সন্তানের স্বাস্থ্য ও লেখাপড়া
তেরো বছরের চারু এখন মায়ের মুখে মুখে বেশ তর্ক করে। তাকে পড়তে বসলে বলে, ‘‘এখন পড়ব না। ভাল লাগছে না।’’ কোনও কাজ করতে বারণ করলে আরও চেঁচামেচি করে, ‘‘কেন করব না?’’
একে তো কথা শুনছে না মেয়ে,
তারপর মায়ের সঙ্গে মুখে-মুখে তর্ক করছে। চারুকে সামলাতে নাজেহাল তার মা-বাবা। এক দিকে তাঁরা বিরক্ত হচ্ছেন আবার বুঝতে
পারছেন,
মেয়ের আলাদা মত তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কী করলে বা বললে যে মেয়ে
সংযত হবে,
তা তারা বুঝতে পারছেন না।
এই সমস্যাটি নতুন নয়। ন’-দশ বছর বয়স অর্থাৎ প্রি-টিনএজ থেকে এ ধরনের সমস্যা
শুরু হয়। ছেলেমেয়েদের একটা মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হতে
শুরু করে এ সময়ে। তাই মা-বাবাকে অনেক ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে হবে।
রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করলে আর যাই হোক, সমাধান হবে না।
একে একে বুঝতে হবে সমস্যার জায়গা। তবেই সমাধান হবে সহজ।
প্যারেন্টিং
কনসালট্যান্টরা বলেন, ‘‘এই সময়ে শিশুদের ব্রেন রিমডেলিং(Remodeling- change the
structure or form ) হয়। ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স(Prefrontal
Cortex (PFC) is the cerebral cortex covering
the front part of the frontal lobe)
আমাদের বোধবুদ্ধি, চিন্তাভাবনা
নিয়ন্ত্রণ করে অর্থাৎ লজিকাল থিঙ্কিংয়ে সাহায্য করে। এই অংশের ডেভেলপমেন্ট একটু
দেরিতে হয়। আর আছে অ্যামিগডালা (Amygdala is a collection of cells near the base of the
brain. মানবমস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ন এক অংশ হল অ্যামিগডালা। বাদামের মতো আকৃতির এই
জিনিসটিই আমাদের ভয় এবং প্যানিকের জন্য দায়ী। যাঁদের অ্যামিগডালা ক্ষতিগ্রস্ত তাঁরা হন অকুতোভয়
স্বভাবের। যত রকমের অনুভূতি রয়েছে আমাদের, তার সব কিছুরই ‘স্টোরেজ’ (জমা থাকে) হয় অ্যামিগডালায়)। এই অংশ আগে ডেভেলপ করে যায়, ফলে এর প্রভাবেই শিশুরা একটা কথার হুট করে জবাব দিয়ে
দেয়। অনেক বেশি আবেগে চলে। লজিকাল থিঙ্কিং(Logical thinkers observe and analyze
phenomena, reactions, and feedback and then draw conclusions based on that
input) সেখানে কম। তখন
তাদের ব্যবহারে কোনও বাঁধন থাকে না। ফলে সীমাহীন হয়ে যায় বহিঃপ্রকাশ। চট করে রেগে
যায়, চিৎকার করে ওঠে, কিছু ক্ষেত্রে জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলেও দিতে পারে।
ক্রমশ তেরো, চোদ্দো বছর হলে তা
ধীরে ধীরে কমতে থাকে।’’ কিন্তু এই বয়সে যদি তাকে ঠিক মতো সামলানো না যায়, তা হলে পরবর্তী ক্ষেত্রে মা-বাবার থেকে দূরত্ব অবধি
তৈরি হতে পারে।
সামলাবেন কী ভাবে?
১. মনে রাখতে হবে, এই বয়সের
সন্তানের বুদ্ধি পরিণত নয়। কিন্তু মা-বাবা পরিণত। সুতরাং ছেলেমেয়ে চেঁচামেচি করলেও
ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামলানোর জন্য তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সন্তান যতই
চেঁচামেচি করুক,
মা-বাবাকে শান্ত থাকতে হবে। সন্তান চেঁচিয়ে কথা বললেও আপনি
শান্ত গলায় উত্তর দিন। ওরা কিন্তু দেখে শেখে। আগে ওকে চিৎকার করা বন্ধ করতে বলুন।
তার পর ধীরে,
ঠান্ডা গলায় তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে, সে কী চায়। সে যদি পড়তে না চায়, তাকে কিছুটা সময়
ছাড় দিন। দেখুন সে নিজে থেকে পড়া শুরু করে কি না। যদি না করে তখন তাকে ডেকে
জানতে চান,
সে কেন পড়তে চায় না।
ছেলে বা মেয়ে কোনও বিষয়ে উত্তর দিলে বা উল্টে প্রশ্ন করলে, গোড়াতেই তাকে থামিয়ে দেবেন না। অনেক মা-বাবাই মনে করেন, তাঁদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সন্তান কোনও মতামত দিলে তাকে চুপ করিয়ে দেন। এই
মনোভাব বদলানো জরুরি। সন্তান কেন প্রশ্ন করছে, তর্ক কেন করছে
সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। হতে পারে সে যুক্তিযুক্ত কথা বলছে না। কিন্তু সেটা শুনুন।
তাকেই জিজ্ঞেস করুন সে কেন এমনটা বলছে? ওকে যুক্তি দিয়ে
ওর কথা বা মত বোঝাতে বলুন। তার পর আপনার যুক্তি দিয়ে যদি তার যুক্তি খণ্ডন করতে পারেন, তা হলেই সমস্যা মিটে যাবে। এতে তার যুক্তিবোধও তৈরি হবে। সে বুঝবে নিজের কোনও
মতামত মা-বাবাকে বোঝাতে গেলে তা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত হতে হবে।
২. অনেক মা-বাবা সন্তানের গায়ে হাত তোলেন। কেউ তিন বছর বয়স
থেকে, কেউ পাঁচ বছর বয়স থেকে। কিন্তু ন’-দশ বছর বয়সেও সেই অভ্যেস জারি থাকলে, তা সন্তানের আত্মসম্মানে আঘাত করতে পারে। সে কিন্তু তখন আরওই কথা শুনবে না।
বরং তার মনে হবে যে,
বড়জোর সে মার খাবে। সে আরও জেদি হয়ে যাবে তার জায়গায়।
মা-বাবার কোনও বোঝানোই তখন কাজ করবে না। তাই গায়ে হাত তোলাটা সমাধান নয়।
৩. মনে রাখবেন, এ বয়সে ও যে তর্ক
বা ব্যবহার করছে,
তা আবেগের বশবর্তী হয়ে করছে। তাই সেটাকেই অস্ত্র করতে হবে।
সন্তান খুব খারাপ ভাবে কথা বললে উত্তর দেবেন না। বরং চুপ করে সেখান থেকে চলে যান।
তার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখুন। ওকে বোঝান যে, ওর ব্যবহারে আপনি
দুঃখ পেয়েছেন। এই বয়সের শিশুদের অবলম্বন কিন্তু মা-বাবাই। তাই ওরা মা-বাবার সঙ্গে
খারাপ ব্যবহার করে ফেললেও সেখানেই আশ্রয় খোঁজে। দেখবেন, সে নিজেই হয়তো আপনার পাশে এসে বসবে, কথা বলতে চাইবে।
তখন ওকে বলুন,
আপনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন ওর ব্যবহারে। দেখবেন, ও বুঝবে। ওর মনে থাকবে যে, মা কথা বন্ধ করে দিতে
পারে। ওষুধের মতো কাজ করবে এই নীরবতা।
৪. অনেক সময়ে হাজার বুঝিয়েও কাজ হয় না। তখন জোর করলে চলবে না।
বরং ওর কথা মেনে নিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হবে। পায়েল ঘোষের কথায়, ‘‘হয়তো কোনও পরীক্ষার আগে সন্তান পড়তেই চাইল না, ছেড়ে দিন। সেই পরীক্ষায় খারাপ রেজ়াল্ট করলে সে নিজেই বুঝে যাবে। তখন আপনি
বলুন সে কোন জায়গায় ভুলটা করেছে। ওর ভুল থেকেই ওকে শিখতে দিন।’’
টিনএজ বা বয়ঃসন্ধির মতোই প্রি-টিনএজও খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে মন ও শরীর প্রস্তুত হয় পরিবর্তনের জন্য। এখন বহির্জগতের প্রভাবও অনেকটাই ওদের জীবনে। সুতরাং নিজস্ব মতামত যে ছোট থেকে তৈরি হবে, তা আশ্চর্যের নয়। কিন্তু সেই মত যেন ঠিক হয়, তা দেখা মা-বাবার দায়িত্ব।
-সূত্রঃ আনন্দবাজার
No comments:
Post a Comment