদার চেয়ে নিম্ন মানেরও হবে না৷ তার মধ্যে গর্ব, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার কোন প্রদর্শনী থাকবে না৷ আবার এমন কোন মানসিক রোগের প্রতিফলনও তাতে থাকবে না৷ যার আক্রমণের ফলে পুরুষ নারীসূলভ আচরণ করতে থাকে, নারী করতে থাকে পুরুষসূলভ আচরণ এবং এ জাতি নিজেকে অন্য এক জাতির সদৃশ বানাবার প্রচেষ্টায় নিজের নিজের হীনতা ও লাঞ্ছনার জীবন্ত প্রতীকে পরিণত হয়৷ যেসব লোক নবীদের প্রতি ঈমান এনে নিজেদেরকে পুরোপুরি আল্লাহর পথনির্দেশনার আওতাধীন করে দেয়নি তাদের পক্ষে পোশাকের ব্যাপারে এ কাংখিত মহত্তর মানে উপনীত হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়৷ যখন তারা আল্লাহর পথনির্দশনা গ্রহণে অসম্মতি জানায় তখন শয়তানদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক বানিয়ে দেয়া হয় এবং এ শয়তান তাদেরকে কোন না কোনভাবে ভূল -ভ্রাণ্তি ও অসতকাজে লিপ্ত করেই ছাড়ে৷
চারঃ দুনিয়ার চারদিকে আল্লাহর যেসব অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এবং যেগুলো মহাসত্যের সন্ধানলাভের ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করে, পোশাকের ব্যাপারটিও তার অন্যতম৷ তবে এখানে শর্ত হচ্ছে, মানুষের নিজের তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে৷ ওপরে যেসব সত্যের দিকে ইংগিত করা হয়েছে সেগুলোকে একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে পোশাক কোন দৃষ্টিতে আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তা সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে৷
রেফারেন্স:

No comments:

Post a Comment