Sunday, January 31, 2021

আল্লাহকে পাওয়া মানব সেবার মাধ্যমে

 “হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান

তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।
মানুষ বলিবে – তুমি প্রভু করতার,
আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?
বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,
তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।
খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?
বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।
পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান,
পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাও নি পানি পান।
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী,
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?
বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে,
তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমায় পাশে।”
আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তাঁর কাছে প্রতিদান প্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম নামাজ, রোজা, জিকির ও দোয়া নয়। ইবাদতের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমেও একজন মুসলমান নেকির পাল্লা ভারী করতে পারে। এসব কাজ শ্রমসাধ্য না হলেও আল্লাহর দরবারে মূল্যবান। পরকালে আল্লাহর দাঁড়িপাল্লায় ভারী আমল হিসেবে বিবেচিত হবে। এ জন্য মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের রোজা, নামাজ ও সদকার চেয়ে মর্যাদাবান আমলের সংবাদ দেব? সাহাবায়ে কেরাম বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে সমঝোতা করে দেওয়া। কেননা মানুষের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা ধ্বংসাত্মক।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৭৫০৮)
রোগীর খোঁজখবর নেওয়ার পুরস্কার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসে এভাবে বিবৃত হয়েছে—‘যখন কোনো ব্যক্তি কোনো রোগীকে দেখতে যায়, আসমানে একজন প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করতে থাকে, তুমি সুখী হও, তোমার পথচলা বরকতময় হোক, জান্নাতে তুমি স্থান লাভ করো।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৪১২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের একটি চমত্কার দৃশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, যেখানে মহান স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের সঙ্গে কথা বলছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমার সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে প্রভু, আমি আপনার সেবা কিভাবে করব? আপনি তো জগত্সমূহের প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন, তুমি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তার সেবা কেন করোনি? তুমি কী জানতে না, তার সেবা করলে তুমি তার কাছে আমাকে পেতে? হে আদম সন্তান, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে আহার করাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু, আপনি জগত্সমূহের প্রতিপালক। আপনাকে আমি কিভাবে খাবার খাওয়াব? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তুমি তাকে দাওনি। তুমি কী জানতে না, যদি তুমি তাকে খাওয়াতে তবে তা আমার কাছে এসে পেতে? হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পান করাওনি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু, আপনি জগত্সমূহের প্রতিপালক। আমি কিভাবে আপনাকে পান করাব? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল, তুমি তাকে পান করাওনি। যদি তুমি তাকে পান করাতে, তবে তুমি তা আমার কাছে এসে পেতে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৪২৬০)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে চলার সময় একটি কাঁটাযুক্ত ডাল পড়ে থাকতে দেখল এবং তা রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। আল্লাহ তার কাজে সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৯)
ইসলামে সমাজসেবার ধারণা এত বিস্তৃত যে যেকোনো শ্রেণির মানুষের পক্ষে তা করা সম্ভব। ইসলাম সমাজসেবাকে কোনো স্থান বা সময়ের সঙ্গে আবদ্ধ করেনি, তাকে আর্থিক সেবায় সীমাবদ্ধ করেনি, শারীরিক শ্রমে সীমিত করেনি, বুদ্ধিবৃত্তিক পরিষেবায় সংকুচিত করেনি; বরং ইসলামে সমাজসেবার ধারণা একটি বিস্তৃত প্রাঙ্গণের মতো, যেখানে সব মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী অবদান রাখতে পারবে। ধনী-গরিব, শক্তিশালী-দুর্বল, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবার অংশ রয়েছে তাতে।
ইসলাম সমাজসেবা, মানবকল্যাণকে মানবিকতা ও মহানুভবতার ওপর ছেড়ে দেয়নি। ইসলামের দৃষ্টিতে তা মানুষের মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। আবু হুরায়রা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘প্রতিদিন মানুষের শরীরের প্রতিটি জোড়ার বিপরীতে সদকা করা আবশ্যক। দুই ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়বিচার করা একটি সদকা, নিজের বাহনে কাউকে বহন করা বা তার পণ্য বহন করা একটি সদকা, ভালো কথা একটি সদকা, নামাজের উদ্দেশ্যে চলা প্রতিটি পদক্ষেপ একটি সদকা, রাস্তা থেকে কষ্টকর জিনিস সরিয়ে দেওয়া একটি সদকা।’ (সুনানে বায়হাকি, হাদিস : ৩০৫৭)
একইভাবে হাদিসে এসেছে, মানুষের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলা, বধির ব্যক্তিকে কিছু বুঝিয়ে দেওয়া, অন্ধকে পথ দেখানো, মানুষকে পথ দেখানো, সুপরামর্শ দেওয়া, দুর্বল ব্যক্তির বোঝা বহন করে দেওয়া ইত্যাদি কাজ আল্লাহর কাছে মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত এবং উত্তম দান। এভাবে ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার এবং সামাজিক পতন রোধ করার দীক্ষা দিয়েছে। ইসলামী সমাজে মৌলিক অধিকারে সবাই সমান।
-ড. ইউসুফ আল কারজাভি
-কবি আবদুল কাদিরের “মানুষের সেবা” কবিতা

No comments:

Post a Comment