Monday, September 11, 2023

মুসলিম নারী মোগল শাহজাদি জেবুন্নিসা

 ৭ বছর বয়সে কুরআন হিফজ করেছিলেন

মোগল রাজকন্যা জেবুন্নিসা বেগম ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগিরের বড় সন্তান, যিনি একই সঙ্গে কবি, সাহিত্যিক, সুফি ও কোরআনের হাফেজা ছিলেন। ‘দিওয়ানে মাকফি’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। রাজকন্যা হয়েও তিনি সাধকের মতো জীবন কাটাতেন। শাহজাদি জেবুন্নিসা ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের মহারাষ্ট্রের দৌলতাবাদে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রিয় কন্যার জন্য সম্রাট জেবুন্নিসার শিক্ষিকা হিসেবে হাফেজা মারিয়ামকে নিযুক্ত করেন। জেবুন্নিসা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার মেধা, বুদ্ধি ও সাহিত্য রুচি লাভ করেছিলেন। তিনি সাত বছর বয়সে কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। হিফজ শেষ করতে তাঁর সময় লেগেছিল মাত্র তিন বছর।
কন্যা কোরআন হিফজ করায় সম্রাট আওরঙ্গজেব মহাউতসবের আয়োজন করেন এবং রাষ্ট্রীয় ছুটি ঘোষণা করেন। জেবুন্নিসা ও তাঁর শিক্ষিকাকে ৩০ হাজার করে স্বর্ণ মুদ্রা উপহার দেন।
জেবুন্নিসা সাইয়েদ আশরাফ মাজান্দারানির কাছে দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্যসহ সমকালীন বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণ করেন। আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় দক্ষ ছিলেন শাহজাদি জেবুন্নিসা।
তিনি একজন লিপিকার ও ক্যালিগ্রাফ শিল্পীও ছিলেন। বইপ্রেমী শাহজাদি জেবুন্নিসা বই লেখা ও মূল্যবান বইয়ের অনুলিপি তৈরি করতে একাধিক আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারটি ছিল খুবই সমৃদ্ধ। শাহজাদি জেবুন্নিসা ছিলেন একজন দানশীল নারী। তিনি দরিদ্র, অসহায়, বিধবা ও এতিমদের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন।
প্রতিবছর তিনি বহুসংখ্যক মানুষকে হজে পাঠাতেন। সংগীতের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি নিজেও মর্মী গান গাইতেন। সমকালীন নারীদের ভেতর তাঁকে শ্রেষ্ঠ গায়িকা মনে করা হয়। আওরঙ্গজেব যখন সম্রাট হন, তখন জেবুন্নিসার বয়স ২১ বছর। তিনি তাঁর মেয়ের মেধা ও বিচক্ষণতা সম্পর্কে জানতেন। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং মতামত নিতেন।
দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী হলেও জীবনযাপনে ছিলেন সাদাসিধে। একটি মুক্তার গলার হার ছাড়া তিনি কোনো অলংকার ব্যবহা করতেন না। সব সময় সাদা পোশাক পরিধান করতেন। তিনি ‘আঙ্গিয়া কুর্তি’ নামে মেয়েদের একটি বিশেষ পোশাক উদ্ভাবন করেন। বাগান স্থাপন ও বৃক্ষরোপণ ছিল তাঁর প্রিয় একটি কাজ। লাহোরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত চৌবুর্জি বাগানের অস্তিত্ব এখনো টিকে আছে।
একাধিক বিষয়ে দক্ষতা থাকলেও জেবুন্নিসা মূলত একজন কবি হিসেবেই পরিচিত। তাঁর ভারতীয় ধারার ফার্সি কবিতার অন্যতম প্রধান কবি মনে করা হয়। সাহিত্যে তিনি হাফেজ সিরাজি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কবিতা রচনার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু মর্মী গানও রচনা করেছেন। তিনি ‘মাখফি’ নামে কবিতা লিখতেন। ‘দিওয়ানে মাখফি’ তাঁর কাব্যসংকলন, যাতে পাঁচ হাজার পঙিক্ত রয়েছে। অবশ্য ‘মাখজানুল গায়েব গ্রন্থকারের দাবি, জেবুন্নেসার মোট পঙিক্তর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।
কুরআনচর্চায় জেবুন্নেসা বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। কুরআনের হাফেজা এ মোগল শাহজাদি ‘জিবুত তাফাসির’ নামে একটি তাফসির গ্রন্থ রচনা করেন, যা নারীদের রচিত প্রথম তাফসির গ্রন্থ। অবশ্য সাইয়েদ আবদুল হাই হাসানি (রহ.) ‘নুজহাতুল খাওয়াতির’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘জিবুত তাফসির মূলত ইমাম রাজি (রহ.)-এর তাফসিরে কবিরের ফার্সি অনুবাদ। যা শায়খ শফিউদ্দিন কাজভিনি (রহ.) জেবুন্নিসার নির্দেশে রচনা করেন। ফলে তাঁর নামে নাম রাখা হয়।’
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই রাজকন্যা জীবনের শেষ ২০ বছর সালিমগড় দুর্গে বন্দিজীবন কাটান। কিন্তু তাঁকে কেন বন্দি করা হয়েছিল তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। সম্রাট তাঁর সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন, বার্ষিক লাখো-রুপি পেনশন বাতিল এবং আমৃত্যু বন্দিত্বের নির্দেশ দেন। জেলজীবনে ইবাদত, জ্ঞান ও কবিতা চর্চাই ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী।
দীর্ঘ বন্দিজীবন কাটানোর পর জেবুন্নিসা ১৭০১ বা ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে ‘তিঁস হাজারি’ (৩০ হাজার গাছবিশিষ্ট) বাগানে সমাহিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে কবিতা সংকলন দিওয়ানে মাখফি প্রকাশ পায়। যাতে ৪৩১টি গজল ও চতুর্দশপদী কবিতা স্থান পায়। ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে এর সঙ্গে অন্যান্য কবিতা যুক্ত হয়। এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি এশিয়া-ইউরোপের একাধিক পাঠাগারে সংরক্ষিত আছে।
ব্যক্তিগত জীবনে জেবুন্নেসা অবিবাহিত ছিলেন। ঐতিহাসিকরা বলেন, চাচাতো ভাই যুবরাজ সুলাইমান শিকোর সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক করেছিলেন দাদা শাহজাহান। আওরঙ্গজেবের অনিচ্ছায় তা বাস্তবায়িত হয়নি। অবশ্য তাঁর কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি স্বেচ্ছায় সন্ন্যাসব্রত ও সাধক জীবন বেছে নিয়েছিলেন। যেমন তিনি বলতেন, আমি শাহজাদি কিন্তু ভোগ-বিলাসের জীবন প্রত্যাখ্যান করেছি। এটা আমার গর্ব। যেমন আমার নাম জেবুন্নিসার অর্থ নারীজাতির অলংকার ও গর্ব।
সূত্র: অ্যারিকপোস্ট ডট লাইভ, রাসিফ টোয়েন্টিটুডটনেট ও উইকিপিডিয়া
May be an image of flower
All reactions:
Abdus Sabur Dhms

No comments:

Post a Comment