Thursday, November 9, 2017

আর কুরআন ও মানব প্রকৃতি

মানুষ অকৃতজ্ঞ এক জাতি: আল কুরআন কী বলে?
আল্লাহ মানুষ থেকে কী আশা করেন! আল্লাহ আশা করেন যে মানুষ সব সময় আল্লাহর শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করবে। বিষয়ে বেশ কয়েকটি আয়াত আছে-
* আর আল্লাহ তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় বের করেছেন যে তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের শোনার জন্য কান দিয়েছেন, দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন এবং তোমাদের দিয়েছেন একটি দিল, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা বা শোকর প্রকাশ করতে পার। (সুরা নাহল : ৭৮)
* আর তিনি তোমাদের দিয়েছেন চোখ, কান হৃদয়। তোমরা (মানুষেরা) এর জন্য খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা সাজদা : )
* আর আমি তো তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তার মধ্যে তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থাও করেছি। তোমরা খুব অল্পই কৃতজ্ঞতা আদায় করো। (সুরা আরাফ : ১০)
* তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের কান, চোখ মন দিয়েছেন (অথচ) তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো। (সুরা মুমিনুন : ৭৮)
* তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন আর তোমাদের দিয়েছেন দেখা শোনার শক্তি এবং একটি অন্তর। অথচ তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সুরা মূলক : ২৩)
* তুমি কি তাদের দেখনি, যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ...পরে তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবিত করেছিলেন। আল্লাহ (সব সময়) মানুষকে অনুগ্রহ করে থাকেন। অথচ মানুষদের মধ্যে অনেকেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (সুরা বাকারা : ২৪৩)
* যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বানায়, কিয়ামতের দিন সম্পর্কে তারা কী জানে। আল্লাহ তো মানুষকে অনুগ্রহই করেন। কিন্তু মানুষের বেশির ভাগই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (সুরা ইউনূস : ৬০)
আয়াতগুলো অনেকটা ইতিবাচক শব্দ হিসেবে পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে। আবার ইতিবাচক নেতিবাচকের মাঝামাঝিও অনেক আয়াত বিষয়ে রয়েছে। যেমন-
* আমি তাকে (মানুষকে) পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে। (সুরা দাহর : -),
* ... তিনি (আল্লাহ) তোমাদের তাঁর কিছু নিদর্শন দেখাতে পারেন। প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। (সুরা লোকমান : ৩১-৩২)
* ... আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে ভালো করে জানেন না? সুরা আনআম : ৫৩) তবে পবিত্র কোরআনে মানুষের 'শুকরিয়া' চরিত্র বিষয়ে বেশির ভাগই নেতিবাচক অর্থাৎ মানুষ যে 'অকৃতজ্ঞ' চরিত্রের, সেই ভাষ্যটিই বেশি ফুটে উঠেছে :
* মানুষ তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। (সুরা আদিয়াত : )
* নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল। কিন্তু (মানুষের) অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ। (সুরা নমল : ৭৩)
* মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। (সুরা বনি ইসরাইল : ৬৭)
* যদি আমি মানুষকে আমার দয়া দেখাই এবং পরে (কখনো) এই দয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, তখনই সে হতাশ অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে। (সুরা হুদ : )
* আমি (আল্লাহ) যখন মানুষকে দয়া দেখাই, তখন সে খুব আনন্দিত হয়ে পড়ে। আর যখন নিজের কৃতকর্মে তার বিপদ ঘটে, তখন মানুষ হয়ে পড়ে অকৃতজ্ঞ। (সুরা শূরা : ৪৮)
* মানুষ (আল্লাহর) বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে তাঁর (আল্লাহর সত্তার) অংশ গণ্য করে থাকে। মানুষ তো স্পষ্টই অকৃতজ্ঞ। (সুরা জুখরুফ : ১৫)
* তিনি (আল্লাহই) তো তোমাদের জীবন দান করেছেন। তারপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদের জীবিত করবেন। মানুষ খুবই অকৃতজ্ঞ। (সুরা হজ্জ : ৬৬)
অকৃতজ্ঞ মানুষের জন্য আল কুরআনের বার্তা
মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহের পরও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়লে আল্লাহর মনোবেদনার কারণ ঘটে। তখন তার জন্য রয়েছে আল্লাহর কাছ থেকে সমূহ বঞ্চনা, শাস্তি গজব। আল্লাহপাক বলেছেন-
* আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কাউকে শাস্তি দিই না। (সুরা সাবা : ১৭)
* তোমরা (মানুষরা) অকৃতজ্ঞ হলে জেনে রাখো, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি তাঁর বান্দাদের অকৃতজ্ঞতাকে পছন্দ করেন না। (সুরা জুমার : )
* মনে রেখ... তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের প্রতি নেয়ামত আরো বাড়বে আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠিন। (সুরা ইব্রাহিম : )
* ... তোমাদের যা প্রয়োজন, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের তা দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর দানকে গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। অকৃতজ্ঞ মানুষ অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘনকারী। (সুরা ইব্রাহিম : ৩৪)
* আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করেন। তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞকে ভালোবাসেন না। (সুরা হজ্জ : ৩৮)
* মানুষ কি মনে করে যে তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে? সে কি স্খলিত শূক্রবিন্দু ছিল না? (সুরা কিয়ামা : ৩৬)
* তোমরা (মানুষরা) কি মনে করো যে আল্লাহ তোমাদের এমনি ছেড়ে দেবেন? (সুরা তওবা : ১৬)
* সে (মানুষ) কি মনে করে যে কেউ কখনো তাকে কাবু করতে পারবে না? ...সে কি মনে করে যে তাকে কেউ দেখেনি? আমি তাকে কি দুটো চোখ, জিহ্বা আর ঠোঁট দিইনি? দুটো পথই কি আমি তাকে দেখাইনি? (সুরা বালাদ : -১১)
* যারা মন্দ কাজ করে, তারা কি মনে করে যে তারা আমার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে? (সুরা আনকাবুত : )
* ... মানুষ তা- পায়, যা সে করে। তার কাজের পরীক্ষা হবে, তারপর তাকে পুরো প্রতিদান দেওয়া হবে। (সুরা নাজম : ৩৯-৪১)
এরপর আল্লাহ তায়ালা সরাসরি শাস্তির প্রকৃতি কী হবে, তাও মানুষকে জানান দিয়ে রাখছেন। আল্লাহ বলছেন,
* 'আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শেকল বেড়ি এবং লেলিহান আগুনের শিখা।' (সুরা দাহর : )
* অকৃতজ্ঞ অবস্থায় তুমি কিছুকাল জীবন উপভোগ করে নাও, তুমি হবে একজন জাহান্নামী। (সুরা জুমার : )
* ... তোমাদের একদল প্রতিপালকের শিরক করে ... ভোগ করে নাও শিগগিরই জানতে পারবে। (সুরা নাহল : ৫৫)
* ... এভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (সুরা ইউনুস : ১৪)
* (সে) মানুষ ধ্বংস হোক যে এত অকৃতজ্ঞ। (সুরা আবাসা : ১৭)
মানব চরিত্রে সুবিধাবাদ: আল কুরআন বী বলে?
মানুষের চরিত্রের একটি বড় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আছে যে মানুষ খুব দ্রুত তার অবস্থান বদল করে। যখন বিপদ-আপদে পড়ে, তখন এক রকম কথা বলে আবার বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে গেলে তার আসল চরিত্র প্রকাশ পায়। মানুষের এই সুবিধাবাদী চরিত্র সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে প্রচুর আয়াত রয়েছে। যেমন-
. সে (মানুষ) যখন বিপদে পড়ে, তখন সে খুব হা-হুতাশ করে। আর যখন তা কেটে যায়, তখন সে কৃপণ হয়ে যায়। (সুরা মা'আরিজ : ২০-২১)
. সমুদ্রের মাঝখানে যখন তোমরা বিপদে পড়ো, তখন তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য যাদের ডাকো তাদের ভুলে যাও। তারপর যখন আল্লাহ তোমাদের সৈকতে এনে উদ্ধার করেন, তখন তোমরা আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। (সুরা বনি ইসরাইল : ৬৭)
. মানুষ যখন কষ্টের সম্মুখীন হয়, তখন শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে আমাকে (আল্লাহকে) ডাকতে থাকো। যখন সে কষ্ট চলে যায়, তখন মানুষ এমন একটা ভাব করে, যেন সে কখনো আমাকে ডাকেইনি। (সুরা ইউনুস: ১২)
. তারা যখন নৌকায় ওঠে... এবং যখন এর ওপর ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে... তখন তারা আল্লাহকে ডেকে বলে, 'তুমি এর থেকে আমাদের বাঁচাও, আমরা শোকর বান্দা হব' তারপর তাদের আল্লাহ যখন বাঁচিয়ে দেন তখন তারা আবার অনাচার করতে থাকে। (সুরা ইউনুস : ২১-২৩)
. যদি তার (মানুষের) ওপর আপতিত দুঃখ-কষ্টের পরে তাকে সুখ-ভোগ করাই, তখন সে বলতে থাকে আমার বিপদ দূর হয়ে গেছে। তখন (মানুষ) আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় এবং অহংকার করে। (সুরা হুদ : -১১)
. ধৈর্যশীল মানুষের জন্য... নির্দশন রয়েছে। যখন সমুদ্রের ঢেউ মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে ঢেকে ফেলে, তখন মানুষ 'আল্লাহ আল্লাহ' বলে ডাকতে থাকে। ... যখন (আল্লাহ) তাদের সৈকতে ফিরিয়ে এনে উদ্ধার করেন, তখন দেখা যায় কোনো কোনো মানুষ সরলপথে চলে। (সুরা : লোকমান : ৩১-৩২)
. মানুষকে যখন দুঃখদৈন্য স্পর্শ করে, তখন সে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। এরপর আল্লাহ যখন তাকে দয়া করে তখন মানুষ ভুলে যায় যে বিপদে পড়ে সে এর আগে আল্লাহকে ডেকেছিল। (সুরা জুমার : )
. মানুষ কষ্টের সময় আমাকে (আল্লাহকে) ডাকে। যখন আল্লাহর অনুগ্রহে কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে, তখন (মানুষ) বলতে থাকে সে নিজের চেষ্টায়ই থেকে মুক্তি লাভ করেছে। (সুরা জুমার : ৪৯)
. ধন-সম্পদ প্রার্থনার জন্য মানুষের কোনো ক্লান্তি থাকে না। ... যখন আমি তাকে দয়া করে সুখের স্বাদ দিই, তখন মানুষ বলতে থাকে- 'এটা তো আমার প্রাপ্যই ছিল। আমি তো মনে করি না কিয়ামত বলে কিছু আছে। ... আবার যখন মানুষ বিপদে-আপদে অমঙ্গলে পড়ে যায়, তখন আবার দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে যায়।' (সুরা হা-মিম-সাজদা : ৪৯-৫১)
১০. ওরা (মানুষ) যখন পানিপথে চলতে থাকে, তখন পবিত্র মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর আমি (আল্লাহ) যখন তাদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিই, তখন মানুষ শিরক করা শুরু করে। আর এভাবেই মানুষ আমার (আল্লাহর) দান অস্বীকার করে। (সুরা আনকাবুত : ৬৫-৬৬)
১১. আল্লাহ যখন মানুষকে দয়া এবং সম্মানিত করেন, তখন মানুষ বলে আমার আল্লাহ আমাকে সম্মানিত করেছেন। আর যখন আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য উপকরণ কমিয়ে দেন, তখন মানুষ বলতে থাকে, আল্লাহ আমাকে হেয় করে দিয়েছেন। (সুরা ফাজর : ১৫-১৬)
আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা
বাস্তবিক এই যে মানুষের এসব নেতিবাচক দিক পবিত্র কোরআনে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর কথা সত্যও যে এই নেতিগুণ প্রবণতা মানুষের মাঝে বেশি করেই আছে। কোরআনে মানুষের এই নেতিগুণের উল্লেখের আসল তাতপর্য হলো, মানুষ যাতে এর থেকে সাবধানে থাকে। কারণ 'মানুষ তো ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থানে আছে' (সুরা আসর : )
অবশ্য মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথাও কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। সুরা বাকারায় একটি আয়াতই জন্য যথেষ্ট যে আল্লাহ তায়ালা ব্যাপারে সনদ দিচ্ছেন যে... 'এমন মানুষও (আল্লাহর রাজ্যে) আছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যারা জীবন সমর্পণ করে দিতে পারে। (সুরা বাকারা : ২০৭)
তাই মানুষ হলো এই জমিনে আল্লাহ তায়ালার খলিফা বা প্রতিনিধি। (সুরা ফাতির : ৩৯)
শুধু তাই নয়, আকাশ পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। (সুরা লুকমান : ২০)

এসব আয়াতের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে মানুষের মর্যাদা অনেক বড়। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ তো আল্লাহ তায়ালার কাছে অলংকৃত হয়েই আছে। (শেষ)
রেফারেন্স: ড. আবদুল হান্নান

No comments:

Post a Comment