Wednesday, December 25, 2019

নৈতিকতার অবক্ষয় ও জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার অভিজ্ঞতা

অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের মধ্যে যে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যেত, তা হলো- মূল্যবোধ ও ন্যায্যতায় আপসহীনতা।
মূল্যবোধের অনুপস্থিতিই অবক্ষয়ের সূচনা করে। অবক্ষয় বলতে আমরা সাধারণতঃ সামাজিক কিছু স্খলন বা চ্যুতি-বিচ্যুতিকেই বুঝি।
মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা হচ্ছে নৈতিকতা গঠনের জন্যে সর্বাধিক কার্যকর উপায়। তাই ইসলাম শিক্ষার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। একটি পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাকে অবশ্য করণীয় কর্তব্য বলে আখ্যায়িত করেছে। তাই একটি জাতিকে যথার্থরূপে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে পারলে তাদের নৈতিকমান উন্নত করা সম্ভব। তবে প্রসঙ্গত একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, শুধু প্রযুক্তিগত শিক্ষার দ্বারা নৈতিকতার উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব কিন্তু সত্যিকার সত মানুষ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বরং এর জন্যে নৈতিকশিক্ষা ও মানবিক শিক্ষা প্রয়োজন। আর সত্যিকার নৈতিক ও মানবিক শিক্ষার যোগান ইসলামের আদর্শিক শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষকে ইসলামী মনোভাব সম্পন্ন রূপে গড়ে তুলতে পারলেই যথার্থ নৈতিক মান উন্নয়ন সম্ভব। তাই বলা যায় যে ধর্ম বাদ দিয়ে শুধু পেশাগত শিক্ষার মাধ্যমে আজকের দুনিয়ার নৈতিক সংকট দূর করা সম্ভব নয়।
নৈতিকতার অবক্ষয় ঠেকাতে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
জাপানিরা পৃথিবীতে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুশৃঙ্খল অমায়িক চরিত্রের অধিকারী একটি জাতি হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু যে জাতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত অন্যতম খারাপ একটি জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল তারা আজ এত ভদ্র, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন এবং সুশৃঙ্খল জাতি কেন? এ পরিবর্তন জাপানিরা হাজার বছর ধরে লালন করে আসেনি; মূলত এ পরিবর্তন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হঠাত করেই শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নির্মমতা আর মানবতা জাপানিদের চেয়ে আর বেশি কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। কেননা মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম ও দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমার আঘাত যে শুধু তাদেরই সইতে হয়েছে! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে ১৯৪৫ সালে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ও দ্বিতীয় পারমাণবিক হামলার শিকার হয় জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘যুদ্ধ নয় শান্তি’ এ আদর্শ সামনে রেখে তারা দেশ গড়ায় মনোযোগ দেয়।
প্রশ্ন জাগতে পারে যে জাপানিরা কেন এত ভদ্র, শান্তিপ্রিয়, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুশৃঙ্খল জাতি। এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হল- জাপানের আছে অবিশ্বাস্য একটি সুন্দর শিক্ষাব্যবস্থা যা তাদের ভদ্র, শান্তিপ্রিয়, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সুশৃঙ্খল একটি জাতিতে পরিণত করেছে।
জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে নৈতিক শিক্ষা। তাদের বিশ্বাস, আগে নীতি-নৈতিকতা, পরে পাঠ্য শিক্ষা। জাপানে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাত চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত কোনো ধরনের পুঁথিগত বিষয়ে পরীক্ষা না নিয়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক বিকাশের দিকেই বিশেষভাবে নজরদারি করা হয়।
স্কুল জীবনের প্রথম তিন বছর মেধা যাচাইয়ের জন্য নয় বরং ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো হয়। জাপানিরা নম্রতা, ভদ্রতা বা নীতি-নৈতিকতায় পৃথিবী খ্যাত। শুধু বয়সে বড় হওয়া নয়, বরং মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য তাদের চরিত্রে যেন প্রতিফলিত হয় এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; এ সময় শুধু এ প্রয়াসই চালানো হয়।
স্কুলকে জীবনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার স্থান হিসেবে না দেখিয়ে জীবনকে সুন্দর করার একটি মিলনস্থান হিসেবে প্রদর্শন করার চেষ্টা করছে জাপান সরকার। ধারণাটি নিতান্তই সহজ-সরল হলেও এ বিষয়টির কারণেই জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা সব থেকে আলাদা এবং ভালোও বটে।
জাপানে শিশুদের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি আদব-কায়দা শেখানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে। গুরুজনদের সম্মান করা, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেয়া, সবাই মিলে কাজ করা ইত্যাদি শিক্ষা একদম ছেলেবেলায় জাপানিদের মনে গেঁথে দেয়া হয়।
স্কুলে ভর্তির পর থেকে প্রথম চার বছর পর্যন্ত শিশুদের তাদের দোষ-গুণের মানদণ্ডে বিচার করা হয় না। তাদের মধ্যে কে ভালো বা কে খারাপ সে বিচার না করে বরং কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল সে শিক্ষা দেয়া হয়।
এর পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত বা কার সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় ইত্যাদি নীতিগত শিক্ষা প্রদানের ওপর জোর দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, পাশাপাশি প্রকৃতির মধ্যে পশুপাখির সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়- সেই শিক্ষাও ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকেই পায়। তাছাড়া শিশুরা যাতে খুব অল্প বয়স থেকে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে, তার জন্য জামাকাপড় পরা, নিজে হাতে খাবার খাওয়া, নিজের জিনিস নিজেই গুছিয়ে রাখার মতো ছোট ছোট কাজ হাতে ধরে শিখিয়ে দেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
ধর্মবোধের প্রকৃত ভিত্তিই হ’ল নৈতিকতা। এ জন্য ইসলামে নৈতিকতার গুরুত্ব ও
প্রাধান্য সবচেয়ে বেশী। নৈতিকতা কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন আচরণ, যা অপরের প্রতি ক্ষমা ও মার্জনা, উদারতা ও দানশীলতা, ধৈর্য, বিনয় ও নম্রতা ইত্যাদি গুণে
গুণান্বিত হওয়াকে বুঝায়। এক কথায় পূণ্যাবলী সঠিক বিকাশ ও উতকর্ষতা সাধনই নৈতিকতা।
নৈতিকতা বর্জিত সমাজে দেখা দেয় ব্যক্তিগত, দলগত বা জাতীয় জীবনে সংঘাত, হিংসা- বিদ্বেষ, হানা-হানি, গীবত ও পরশ্রীকাতরতা। সৃষ্টি হয় একে অপরকে
পর্যুদস্ত করার বাসনা। ফলে সৃষ্টি হয় নৈতিকতার অবক্ষয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় তোমাদের যে ব্যক্তি বেশি তাকওয়াবান সে আল্লাহর নিকট বেশি সম্মানিত।” [সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
“দেহ তোমায় মহান করে না, করে যা আত্মায়,
হৃদয় রাঙানো পোশাকে তোমার সৌন্দর্য নয়,
নয় তাতে মনুষ্য পরিচয়।
চক্ষু, কণ্ঠ, জিহ্বা আর নাসিকা যদি হয় মনুষ্য পরিচয়,
কি তফাত বল দেয়ালের ঐ ছবি আর মানবসত্তায়?”
-শেখ সা’দী
রেফা: আখতার হামিদ খান et al

No comments:

Post a Comment