বিয়ে ও
আত্মনিবিষ্টতায় স্মরণব্যথা
১৯৬৪র হেমন্তে
ছোট মামার বিয়ে হয়। আকন্দ বাড়ীতে(নানা বাড়ী) মানুষ গমগম করছে। অল্প সময়ের ভেতর নোতুন
মামীকে আনতে যাবে বারাতীর গাড়ী। আমি আমার সমবয়সী সোনা মামা খুবই খুশী। ছোট মামা সেজেগুজে
বের হলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে নোতুন মামী বা কনের পিত্রালয়ে যাবার জন্য। সবার কাছে ছোট
মামা গিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। মামা তার বড় বুবু বা আমার মায়ের কাছে গেলেন। মা অনেক আদরের
ছোট ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! যেনো কেউ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি কিশোর বয়সে
সেই কান্নার কথার মানে জি্জ্ঞেস করি মা’কে আরো পরে, অনুষ্ঠানের শেষে। মা বল্লেন, “ছোট্ট
ভাইটিকে আমরা আজ থেকে হাত-পা বেঁধে দিলাম। ও আসতো যেতো আমার কাছে, তোর খালার কাছে,
মামাদের কাছে -আজ থেকে ওকে আর তেমন করে পাবোনা আমরা। ওর আকাশটা আরো ছোট হয়ে গেল রে।”
এই বলে মা আবারো কাঁদলেন। এখনো আমার স্মৃতিটা জ্বলজ্বলে।
১৯৭৯তে
আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হলো। আমি বন্ধূ বান্ধবসহ ভাবী “জরু” বা বধূর পিত্রালয়ে
চলে আসি হেমন্তের বিকেলে। সন্ধ্যের পর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার সময় আমার আব্বাকে মুনাজাত
পরিচালনার জন্য বলা হলো। আব্বা সবার অনুরোধ রেখে মুনাজাত শুরু করলেন। সে সময় সদা সচেতন
আমি মুনাজাতের সঞ্চারীতে শুনলাম আব্বার ধরে আসা গলায়, “হে প্রভু, আমি আজ নিজ হাতে আমার
সোনার পাখীটার পাখা বেঁধে দিলাম। ও আজ থেকে ছোট্ট খাঁচায় ছটফট করবে মরণতক-বেরোতে পারবেনা।”
তুমি তাকে আশ্রয় দিও, দিও প্রবোধ।” অতিথিরা কে কি বুঝেছে জানিনা। কিন্তু আমার ভেতরটা
যেনো হঠাত করে খালি হয়ে গেল। স্পষ্ট করে বুঝলাম বড় আকাশে স্বাধীন আর ছোট সংসারে পরাধীনতার
নিখাদ তফাতটা। স্মৃতিটা আজও অম্লান।
২০০৬এর
শরতে আমাদের মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। কম্যুনিটি সেন্টারে অতিথিদের সমাগম। আমি কিন্তু একটা
ব্যথা অনুভব করছি মেয়েকে হারাবার। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমার সোনার পাখীটির উড়াল দেওয়ার
সময় ঘনিয়ে এলো। ওরা নোতুন ঘর বাঁধবে। কেমন ঝাপসা হলো চারদিক। মেয়ে কাঁদছে ওর ছোট ভাইকে
জড়িয়ে। ক্ষীণ কন্ঠে বল্লো, “যাচ্ছিরে। আম্মু-আব্বুর দিকে খেয়াল করিস।” ছেলেটাও ফুঁফিয়ে
কাঁদছে। আমার মনে পড়লো সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিবাহান্তে বিদায় কবিতাটি। মেয়েটি যখন
আমার কাছে এলো ও যেনো নিথর, জখ্মী আওরাত, আহত এক পাখী। চোখের কোণে সাজানো বরষার লোনাজল
গোপন রাখা সম্ভব হলোনা। বল্লাম, “মা, যে ডালে বসে তুই কলকাকলীতে চারদিক মুখরিত করে
রাখতিস- আজ থেকে সেই কলকাকলী আর শুনতে পাবোনা রে।” মেয়ে বল্লো, যাচ্ছি আব্বু। নিজের
দিকে খেয়াল রেখো। ওর যাবার সময় আমার মনে হলো ভারতের বিখ্যাত সংগীত লেখক রাজেন্দ্র কৃষ্ণের
গানের কথা, “খতম হুয়ে দিন উস ডালিসে যিস পার তেরা বাছেরা থা-” Gone
are the days of that branch on which you were perched -যে ডালে
বসে তুই কলকাকলীতে চারদিক মুখরিত করে রাখতিস-আজ থেকে সেই দিনের অবসান হলো”- মেয়েটি
চলেই গেল। ও এখন থেকে আমাদের কাছে আসবে -কিন্তু অতিথি হয়ে।
সূত্র: মাই ডেইলী নোটস, তীর্থ রেণু, ami jassi baba
(আমি যাচ্ছি বাবা) bangla sad song
ভাই বোনেতে
ছিলাম রে এক মায়ের জঠরে,
মায়ের যা
দুধ সব খেয়েছি আমরা ভাগ করে;
তোমার ভাগ্যে
ভাইরে তুমি পেলে বাপের ঘর,
আমার ভাগ্যে
ভাইরে আমি হ’লাম দেশান্তর
মাসেক দু’মাস
কাঁদবে বাপে, সারা জীবন মায়
দিনেক দু’দিন
হয়তো রে ভাই কাঁদবে তুমি হায়;
ভাইয়ের
বধূ কাঁদবে শুধু বিদায়ের কালে,
পোষা পাখী
মুছবে আঁখি আঁখির আড়ালে।
No comments:
Post a Comment