বহু জাতের খেজুর আছে যা চেনা বিশ্বের পক্ষে কঠিন। মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর আছে প্রায় ৬০০ জাতের।
Production
খেজুর এখন সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। আর এ খেজুরের আছে নানা জাত। খেজুর নিয়ে প্লিনি দ্য এলডার লিখেছেন, ‘খেজুরের প্রায় ৪৯টি জাত রয়েছে।’ প্লিনি বলে গিয়েছিলেন খেজুরের এ জাতগুলোর বেশির ভাগেরই নাম বর্বর। এখানে বর্বর বলতে আসলে আরবে প্রচলিত নামের কথা বলা হয়েছে। বেশির ভাগ খেজুরের নাম আরবিতেই। এমন হওয়ার কারণ আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে একসময় খেজুরই ছিল অর্থনীতির মূল। বহুদিনের চাষাবাদের কারণে সেখান থেকেই খেজুরের জাত নির্ধারণ ও নাম দেয়া হয়েছিল। নামগুলো তৈরি হয়ে বহির্বাণিজ্যের কারণে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলে যেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে খেজুরের নাম নির্ধারিত হতো বৈশিষ্ট্য অনুসারে। যেমন প্লিনি লিখেছেন এক ধরনের খেজুরের নাম ছিল ‘দাবলান’। মূলত নরম বোঝাতে এ নাম দেয়া হয়েছিল।
খেজুর এলাকাভেদে ভিন্ন হতো। ব্যাবিলনের রাজকীয় বাগানে এক ধরনের খেজুর উত্পন্ন হতো। গোল এ খেজুরগুলোর নাম ছিল ‘মার্গারিড’। মুক্তার মতো হওয়ার কারণে এ নাম দেয়া হয়েছিল। ‘সিয়াগ্রাস’ ছিল লম্বা ও শক্ত ধরনের খেজুর। স্বাদের দিক থেকেও তা অন্য জাতের তুলনায় আলাদা। প্লিনির উল্লেখ করা খেজুরের মধ্যে ‘কায়োটে’ সবচেয়ে শক্ত। এ খেজুর মদ তৈরিতে ব্যবহার করা হতো। পাটেটে নামের খেজুর খুব রসালো। এগুলো গাছে থাকা অবস্থায়ই ফেটে যেত। এ খেজুরের নামকরণের ক্ষেত্রে ফাটলের গুরুত্ব আছে। ফেটে যেত বলে সিরিয়াক হিব্রু পাটাক (ফেটে যাওয়া) থেকে নামটি এসেছে।
খেজুরের ধরন নির্ভর করে অঞ্চলের ওপর। যেমন ইথিওপিয়ার খেজুর শক্ত ধরনের। এ অঞ্চলের কোনো কোনো জাতের খেজুর এত শক্ত হয় যে এগুলো গুঁড়ো করে ময়দা তৈরি করা যায়। সে ময়দা থেকে রুটি তৈরি করাও সম্ভব। আবার খেজুর আহরণ করার ক্ষেত্রেও অঞ্চল অনুসারে পার্থক্য হয়। থিবসে প্রায় কাঁচা খেজুরই তুলে নিয়ে বয়াম ভরে রাখা হয়। প্রাকৃতিকভাবে না পাকার কারণে খাওয়ার আগে চুলার পাশে রাখতে হয় থিবসের খেজুর।
বালানি খেজুর বিভিন্ন রঙ ও আকারের হয়। এ জাতের খেজুর উত্পন্ন হয় মূলত মিসর ও ফিনিশিয়ায়। প্রাথমিক অবস্থায় বালানি মোটেও সস্তা ছিল না। নির্দিষ্ট কিছু পরিবারেরই কেবল সামর্থ্য ছিল এ খেজুর কেনার। চতুর্থ শতাব্দীতে পর্যটক জেনোফন পারস্যে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তিনি নানা জাতের খেজুরের কথা বলেছেন। তার বর্ণনা মতে, ‘সেখানে বিভিন্ন ধরনের খেজুর পাওয়া যেত। আকার-আকৃতিতে ছিল নানা বৈচিত্র্য। মনে হতো এগুলো সোনালি অ্যাম্বারের টুকরো। কোনো কোনো খেজুর এত মিষ্টি হতো যে মুখে লেগে থাকত। কোনোটি দিয়ে আবার মদও তৈরি হতো।’
খেজুর মূলত পাম জাতেরই একটি অংশ। অনেক সময়ই নানা বীজ থেকে পাম বা খেজুর উত্পন্ন হয়। এর সবগুলোর নামও নেই। এই নতুন জাতকে আরবিতে বলা হয় ‘দেকেল’। কখনো বর্ণনা করা হয় ‘মাজুল’ বা ‘মেজুল’ নামে যার অর্থ ‘অজানা’। আমরা বাংলাদেশে জনপ্রিয় ধারার যে খেজুর দেখি এর বাইরেও নানা জাতের পাম ও খেজুর রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পাঞ্জাব অঞ্চলেই খেজুর আছে প্রায় ৩০০ জাতের। তবে বলে রাখা ভালো এর মধ্যে মাত্র কয়েকটিই কেবল খেতে ভালো। সে তুলনায় ইরাকে ভালো জাতের খেজুরের সংখ্যা বেশি। সেখানে নানা ধরনের খেজুর বহুকাল ধরেই চাষ হয়ে আসছে।
আবার অজানা জাত অর্থাৎ ‘দেকেল’ থেকেও ভালো স্বাদের খেজুর পাওয়া যেতে পারে। উত্তর আফ্রিকায় এমন একটি খেজুর পাওয়া গেছে। হালকা সোনালি এ খেজুরের নাম দেয়া হয়েছে ‘দেগলেত নূর’ Deglet Noor (আলোর খেজুর)। প্রায় স্বচ্ছ এ খেজুরের বীজটি বাইরে থেকে দেখা যায়। এর মূল অঞ্চল আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার ওয়েসিসে। খেজুরটি সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রথম আবিষ্কার করা হয় এবং শুরু থেকেই একে অসাধারণ হিসেবে বোঝা গিয়েছিল। কিংবদন্তিও রয়েছে এ খেজুরটি নিয়ে। সে অনুসারে একজন ধার্মিক নারী লাল্লা নূরের সঙ্গে খেজুরের যোগ রয়েছে। তিনি এতটাই দরিদ্র ছিলেন যে আল্লাহর ৯৯ নামে জিকির করার জন্য তার ৯৯ দানার তসবি ছিল না। তিনি খেজুরের ৯৯টি বীজ নিয়ে হিসাব করে জিকির করতেন। তার মৃত্যুর পর কবরে ওই বীজও পুঁতে দেয়া হয়। সেই ৯৯টি বীজ থেকে গাছ হয়েছিল এবং প্রতিটি গাছে স্বাদু খেজুর হতো। লোকে তাই এর নাম দিয়েছিল দেগলেত নূর। আবার অনেকের মতে এ বীজ এসেছিল মহানবীর (স.) স্ত্রী আয়েশার (রা.) উঠান থেকে। তিনি মদিনায় ছিলেন আর মদিনাকে বলা হতো আলোর শহর।
এমন আরেকটি অজানা জাতের খেজুর জনপ্রিয় হয়েছিল। এর নাম মেজুল। মূলত অজানা জাত থেকেই খেজুরটি এসেছিল। মরক্কো ও দক্ষিণ আলজেরিয়ায় এ জাতের খেজুর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবে উনিশ শতকেও তাফিলেতাত অঞ্চলে ভ্রমণ করা কোনো ভ্রামণিক এ জাতের কোনো খেজুরের নাম করেননি। তাই মনে করা হয় জাত সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকার কারণেই খেজুরের এ নামকরণ করা হয়েছে। মরক্কোর তাফিলেতাত অঞ্চলটি খেজুরের জন্য বহুদিন ধরেই জনপ্রিয়। অঞ্চলটিতে বিশেষভাবে খেজুরের চাষ হয়। এ অঞ্চলে সূর্যের তাপ খুব বেশি পড়ে। তাই খেজুর বাগানে যারা কাজ করে তাদের আলাদা করে পানির ব্যবস্থা করতে হয়। সেখানকার বেশির ভাগচাষীই করিতকর্মা। এরা আরবের ফিলাল থেকে কাজ করতে তাফিলেতাতে আসে।
বিশ শতকের শুরুর দিকেও মেজুল একটি প্রায়-অপরিচিত জাত ছিল। এটি কেবল রফতানি করার জন্য উৎপাদন করা হতো। উৎপাদনের পর তা আলাদা করে রাখা হতো। এ খেজুরে গ্রামবাসীর কোনো অধিকার ছিল না। যারা এ খেজুর উৎপাদন করতেন তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল নিম্নজাতের খেজুর। মেজুল ও দেগলেত নূর বিশ্বের কাছে অপরিচিত থাকলেও এখন পরিচিত। কিন্তু বহু জাতের খেজুর আছে যা চেনা বিশ্বের পক্ষে কঠিন। কেননা মধ্যপ্রাচ্যে খেজুর আছে প্রায় ৬০০ জাতের।
প্রতিটি অঞ্চলে খেজুর উৎপাদনের নিজস্ব ইতিহাস আছে। এসব ক্ষেত্রে খেজুরের নামকরণে প্রভাব রাখে অঞ্চল বা ব্যক্তির নাম। কখনো কখনো খেজুরের চেহারার ওপরও নির্ভর করে এর নাম। স্বাদ ও রঙ পর্যন্ত বিবেচনা করে নাম রাখা হতো। এর মধ্যে কিছু নাম বেশ চিত্তাকর্ষক। যেমন, বেইদ ইল-বিলবিল (কোকিলের ডিম), আসাবি ইল-আরুস (কনের আঙুল), মালাব্বাস আল-আরুজ (বুড়ো নারীর বানানো ক্যান্ডি) ও খাসাওয়ি ইল-বাঘাল (গাধার অণ্ডকোষ)।
তবে বিশেষ খেজুরের মধ্যে আছে ইরাকের জাইদি। এটি বাগদাদের মূল অর্থনৈতিক ফসল বলা চলে। জাইদি দামে সস্তা এবং যেকোনো আবহাওয়ায় ভালো থাকে। চিনি বেশি থাকার কারণে বাগদাদের বিশেষ অ্যালকোহল ‘আরক’ তৈরিতে জাইদি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া খিস্তাওয়ি ও হিলাওয়ি অন্যতম জনপ্রিয় খেজুর। হিলাওয়ি মূলত বাগদাদের দক্ষিণের হিল্লা শহরের নামে নামকরণ করা হয়েছে। সবুজ ধরনের একটি মিষ্টি জাতের খেজুর খাদরাওয়ি। তবে প্রচুর পরিমাণে খাওয়া হয় ইস্তামারান নামের খেজুরটি। বসরার সেরা খেজুর বারহি। বারহি অর্থাৎ গরম হাওয়া থেকে এ নামটি এসেছে। শুকনো খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় আসরাসি।
মিসরে সবচেয়ে মূল্যবান খেজুর হায়ানি। হায়ান নামক গ্রামের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। গ্রামটিকে হাজিদের পুকুর বলা হয়। হজযাত্রীরা এককালে এ গ্রামে থেমে বিশ্রাম করতেন। সাইদি খেজুরও বিখ্যাত। আসরাসির মতোই এ খেজুরও শুকনো। তিউনিসিয়ার মানখির (নাকের মতো) খেজুর বেশ লম্বা আকারের। খেতে অনেকটা দেগলেত নূরের মতো। আলজেরিয়ার থুরিও শুকনো এবং এটি ওই ময়দা তৈরি করার মতো খেজুর। দক্ষিণ ইরানে এক ধরনের মিষ্টি খেজুর ফলে। কালো ধরনের এ খেজুরের নাম মাজাফাতি।
এতসব খেজুরের নাম না জানলেও গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষ আজওয়া খেজুরের নাম জানে। এটি মূলত মদিনার খেজুর এবং মহানবীর (স.) প্রিয়। ওমানে বু নারিনজা নামের খেজুরটিও স্বাদু। সৌদির খালাসার সঙ্গে এর স্বাদের মিল রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো এত ধরনের খেজুরের খুব কম প্রকারের সঙ্গেই আমরা পরিচিত। খেজুর কিনে চেখে দেখেই এক জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব।
14 Popular Dates Varieties:
Medjool Dates
Piarom Dates
Deglet Noor Dates
Mazafati Dates
Barhi Dates
Rabbi Dates
Thoory Dates
Sayer Dates
Dayri Dates
Halawy Dates
Sukkari Dates
Khudri Dates
Zahedi Dates
Safawi Dates
Source: মাহমুদুর রহমান
Own study
No comments:
Post a Comment