আল্লাহর সৃস্টি বান্দার উপর প্রথম আনুগত্যের মহড়া হলো সিজদা। কুরআন বলছে- আদম আঃ কে সৃস্টি করেই আল্লাহ ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে তাকে সিজদা করতে নির্দেশ দেন।
“আমি ফেরেশতাদের বললাম-আদমে সিজদা করো” (২:৩৪)
সকল ফেরেশতা সিজদা করলো,ইবলিশ করেনি।ফলে সে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অভিশপ্ত হলো।সমস্ত ভালো কাজের দুয়ার তার জন্য বন্ধ হলো এবং দুনিয়ায় সংঘটিত সকল মন্দ কাজের দায়ভার নিয়ে সে জাহান্নামের উপযুক্ত বিবেচিত হলো।
মানুষের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহকেই সিজদা করার নির্দেশ। গাছ,পাথর, সূর্য, দেবদেবী, প্রকৃতিক অতি প্রাকৃতিক কাউকেই সিজদা করা যাবেনা।
“তোমরা সূর্যকে সিজদা করোনা, চন্দ্রকেও না। সিজদা করো আল্লাহকে” (৪১:৩৭)
সিজদার বাধ্যবাধকতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রাসুল সাঃ বলেন-
“আল্লাহ ছাড়া যদি অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি আমি দিতাম, তাহলে দুনিয়ার স্ত্রীদের আদেশ করতাম তারা যেনো তাদের স্বামীদের সিজদা করে” (তিরমিযী)
সকল নামাজে সিজদা ফরয,সে নফল হোক বা শুকরিয়ার নামাজ হোক। এটাও ভাবনার যে ক্কিয়াম, রুকু, বৈঠক এক রাকা’তে একবারই হয়, কিন্ত সিজদা হয় দু’টা। সুবহান আল্লাহ। ভুলে একটা সিজদা দিলে নামাজই বাতিল হবে। প্রত্যেকটা সিজদা আবার আগে ও পরে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির দিয়ে সুরক্ষিত। নামাজে কোন ভুল হলে সংশোধনের জন্য পুনরায় সহু সিজদাই প্রযোজ্য হবে।
শুধু সিজদা একটা পৃথক ইবাদত। নামাজ না পড়েও সিজদা করা যায়, সিজদাতে দোয়া করা যায়। কুরআনে হাকীমে এমন চৌদ্দটা স্থান আছে তেলাওয়াতকারী সে স্থান অতিক্রমকালে সিজদা দিতেই হবে। এগুলো ‘তিলাওয়াতে সিজদা’। এসব আয়াত যিনি তিলাওয়াত করবেন আর যিনি শুনবেন উভয়ের উপরই তিলাওয়াত সিজদা করা ওয়াজিব। নামাজের হালতে এরকম আয়াত আসলে বাকী কার্যক্রম স্থগিত রেখে সাথে সাথে তিলাওয়াতে সিজদা দিতে হবে।
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর তাবত কিছু স্বেচছায় বা অনিচ্ছায় কেবলমাত্র আল্লাহকেই সিজদা করছে। নিয়মিত এই সিজদা চলছে বিরতিহীনভাবে।
“আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর তাবত কিছু ইচছায় বা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলিও সকাল ও সন্ধ্যায়” (১৩:১৫)
এটা বুঝা আবশ্যক যে এখানে শুধু জমীনে মাথা অবনত করার নামই সিজদা বুঝায়নি। গাছপালা-তরুলতা, চন্দ্র-সূর্য, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত মাথা নোয়াবার জন্য জমীনে নেমে আসেনা। বরং এখানে সিজদা মানে হলো আল্লাহর আদেশ নিষেধ ও নিয়ম কানুনের কাছে পূর্ণ সমর্পন। আল্লাহর আইনের কাছে অনুগত থেকে তারা প্রত্যেকেই যার যার পরিভ্রমণ, সন্তরন ও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কেউ মানছে স্বেচ্ছায় বিশ্বাসী হয়ে আর বিশ্বাস না করেও কেউ মেনে চলছে প্রাকৃতিক নিয়ম মনে করে কারণ এই বিধানের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। নভোমন্ডলের নেই, নেই ভুমন্ডলেরও ।এমনকি গাছের ডালের এক টুকরো ছায়ারও স্বস্থানে অটল থাকা সম্ভব নয়-নিয়মের সামনে নত হয়ে তাকেও প্রকৃত বস্তুর সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে হয়।মানুষ ছাড়া বাকীসব জন্ত জানোয়ার,বস্ত নিশ্চয় ও পদার্থের ক্ষেত্রেরই আনুগত্যই সিজদা। মানুষ আল্লাহর আইন বিধান মানবে এবং একই সাথে সিজদার মাধ্যমে তার এই আনুগত্যের জানান দিবে।
একই বিষয়ে কুরআনের আরো বহুস্থানে আল্লাহ বলেছেন-
“তুমি কি দেখোনা-আল্লাহকে সিজদা করে যাকিছু আছে আকাশমনডলী ও পৃথিবীতে,সূর্য -চন্দ্র, নভোমন্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তুও সিজদা করে মানুষের মধ্য অনেকে।” (২২:১৮)
“আল্লাহকেই সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশমন্ডলীতে, পৃথিবীতে যত জীবজন্ত আছে তারা এবং ফেরেশতাগণ-তারা কোন অহংকার করেনা বরং ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং তদেরকে যা আদেশ করা হয় তা তারা পরিপালন করে।” (১৬:৪৮-৪৯)
সিজদা করে বিনীত ও নিরহংকার ভাবে,সিজদা হয় আল্লাহর ভয়ে এবং আদেশ পালনার্থে। প্রকৃতির সিজদা এমন হলে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ বান্দা হিসেবে কেমন অনুভুতির সাথে তার রবকে সিজদা করবে? কেনো মানুষ সিজদায় পড়ে ইমোশনাল হতে পারেনা, কেনো জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা বলতে পারেনা, কেনো চোখের পানি ছাড়তে পারেনা?
আহারে মানুষ! তুমিই মাথাটা মাটির জমীনে নোয়াতে পারোনা তোমার সেই মালিকের জন্য যিনি তোমাকে সৃস্টি করেছেন, সুসমভাবে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, সুন্দর ও সুস্থ আকৃতিতে সাজিয়েছেন, দুনিয়ায় সন্মানজনক একটা অবস্থানও দিয়েছেন-
“হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে বিভ্রান্ত করলো?
যিনি তোমাকে সৃস্টি করলেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করলেন এবং সুসাঞ্জস্য করলেন। তিনি যে আকৃতিতে চেয়েছেন,তিনি তোমাকে গঠন করেছেন”(ইনফিতার: ৬-৮)
অথচ ঘাস লতাপাতাও তার কাছে আনত হয়, সিজদায় পড়ে থাকে।
দয়াময়ের নামে ‘সূরা রাহমানের’ প্রথম কয়টি আয়াত তেলাওয়াত করে দেখুন আপনার কেমন অনুভব হয়-
“আর রাহমান
তিনিই কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন
তিনিই সৃস্টি করেছেন মানুষ
তিনিই তাকে ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিখিয়েছেন
চন্দ্র ও সূর্য ঘুরে নিজ কক্ষপথে
তরুলতা ও গাছপালা তাঁরই সিজদায় রত”
ওহে আল্লাহর বান্দা !আজ তাঁর কোটি কোটি নিয়ামত ও অনুগ্রহ স্বাচ্ছন্দে, স্বাধীনভাবে বিনা অর্থে ভোগ করছো, তাঁর হুকুম প্রতিনিয়ত লংঘন স্বত্তেও তিনি তোমার পানাহার কেড়ে নেননি। জীবন ও সম্পদ দিয়ে সমাজে সুন্দর ও মর্যাদাপূর্ণ সম্মান দিয়ে রেখেছেন। তোমাকে যেটুকু সামান্য ক্ষমতা ও প্রভাব দিয়েছেন তার উত্তাপে তুমি গর্ব ও অহংকারে মেতে উঠো, মাঝে মধ্যে জোর দেখাও,জুলুমও করো।
এক সেকেন্ড একটু ভাবো।এই পৃথিবীতে আজ কারো পূর্বপুরুষই বেঁচে নেই। হামান,নমরুদ, ফেরাউন, শাদ্দাদরা অনেক বলশালী ও অহংকারী ছিলো। গোটা সাম্রাজ্য পাহারা লাগিয়েও মৃত্যুর ফেরেশতার আগমন রুখতে পারেনি। ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট অত্যাচারী হিসেবেই পৃথিবীবাসী তাদের চিনে আর তারই সাক্ষী হয়ে তাদের কংকাল যাদুঘরে রক্ষিত হয়েছে। তোমার আমার পরিণতি এর চেয়ে ব্যতিক্রম হবেনা-এটাই সত্য।
তোমার ভোগ করা লক্ষ কোটি নিয়ামতরাজির মূল্য তিনি শ্রম বা অর্থে চান না। আর সে মূল্য পরিশোধের সক্ষমতা পৃথিবীর কারো নেই। তিনি কেবল একটি সিজদা তোমার কাছে চান।আজ তোমার কত ব্যস্ততা।অফিসের বড় বস,ব্যবসাতে কনগ্লুমেরেট,রাজনীতিতে ভি আই পি। সিজদার সময় কোথায়? সারাদিনে চব্বিশ ঘন্টায় পাঁচ ওক্ত নামাজে বড়জোর আধঘন্টা, সতেরো রাকাত ফরয, চৌত্রিশটা সিজদা। মিটিং, কনফারেন্স, হাঁট-বাজার, ট্রাফিক জ্যাম,বিমান অপেক্ষা, ক্রিকেট ম্যাচ, টিভি সিরিয়াল, সোস্যাল প্রোগ্রাম কোনটিই বন্ধ নেই-শুধু মহান রবের সিজদার বেলায় বদ্ধমুষ্টি।
দুনিয়ায় উপরের দায়িত্বশীল কেউ একবার একটা আদেশ করলে খেয়ে না খেয়ে সেটা পালন করতে বাধ্য ছিলাম।কারণ তা লংঘনের পরিনতি জানতাম ভালো করে। সব মনিবের মনিব আল্লাহতা’লা কুরআনে প্রায় শতবার নামাজের কথা বলেছেন, সেটা কানেই তুললাম না, সেখানে ছিলাম প্রচন্ড রকমের অনিয়মিত অথবা নানা অযুহাতে সেটা স্থগিত রেখেছি।
দুনিয়ায় আল্লাহকে সিজদা না করলে আখিরাতের ট্রায়ালে আহকামুল ‘হাকেমীন যখন সিজদা করতে বলবেন তখন কোনভাবেই মাথা নত হবেনা।
“স্মরণ করো সেদিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচন করা হবে, যেদিন তাদের বলা হবে সিজদা করার জন্য। তারা তা করতে পারবেনা। তাদের দৃষ্টি অবনত হবে, হীনতা তাদের আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিলো তাদেরকে সিজদা করতে দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো।” (৬৮:৪২-৪৩)
হে আল্লাহর প্রিয় বান্দা !এই দিনতো দিন নয়, সামনে আরো দিন আছে। অনুতাপ অনুশোচনা করো। বলো-ভুল হয়েছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। বুদ্ধিমানের মতো শুধরে নাও।আল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দাও, প্রতিজ্ঞা করো, জীবনে আর একটা দিনও সিজদাবিহীন যাবেনা।তোমাকে উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ বলছেন-
“আল্লাহকে সিজদা দাও এবং তাঁর ইবাদাত করো” (৫৩:৬২)
“তোমরা সিজদা দাও আর আমার কাছাকাছি চলে এসো” (৯৬:১৯)
“সুতরাং তুমি তোমার পরতিপালকের প্রসংশা ও মহিমা ঘোষনা করো এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদাত করো” (১৫:৯৮-৯৯)
প্রখ্যাত সাহাবী ও হাদীস বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা রাঃ বলেন,রাসুল সাঃ বলেছেন-
আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে,অতঃপর সে সিজদা করে শয়তান তখন দূরে সরে গিয়ে কাঁদতে থাকে আর বলে-হায় আমাকে সিজদা করতে বলা হয়েছিলো, আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। ফলে আমার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হলো আর আদম সন্তান সিজদা করলো তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত হলো।
(মুসলিম,মিশকাত)
মাদআন বিন আবি তালহা রাঃ বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার রাসুল সাঃ এর আজাদ করা গোলাম সাওবান রাঃ এর সাথে দেখা করতে গেলাম।তাকে বললাম,আমাকে এমন একটা আমলের কথা বলে দিন যাতে আমি জান্নাত যেতে পারি। তিনি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। পুনরায় আমি একই আবেদন করলাম, তিনি এবারও নিরব থাকলেন। আমি তৃতীয়বার পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর জন্য অধিক অধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও।তাহলে এক এক সিজদার বদলে এক এক ধাপ মর্যাদা বাডিয়ে দিবেন এবং সমপরিমান গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
(মুসলিম,তিরমিযী,ইবনে মাযাহ,নাসায়ী)
আবু হুরায়রা রাঃবর্ণিত। তিনি বলেন,রাসুল সাঃ বলেছেন-
বান্দা যখন সিজদায় থাকে তখন সে তার প্রতিপালকের অধিক কাছাকাছি থাকে। সুতরাং ঐ সময় তোমরা বেশী বেশী প্রার্থনা করো।
(মুসলিম)
আবু বাকরা রাঃ বলেন,নবী কারীম সাঃ এর কাছে যখনই কোন খুশির খবর আসতো,আল্লাহ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তিনি সিজদা করতেন।
(আবু দাউদ)
কিয়ামতের দিন সিজদাকারীর চেহারায় নুর চমকাবে, তার সিজদার স্থানসমুহ জ্বলজ্বল করতে থাকবে,পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলো ঠিকরে বেরুবে। আল্লাহ পাক কুরআনে রাসুলের সাঃ সাথীদের প্রসংগে বলেন-
“রাসুলের সংগীগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের পরষ্পরের প্রতি সহনশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে।তাদের লক্ষন তাদের মুখমন্ডলে সিজদার চিহ্ন প্রস্ফুটিত থাকবে” (৪৮:২৯)
নুর উদ্ভাসিত হয় সেইসব ব্যক্তিত্বের চেহারায় যারা রাত গভীরে তাদের রবের সামনে মাথা জমীনে লুটায়। রাত যত গভীর হয় জগত সংসার নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। আল্লাহর সাথে তাঁর প্রিয় বান্দার অভিসার চলে। আল্লাহ বলেন-
“কেবল তাঁরাই আমার নিদর্শনাবলী বিশ্বাস করে যাদেরকে তার দ্বারা উপদেশ দেয়া হলে সিজদায় লুকিয়ে পড়ে। তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং অহংকারে মেতে উঠেনা। তাদের বিছানা থেকে তারা পৃথক হলে তাকে ডাকে (জান্নাতের) আশা ও (জাহান্নামের) আশংকায় এবং তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।কেউ জানেনা, তাদের কৃতকর্মের বদলায় কি নয়ন প্রীতিকর পুরষ্কার তাদের প্রতিপালক তাদের জন্য লুকিয়ে রেখেছেন।” (৩২:১৫-১৭)
“যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন অংশে সিজদায় অথবা দাঁড়ানো অবস্থায় অনুগত থাকে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের রাহমাত প্রত্যাশা করে সে কি তার সমান যে তা করেনা।যারা জানে আর যারা জানেনা তারা কি উভয়ে সমান?” (৩৯:৯)
“আমি ফেরেশতাদের বললাম-আদমে সিজদা করো” (২:৩৪)
সকল ফেরেশতা সিজদা করলো,ইবলিশ করেনি।ফলে সে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অভিশপ্ত হলো।সমস্ত ভালো কাজের দুয়ার তার জন্য বন্ধ হলো এবং দুনিয়ায় সংঘটিত সকল মন্দ কাজের দায়ভার নিয়ে সে জাহান্নামের উপযুক্ত বিবেচিত হলো।
মানুষের জন্য কেবলমাত্র আল্লাহকেই সিজদা করার নির্দেশ। গাছ,পাথর, সূর্য, দেবদেবী, প্রকৃতিক অতি প্রাকৃতিক কাউকেই সিজদা করা যাবেনা।
“তোমরা সূর্যকে সিজদা করোনা, চন্দ্রকেও না। সিজদা করো আল্লাহকে” (৪১:৩৭)
সিজদার বাধ্যবাধকতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রাসুল সাঃ বলেন-
“আল্লাহ ছাড়া যদি অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি আমি দিতাম, তাহলে দুনিয়ার স্ত্রীদের আদেশ করতাম তারা যেনো তাদের স্বামীদের সিজদা করে” (তিরমিযী)
সকল নামাজে সিজদা ফরয,সে নফল হোক বা শুকরিয়ার নামাজ হোক। এটাও ভাবনার যে ক্কিয়াম, রুকু, বৈঠক এক রাকা’তে একবারই হয়, কিন্ত সিজদা হয় দু’টা। সুবহান আল্লাহ। ভুলে একটা সিজদা দিলে নামাজই বাতিল হবে। প্রত্যেকটা সিজদা আবার আগে ও পরে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবির দিয়ে সুরক্ষিত। নামাজে কোন ভুল হলে সংশোধনের জন্য পুনরায় সহু সিজদাই প্রযোজ্য হবে।
শুধু সিজদা একটা পৃথক ইবাদত। নামাজ না পড়েও সিজদা করা যায়, সিজদাতে দোয়া করা যায়। কুরআনে হাকীমে এমন চৌদ্দটা স্থান আছে তেলাওয়াতকারী সে স্থান অতিক্রমকালে সিজদা দিতেই হবে। এগুলো ‘তিলাওয়াতে সিজদা’। এসব আয়াত যিনি তিলাওয়াত করবেন আর যিনি শুনবেন উভয়ের উপরই তিলাওয়াত সিজদা করা ওয়াজিব। নামাজের হালতে এরকম আয়াত আসলে বাকী কার্যক্রম স্থগিত রেখে সাথে সাথে তিলাওয়াতে সিজদা দিতে হবে।
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর তাবত কিছু স্বেচছায় বা অনিচ্ছায় কেবলমাত্র আল্লাহকেই সিজদা করছে। নিয়মিত এই সিজদা চলছে বিরতিহীনভাবে।
“আল্লাহর প্রতি সিজদাবনত হয় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর তাবত কিছু ইচছায় বা অনিচ্ছায় এবং তাদের ছায়াগুলিও সকাল ও সন্ধ্যায়” (১৩:১৫)
এটা বুঝা আবশ্যক যে এখানে শুধু জমীনে মাথা অবনত করার নামই সিজদা বুঝায়নি। গাছপালা-তরুলতা, চন্দ্র-সূর্য, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত মাথা নোয়াবার জন্য জমীনে নেমে আসেনা। বরং এখানে সিজদা মানে হলো আল্লাহর আদেশ নিষেধ ও নিয়ম কানুনের কাছে পূর্ণ সমর্পন। আল্লাহর আইনের কাছে অনুগত থেকে তারা প্রত্যেকেই যার যার পরিভ্রমণ, সন্তরন ও দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কেউ মানছে স্বেচ্ছায় বিশ্বাসী হয়ে আর বিশ্বাস না করেও কেউ মেনে চলছে প্রাকৃতিক নিয়ম মনে করে কারণ এই বিধানের বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা কারো নেই। নভোমন্ডলের নেই, নেই ভুমন্ডলেরও ।এমনকি গাছের ডালের এক টুকরো ছায়ারও স্বস্থানে অটল থাকা সম্ভব নয়-নিয়মের সামনে নত হয়ে তাকেও প্রকৃত বস্তুর সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে হয়।মানুষ ছাড়া বাকীসব জন্ত জানোয়ার,বস্ত নিশ্চয় ও পদার্থের ক্ষেত্রেরই আনুগত্যই সিজদা। মানুষ আল্লাহর আইন বিধান মানবে এবং একই সাথে সিজদার মাধ্যমে তার এই আনুগত্যের জানান দিবে।
একই বিষয়ে কুরআনের আরো বহুস্থানে আল্লাহ বলেছেন-
“তুমি কি দেখোনা-আল্লাহকে সিজদা করে যাকিছু আছে আকাশমনডলী ও পৃথিবীতে,সূর্য -চন্দ্র, নভোমন্ডলী, পর্বতরাজি, বৃক্ষলতা, জীবজন্তুও সিজদা করে মানুষের মধ্য অনেকে।” (২২:১৮)
“আল্লাহকেই সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশমন্ডলীতে, পৃথিবীতে যত জীবজন্ত আছে তারা এবং ফেরেশতাগণ-তারা কোন অহংকার করেনা বরং ভয় করে তাদের প্রতিপালককে এবং তদেরকে যা আদেশ করা হয় তা তারা পরিপালন করে।” (১৬:৪৮-৪৯)
সিজদা করে বিনীত ও নিরহংকার ভাবে,সিজদা হয় আল্লাহর ভয়ে এবং আদেশ পালনার্থে। প্রকৃতির সিজদা এমন হলে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ বান্দা হিসেবে কেমন অনুভুতির সাথে তার রবকে সিজদা করবে? কেনো মানুষ সিজদায় পড়ে ইমোশনাল হতে পারেনা, কেনো জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা বলতে পারেনা, কেনো চোখের পানি ছাড়তে পারেনা?
আহারে মানুষ! তুমিই মাথাটা মাটির জমীনে নোয়াতে পারোনা তোমার সেই মালিকের জন্য যিনি তোমাকে সৃস্টি করেছেন, সুসমভাবে ভারসাম্যপূর্ণ করেছেন, সুন্দর ও সুস্থ আকৃতিতে সাজিয়েছেন, দুনিয়ায় সন্মানজনক একটা অবস্থানও দিয়েছেন-
“হে মানুষ! কিসে তোমাকে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে বিভ্রান্ত করলো?
যিনি তোমাকে সৃস্টি করলেন, অতঃপর তোমাকে সুঠাম করলেন এবং সুসাঞ্জস্য করলেন। তিনি যে আকৃতিতে চেয়েছেন,তিনি তোমাকে গঠন করেছেন”(ইনফিতার: ৬-৮)
অথচ ঘাস লতাপাতাও তার কাছে আনত হয়, সিজদায় পড়ে থাকে।
দয়াময়ের নামে ‘সূরা রাহমানের’ প্রথম কয়টি আয়াত তেলাওয়াত করে দেখুন আপনার কেমন অনুভব হয়-
“আর রাহমান
তিনিই কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন
তিনিই সৃস্টি করেছেন মানুষ
তিনিই তাকে ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিখিয়েছেন
চন্দ্র ও সূর্য ঘুরে নিজ কক্ষপথে
তরুলতা ও গাছপালা তাঁরই সিজদায় রত”
ওহে আল্লাহর বান্দা !আজ তাঁর কোটি কোটি নিয়ামত ও অনুগ্রহ স্বাচ্ছন্দে, স্বাধীনভাবে বিনা অর্থে ভোগ করছো, তাঁর হুকুম প্রতিনিয়ত লংঘন স্বত্তেও তিনি তোমার পানাহার কেড়ে নেননি। জীবন ও সম্পদ দিয়ে সমাজে সুন্দর ও মর্যাদাপূর্ণ সম্মান দিয়ে রেখেছেন। তোমাকে যেটুকু সামান্য ক্ষমতা ও প্রভাব দিয়েছেন তার উত্তাপে তুমি গর্ব ও অহংকারে মেতে উঠো, মাঝে মধ্যে জোর দেখাও,জুলুমও করো।
এক সেকেন্ড একটু ভাবো।এই পৃথিবীতে আজ কারো পূর্বপুরুষই বেঁচে নেই। হামান,নমরুদ, ফেরাউন, শাদ্দাদরা অনেক বলশালী ও অহংকারী ছিলো। গোটা সাম্রাজ্য পাহারা লাগিয়েও মৃত্যুর ফেরেশতার আগমন রুখতে পারেনি। ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট অত্যাচারী হিসেবেই পৃথিবীবাসী তাদের চিনে আর তারই সাক্ষী হয়ে তাদের কংকাল যাদুঘরে রক্ষিত হয়েছে। তোমার আমার পরিণতি এর চেয়ে ব্যতিক্রম হবেনা-এটাই সত্য।
তোমার ভোগ করা লক্ষ কোটি নিয়ামতরাজির মূল্য তিনি শ্রম বা অর্থে চান না। আর সে মূল্য পরিশোধের সক্ষমতা পৃথিবীর কারো নেই। তিনি কেবল একটি সিজদা তোমার কাছে চান।আজ তোমার কত ব্যস্ততা।অফিসের বড় বস,ব্যবসাতে কনগ্লুমেরেট,রাজনীতিতে ভি আই পি। সিজদার সময় কোথায়? সারাদিনে চব্বিশ ঘন্টায় পাঁচ ওক্ত নামাজে বড়জোর আধঘন্টা, সতেরো রাকাত ফরয, চৌত্রিশটা সিজদা। মিটিং, কনফারেন্স, হাঁট-বাজার, ট্রাফিক জ্যাম,বিমান অপেক্ষা, ক্রিকেট ম্যাচ, টিভি সিরিয়াল, সোস্যাল প্রোগ্রাম কোনটিই বন্ধ নেই-শুধু মহান রবের সিজদার বেলায় বদ্ধমুষ্টি।
দুনিয়ায় উপরের দায়িত্বশীল কেউ একবার একটা আদেশ করলে খেয়ে না খেয়ে সেটা পালন করতে বাধ্য ছিলাম।কারণ তা লংঘনের পরিনতি জানতাম ভালো করে। সব মনিবের মনিব আল্লাহতা’লা কুরআনে প্রায় শতবার নামাজের কথা বলেছেন, সেটা কানেই তুললাম না, সেখানে ছিলাম প্রচন্ড রকমের অনিয়মিত অথবা নানা অযুহাতে সেটা স্থগিত রেখেছি।
দুনিয়ায় আল্লাহকে সিজদা না করলে আখিরাতের ট্রায়ালে আহকামুল ‘হাকেমীন যখন সিজদা করতে বলবেন তখন কোনভাবেই মাথা নত হবেনা।
“স্মরণ করো সেদিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচন করা হবে, যেদিন তাদের বলা হবে সিজদা করার জন্য। তারা তা করতে পারবেনা। তাদের দৃষ্টি অবনত হবে, হীনতা তাদের আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিলো তাদেরকে সিজদা করতে দাওয়াত দেয়া হয়েছিলো।” (৬৮:৪২-৪৩)
হে আল্লাহর প্রিয় বান্দা !এই দিনতো দিন নয়, সামনে আরো দিন আছে। অনুতাপ অনুশোচনা করো। বলো-ভুল হয়েছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। বুদ্ধিমানের মতো শুধরে নাও।আল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দাও, প্রতিজ্ঞা করো, জীবনে আর একটা দিনও সিজদাবিহীন যাবেনা।তোমাকে উদ্দেশ্য করেই আল্লাহ বলছেন-
“আল্লাহকে সিজদা দাও এবং তাঁর ইবাদাত করো” (৫৩:৬২)
“তোমরা সিজদা দাও আর আমার কাছাকাছি চলে এসো” (৯৬:১৯)
“সুতরাং তুমি তোমার পরতিপালকের প্রসংশা ও মহিমা ঘোষনা করো এবং সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও। তোমার মৃত্যু উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদাত করো” (১৫:৯৮-৯৯)
প্রখ্যাত সাহাবী ও হাদীস বর্ণনাকারী আবু হুরায়রা রাঃ বলেন,রাসুল সাঃ বলেছেন-
আদম সন্তান যখন সিজদার আয়াত তিলাওয়াত করে,অতঃপর সে সিজদা করে শয়তান তখন দূরে সরে গিয়ে কাঁদতে থাকে আর বলে-হায় আমাকে সিজদা করতে বলা হয়েছিলো, আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। ফলে আমার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হলো আর আদম সন্তান সিজদা করলো তার জন্য জান্নাত নির্ধারিত হলো।
(মুসলিম,মিশকাত)
মাদআন বিন আবি তালহা রাঃ বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একবার রাসুল সাঃ এর আজাদ করা গোলাম সাওবান রাঃ এর সাথে দেখা করতে গেলাম।তাকে বললাম,আমাকে এমন একটা আমলের কথা বলে দিন যাতে আমি জান্নাত যেতে পারি। তিনি উত্তর না দিয়ে চুপ থাকলেন। পুনরায় আমি একই আবেদন করলাম, তিনি এবারও নিরব থাকলেন। আমি তৃতীয়বার পুনরাবৃত্তি করলে তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর জন্য অধিক অধিক সিজদা করাকে অভ্যাস বানিয়ে নাও।তাহলে এক এক সিজদার বদলে এক এক ধাপ মর্যাদা বাডিয়ে দিবেন এবং সমপরিমান গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।
(মুসলিম,তিরমিযী,ইবনে মাযাহ,নাসায়ী)
আবু হুরায়রা রাঃবর্ণিত। তিনি বলেন,রাসুল সাঃ বলেছেন-
বান্দা যখন সিজদায় থাকে তখন সে তার প্রতিপালকের অধিক কাছাকাছি থাকে। সুতরাং ঐ সময় তোমরা বেশী বেশী প্রার্থনা করো।
(মুসলিম)
আবু বাকরা রাঃ বলেন,নবী কারীম সাঃ এর কাছে যখনই কোন খুশির খবর আসতো,আল্লাহ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ তিনি সিজদা করতেন।
(আবু দাউদ)
কিয়ামতের দিন সিজদাকারীর চেহারায় নুর চমকাবে, তার সিজদার স্থানসমুহ জ্বলজ্বল করতে থাকবে,পূর্ণিমার চাঁদের মতো আলো ঠিকরে বেরুবে। আল্লাহ পাক কুরআনে রাসুলের সাঃ সাথীদের প্রসংগে বলেন-
“রাসুলের সংগীগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর ও নিজেদের পরষ্পরের প্রতি সহনশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে।তাদের লক্ষন তাদের মুখমন্ডলে সিজদার চিহ্ন প্রস্ফুটিত থাকবে” (৪৮:২৯)
নুর উদ্ভাসিত হয় সেইসব ব্যক্তিত্বের চেহারায় যারা রাত গভীরে তাদের রবের সামনে মাথা জমীনে লুটায়। রাত যত গভীর হয় জগত সংসার নীরব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। আল্লাহর সাথে তাঁর প্রিয় বান্দার অভিসার চলে। আল্লাহ বলেন-
“কেবল তাঁরাই আমার নিদর্শনাবলী বিশ্বাস করে যাদেরকে তার দ্বারা উপদেশ দেয়া হলে সিজদায় লুকিয়ে পড়ে। তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং অহংকারে মেতে উঠেনা। তাদের বিছানা থেকে তারা পৃথক হলে তাকে ডাকে (জান্নাতের) আশা ও (জাহান্নামের) আশংকায় এবং তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।কেউ জানেনা, তাদের কৃতকর্মের বদলায় কি নয়ন প্রীতিকর পুরষ্কার তাদের প্রতিপালক তাদের জন্য লুকিয়ে রেখেছেন।” (৩২:১৫-১৭)
“যে ব্যক্তি রাতের বিভিন্ন অংশে সিজদায় অথবা দাঁড়ানো অবস্থায় অনুগত থাকে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের রাহমাত প্রত্যাশা করে সে কি তার সমান যে তা করেনা।যারা জানে আর যারা জানেনা তারা কি উভয়ে সমান?” (৩৯:৯)
ফেরেশতা কর্তৃক আদম আঃকে সিজদা করার তাতপর্য এটা নয় যে এক আদম সন্তান অপেক্ষাকৃত শ্রেয় অপর আদম সন্তানকে অনুরুপ সিজদা করবে। এই মহড়ায় আল্লাহ এমন শিক্ষা দেননি। পূর্বেই বলেছি মানুষের জন্য একমাত্র এবং কেবলমাত্র আল্লাহকেই সিজদা করতে হবে। মানুষ কখনোই মানুষকে, সে ভক্তি সহকারে, সন্মানের আতিশয্যে বা জগত শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ভেবে অথবা অতি প্রাকৃতিক কিছু মোযেজা দেখাতে পারে সে কারনে কিংবা হাশর মাঠে ত্রানের গুরু, পীর-মুর্শিদ মনে করে সিজদা করতে পারেনা। এটা সুস্পস্টভাবে শিরক ও আল্লাহর সাথে বিদ্রোহের শামিল।
আমাদের দেশে কতিপয় নামধারী সূফী ও স্বঘোষিত বুজুর্গ এই যুক্তি দেখান যে,
যেহেতু জ্ঞানের দিক থেকে আদম আঃ ফেরেশতাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদায় ছিলেন, আল্লাহ সে কারনে তাঁকে সিজদার হুকুমত করেছেন তাই এটা প্রতিষ্ঠিত যে মানুষের মধ্যেও যারা বাতেনি জ্ঞানে অগ্রসর তাদের সিজদা করা যাবে।এই অর্থে তারা “সন্মানের সিজদা” বা “শানের সিজদা” নামে পীর বুজুর্গকে সিজদা করা বৈধ বলেন। এটা চরম গোমরাহী ও ধৃষ্টতাসুলভ কাজ।আল্লাহর সিজদা বান্দাকে উপহার দিয়ে এই কোন ‘তাজিম’? আমাদের বোধগম্য নয়।
যেহেতু জ্ঞানের দিক থেকে আদম আঃ ফেরেশতাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদায় ছিলেন, আল্লাহ সে কারনে তাঁকে সিজদার হুকুমত করেছেন তাই এটা প্রতিষ্ঠিত যে মানুষের মধ্যেও যারা বাতেনি জ্ঞানে অগ্রসর তাদের সিজদা করা যাবে।এই অর্থে তারা “সন্মানের সিজদা” বা “শানের সিজদা” নামে পীর বুজুর্গকে সিজদা করা বৈধ বলেন। এটা চরম গোমরাহী ও ধৃষ্টতাসুলভ কাজ।আল্লাহর সিজদা বান্দাকে উপহার দিয়ে এই কোন ‘তাজিম’? আমাদের বোধগম্য নয়।
যুক্তি ও আবেগ নির্ভরতা বহু সময় বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানে ও বিশ্বাসকে টলিয়ে দেয়।এটাও এমন।আদম আঃ এর ঘটনায় শয়তানের যুক্তিও শানিত ছিলো কিন্ত তা কি সফল হয়েছিলো? মনে রাখতে হবে, ইসলাম সর্বদা কুরআন ও হাদিস নির্ভর,যুক্তি ও পান্ডিত্ব নির্ভর নয়।যুক্তি অনেকাংশেই বিপথগামী করে।যদি তাই সত্যহতো তাহলে আদম আঃ কে কেন মা হাওয়া আঃ সিজদা করলেন না?কেনইবা পুত্র হাবিল ও কাবিল প্রথম নবী ও তাদের বাবা কে সিজদা করলেন না ? কোন বুজুর্গের কবর অবশ্যই কোন সিজদার স্থান নয়, সিজদার স্থান আল্লাহর ঘর মসজিদ। যেখানে মুসলমানেরা ব্যক্তিগত ও দলগতভাব পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে।
“নিশ্চয়ই মসজিদের স্থানসমুহের মালিক আল্লাহ । তোমরা তাঁর সাথে আর কারো বন্দেগী করোনা” (৭২:১৮)
হযরত যুনদুব রাঃ বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসুল সাঃ কে তাঁর ইন্তেকালের তিনদিন পূর্বে বলতে শুনেছি-সাবধান !
তোমরা আমার কবরকে সিজদার স্থান বানিওনা। আমি তোমাদেরকে কঠোরভাবে তা নিষেধ করছি। (মুসলিম)
রাসুল সাঃ কে তাঁর ইন্তেকালের তিনদিন পূর্বে বলতে শুনেছি-সাবধান !
তোমরা আমার কবরকে সিজদার স্থান বানিওনা। আমি তোমাদেরকে কঠোরভাবে তা নিষেধ করছি। (মুসলিম)
হাশরের ময়দানে উম্মতের জন্য সিজদায় পড়ে কাঁদবেন নবীজি।সেই কঠিন মুহূর্তে, যখন সব নবী পর্যন্ত ‘ইয়া রব্বি নাফসি’ বলতে থাকবেন, তখন উম্মতের চিন্তায় শুধু রাসুল (সা.) বলবেন ‘ইয়া রব্বি উম্মাতি, উম্মাতি!’
আনাস (রা.) বর্ণিত।তিনি বলেন,আমাদের কাছে মুহাম্মদ (সা.) বর্ণনা করেছেন যে, কেয়ামতের দিন মানুষ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তাই তারা আদাম (আ.) এর কাছে এসে বলবে, আমাদের জন্য আপনার রবের কাছে সুপারিশ করুন। তিনি বলবেন: এ কাজের জন্য আমি নই। বরং তোমরা ইবরাহিম (আ.) এর কাছে যাও। কারণ, তিনি হলেন আল্লাহর খলিল। তখন তারা ইবরাহিম (আ.) এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন: আমি এ কাজের জন্য নই। তবে তোমরা মুসা (আ.) এর কাছে যাও, কারণ তিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। তখন তারা মুসা (আ.) এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন: আমি তো এ কাজের জন্য নই। তোমরা ঈসা (আ.) এর কাছে যাও। কারণ তিনিই আল্লাহর রুহ ও বাণী। তারা তখন ঈসা (আ.) এর কাছে যাবে। তিনি বলবেন: আমি তো এ কাজের জন্য নই। তোমরা বরং মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে যাও। এরপর তারা আমার কাছে আসবে। আমি বলব, আমিই এ কাজের জন্য। আমি তখন আমার রবের কাছে অনুমতি চাইবো। আমাকে অনুমতি দেওয়া হবে। আমাকে প্রশংসাসূচক বাক্য ইলহাম করা হবে, যা দিয়ে আমি আল্লাহর প্রশংসা করবো, যেগুলো এখন আমার জানা নেই। আমি সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে প্রশংসা করবো এবং সিজদায় পড়ে যাবো। তখন আমাকে বলা হবে, ইয়া মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। তুমি বলো, তোমার কথা শোনা হবে। তুমি চাও, তোমাকে দেওয়া হবে। সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। তখন আমি বলবো, হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত! আমার উম্মত! বলা হবে, যাও, যাদের অন্তরে যবের দানা পরিমাণ ঈমান আছে, তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে দাও। আমি গিয়ে এমনই করবো। তারপর আমি ফিরে আসবো এবং ফের সেসব প্রশংসা বাক্য দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা করবো এবং সিজদায় পড়ে যাবো। তখন বলা হবে, হে মুহাম্মদ! মাথা উঠাও। তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেওয়া হবে। সুপারিশ কর, গ্রহণ করা হবে। তখনও আমি বলবো, হে আমার রব! আমার উম্মত! আমার উম্মত! তখন বলা হবে, যাও, যাদের এক অণু কিংবা সরিষা পরিমাণ ঈমান আছে তাদের জাহান্নাম থেকে বের করে আনো ।আমি গিয়ে তাই করবো। আমি আবার ফিরে আসবো এবং সেসব প্রশংসা বাক্য দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করবো। আর সিজদায় পড়ে যাবো। আমাকে বলা হবে, হে মুহাম্মদ! মাথা উঠাও। বলো, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, তোমাকে দেওয়া হবে। সুপারিশ করো, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। আমি তখন বলবো, হে আমার রব, আমার উম্মত! আমার উম্মত! এরপর আল্লাহ বলবেন, যাও, যাদের অন্তরে সরিষার দানার চেয়েও অতি ক্ষুদ্র পরিমাণও ঈমান আছে, তাদেরও জাহান্নাম থেকে বের করে আনো। আমি যাবো এবং তাই করবো...
(সহীহ বুখারি)
(সহীহ বুখারি)
ওগো নবীর উম্মত! এমন ভালোবাসা ও কান্নার ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কি কোনদিন? যদি না আমরা আল্লাহর হুকুম মতো প্রতিদিনের বাধ্যতামূলেক সিজদাগুলো না দিই।আল্লাহর হুকুম লংঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হলে তো নবীর সুপারিশ আমাদের ভাগ্যে হবেনা।
জমিনের জীবিত লোকগুলো ‘হাইয়্যা আলাস সালাহ’ নামাজের দিকে আসো, ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ কল্যাণের পথে আসো- মসজিদের মিনার থেকে এই আহ্বান শুনেও এড়িয়ে যায় আর কবরবাসীরা আল্লাহর কাছে মিনতি করছে- আমাদের আর একটা সুযোগ দাও, জমীনে তোমাকে সিজদা দিয়ে ফিরে আসি। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দিক।
কবি নজরুলের ভাষায় -
ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের আজ শুনি আজান।
জামাত শামিল হওরে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান।।
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের আজ শুনি আজান।
জামাত শামিল হওরে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান।।
No comments:
Post a Comment