Tuesday, September 24, 2019

একটি করুন মৃত্যু ও স্মৃতি বিভ্রমঃ বাস্তব একটি ঘটনা

ছোটবেলা থেকেই তাকে আমরা জসীম পাগলা বলেই জানি। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, কাপড় চোপড়ের ঠিক নেই, ঘুম নেই, রাত বিরাতে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, ভাঙা কবরের ভেতর মাটি ফেলে সেটাকে পুরে দেয়া, ইত্যাকার অবস্থা নিয়ে জসীম পাগলার নিশিদিন কাটে। প্রা্ইমারী স্কুল থেকে হাই স্কুল এমনকি কলেজ পর্যন্ত পড়লাম- জসীম পাগলার পাগলামী বাড়ে বৈ কমে না। অনেক সময় মিনিট ২/১এর জন্য প্রকৃতিস্থ হলে ভাল ভাল কথা বলে আর অল্প সময়েই তা বিলীন হয়ে যায়। ছেলে মেয়ে আছে অনেকগুলো। জসীম পাগলা বগুড়ার বিখ্যাত ভান্ডারী পরিবারের বড় জামাই। আমাদের গ্রাম শিকারপুরেই তার বাস মন্ডল পাড়ায়। সেই পাড়ায় আমাদের মত কিশোরদের আড্ডা চলতো নিয়মিত। জসীম পাগলার এক ছেলে বাবলু আমার সমবয়সী। জসীম পাগলার কবরের জায়গাও নির্দিষ্ট করা আছে। ইটে সেই বাঁধানো জায়গার মাথার দিকে একটা এপিট্যাফ বা সমাধি-লিপি আছে সেখানে মৃত্যু সম্পর্কে অনেক ভারী ভারী কথা লেখা রয়েছে। আমি আমার ২ বছরের বড় ভাই নোমান- ২জনে মৃত্যু সম্পর্কে সেই ভারী ভারী কথাগুলো পড়তাম। কথাগুলোর ২/১টি ছন্দ এখনো মনে আছে। “ভাইগো, উড়িয়া যাইবে প্রাণ পাখী পড়িয়া রইবে দুনিয়া, জানিবে নিশ্চয়-গোর গোর আজাব, ছের ছের মউত-জানিবে নিশ্চয়-”
কিন্তু আমার Inquisitiveness কাটেনা। জসীম পাগলা কেন পাগলা নামে পরিচিত? সেকি ভাল ছিল না? অতো বড় ভান্ডারী পরিবারের মানুষেরা তো এক পাগলার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পারে না? এসব প্রশ্ন আমার মনে ঘুরতেই থাকে। একবার বড় ভাইয়ের ইংরেজী “অ্যা ক্লাস বুক অব বোটানী” বই জসীম পাগলাকে পড়তে দিলে খেয়াল করলাম জসীম পাগলা অবলীলায় শুদ্ধ উচ্চারণে সেটি পড়ছে এভং দারুন ফ্লুয়েন্সী নিয়ে। আমার Inquisitiveness বেড়েই চলেছে। না? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে হবে। কেন তাকে পাগলা বল হয়। তা’ কাকে জিজ্ঞেস করবো? খুঁজে পেলাম না। ইতোমধ্যেই আমি ইন্টারমিডিয়েটের ১ম বর্ষের ছাত্র। দেশে মুক্তিযুদ্ধও শুরু হয়েছে। ডিসিশন নিলাম আব্বাকে জিজ্ঞেস করবো। আব্বা জসীম পাগলার চেয়ে বছর চারেকের বড়। আব্বার সাথে আমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হতো। আব্বা ডাক্তার হওয়ার সুবাদে আমাকে উনি মানব শরীর বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান দিয়েছিলেন যেটা আমি এখনো মনে রেখেছি। আমার স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও মানব শরীর বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বিশেষ কাজে দিয়েছে, এখনো হেমিওপ্যাথি প্রাকটিসে কাজে দিচ্ছে। এই মহান শিক্ষককে আমি মনের মণিকোঠায় তুলে রেখেছি। জসীম পাগলাকে ঘিরে আমার প্রশ্ন একদিন আব্বাকে করলাম। আব্বা বল্লেন, তাহলে শোনঃ
“জসীম মেধাবী ছাত্র ছিল। এন্ট্রান্স পোশের পর ও জলপাইগুড়ি বৃটিশ মেডিক্যাল স্কুলে পড়তে যায়। পড়া শেষ হলে ও বগুড়ায় বাড়ীতে চলে আসে ও প্রাকটিস শুরু করে। অল্প দিনেই ওর প্রাকটিস প্রসার পায়। আশপাশের গ্রামের লোকেরা তার সেবা পেয়ে ধন্য হতে থাকে। তখন আমাদের অঞ্চলে সিসি ফ্লাই (setse Fly) বাহিত কালাজ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল। অনেকে জ্বরে ভুগে মারা গিয়েছে আবার অনেকে চিকিতসায় ভালোও হয়েছে। কিন্তু তখন কালাজ্বরের একমাত্র চিকিতসা ছিল ব্রক্ষ্মচারী ইঞ্জেকশান দেয়া আর সেটা ছিল খুবই ইফেক্টিভ। আমি অব্বার কথাগুলো দারুন মনযোগে শুনছিলাম।
জসীমের আদরের ভাগ্নের একবার কালাজ্বর হলো। চিকিতসক তারই বড় মামা ডাক্তার জসীম উদ্দিন মন্ডল। ভাগ্নের চিন্তা কিসের আরো রয়েছে মামার কাছে ব্রক্ষ্মচারী ইঞ্জেকশান। আল্লাহ নিশ্চয়ই ভাল করবেন। ভাগ্নেকে মামার কাছে আসা হলো। মামা চিকিতসা দেবেন। মামা ভাগ্নেকে অনেকগুলো কথা জিজ্ঞেস করবার পর সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রক্ষ্মচারী ইঞ্জেকশান তাকে পুশ করবেন। নিয়মমাফিক ডাক্তার জসীম উদ্দিন মন্ডল সিরিঞ্জ রেডী করলেন এবং আদরের ভাগ্নের শরীরে পুশ করলেন। পুরো ওষুধ ভাগ্নের শরীরে যাওয়ার পর ভাগ্নে অল্প নড়লো, আর একেবারে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইলো। ভাগ্নের সাড়া নেই। বড় মামা ডাকছে, “বাবা ওঠ।” আমার কাজ শেষ। “ওঠ বাবা!” কিন্তু ভাগ্নে ততক্ষণে মৃত্যুর হীমশীতল স্পর্শে চলে গেছে পরপারে। কেন? ডাক্তার মামা বিলাপ করছে। আদরের ভাগ্নেকে কী আমি মেরে ফেললাম। ভাগ্নে মারা গেছে অ্যানাফাইল্যাক্টিক শকে (Anaphylactic shock) । মামার ব্রেনে শর্ট সার্কিট দেখা দিয়েছে। একটু প্রকৃতিস্থ হলে মামা ভালো করে দেখলেন ভাগ্নেকে তিনি ব্রক্ষ্মচারী ইঞ্জেকশান না দিয়ে পাশে আরেকটি অ্যাম্পুল থেকে ভুল ইঞ্জেকশান পুশ করেছেন। ফলটি হয়েছে মারাত্মক। ভাগ্নের করুন মৃত্যু, মামার হাতে। ডাক্তার জসীম উদ্দিন মন্ডল বিলাপ করতে লাগলেন, “আমি এ কী করলাম। আদরের সোনাকে নিজেই মেরে ফেল্লাম?” “আমি এ কী করলাম। আদরের সোনাকে নিজেই মেরে ফেল্লাম?” ব্যস! জসীম ওই যে অপ্রকৃতিস্থ হলো, আর স্বাভাবিকতায় ফেরেনি। গাঁয়ের মানুষের কাছে জসীম “পাগল” খ্যাতি পেল।”
আব্বার বলা শেষ হলে আমি খেয়াল করলাম আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভয় পেলে যেমনটা হয়, গা ঘামছে।
এর পর জসীম পাগলা আরো অনেক দিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু উনি আমার কাছে আর পাগলা বিশেষন পান নি। তিনি আমার কাছে ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন চাচা। যদিও তিনি অনেকের কাছে পাগলা নামেই পরিচিত ছিলেন। কারণ, তারা চাচার করুন কাহিনীটা জানতো না।
আরো পরে একদিন বড় ভাই ফোন করে জানালেন জসীম চাচা ইন্তেকাল কছেন। তার কবরের নির্দিষ্ট জায়গাতেই তাকে রাখা হয়েছে। তার কবরের এপিট্যাফটির অনেক কিছুই পড়া না গেলেও এখনো সেটি আছে, সেই লেখাগুলো, “ভাইগো, উড়িয়া যাইবে প্রাণ পাখী পড়িয়া রইবে দুনিয়া, জানিবে নিশ্চয়-গোর গোর আজাব, ছের ছের মউত জানিবে নিশ্চয়-” আমার কাছে নিঃশব্দে ভেসে আসে। মৃত্যুকে মনে হয় আমার শিয়রে। আরো মনে হয় অনেক আগে পড়া সেই কথাগুলো-“Wafting fragrance can’t be prevented with a fence!” বাতাসে ভেসে আসা সুগন্ধ কেউ বেড়া দিয়ে আটকাতে পারেনা। আমি যেন মৃত্যুর ওয়াফটিং ফ্র্যাগর্যানন্স টের পাচ্ছি যদিও মৃত্যুটা এক “ভয়াবহ” ব্যাপার!

No comments:

Post a Comment