সীরাতকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে পড়বেন
রাসূলুল্লাহর ﷺ একজন স্ত্রী অসিয়ত করে যান- তাঁর সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ যেন একজন ইহুদিকে দেয়া হয়!
তিনি ছিলেন রাসূলের এমন একজন স্ত্রী, যিনি মনেপ্রাণে ইসলাম গ্রহণ করলেও তাঁকে সারাজীবন ‘প্রমাণ’ করতে হয় তিনি ইহুদিদের প্রতি লয়্যাল না। অনেকেই আশঙ্কা করতো- না জানি তিনি রাসূলুল্লাহকে ﷺ হত্যা করেন! কেননা, তাঁর বাবা এবং স্বামীকে হত্যা করা হয়েছিলো।
তিনি ‘ইহুদি’ বলে অনেক খোঁটা শুনতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ সবসময় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ইন্তেকালের আগে তিনি অসিয়ত করেন- তাঁর সম্পদের এক-তৃতীয়াংশ যেন তাঁর ভাইপোকে দেয়া হয়।
তিনি রেখে যান ১ লক্ষ দিরহাম।
১ লক্ষ দিরহাম সম্পদ কতো বেশি ছিলো, সেটার একটা উদাহরণ হলো- রাসূলুল্লাহর ﷺ সকল স্ত্রীর মোহরানা একত্রিত করলেও ১ লক্ষ দিরহাম হতো না।
উম্মুল মুমিনীন অসিয়ত করে ইন্তেকাল করলেন।
ওদিকে মদীনার সবাই চিন্তায় পড়ে গেলো। উম্মুল মুমিনীনের ভাইপো ইসলাম গ্রহণ করেনি, সে ইহুদি। অথচ সে উম্মুল মুমিনীনের সম্পদের ভাগ পাবে?
কেউ কেউ এমন অসিয়ত পূরণে আপত্তি জানায়।
শেষমেশ পরামর্শ চাওয়া হয় আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে।
তিনি ছিলেন বিচক্ষণ সাহাবী। তিনি সবাইকে বলেন,
“আপনারা আল্লাহকে ভয় করুন এবং সাফিয়ার অসিয়ত বাস্তবায়ন করুন।”
অর্থাৎ, এই সম্পদের মালিক তিনি। তাঁর পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু, তিনি যেহেতু অসিয়ত করেছেন, সেই অসিয়ত পূরণ করতে হবে।
শেষে উম্মুল মুমিনীনের সম্পদের এক/তৃতীয়াংশ (৩৩,০০০ দিরহাম) প্রদান করা হয় সাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহার ভাইপোকে।
সাফিয়া বিনতে হুয়াই রাদিয়াল্লাহু আনহা নিয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে।
একদিন নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রী সাফিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহা) -কে নিয়ে বের হলেন। তাঁকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে মূলত তিনি বের হয়েছেন।
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন ইতিক্বাফে। সাফিয়া (রা:) তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন।
সাফিয়্যাহর (রা:) ঘর ছিলো উসামা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) -এর বাড়িতে।
স্ত্রীকে একা একা যেতে দিতে নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মন সায় দিচ্ছিলো না। তিনি বললেন, "তুমি তাড়াহুড়ো করো না। আমি তোমার সাথে যাবো (এগিয়ে দিতে)।"
রাসূল (সা:) ইতিকাফ থেকে উঠে আসছেন স্ত্রীকে আগিয়ে দেয়ার জন্য... মানে স্বামী হিসেবে তিনি কতোটা দায়িত্বশীল ছিলেন...
আর এই যুগে এসে কিছু লোক রাত ১২টায়ও বউকে একা ছেড়ে দিয়ে... নিজেরা গায়ে হাওয়া বাতাস লাগিয়ে শো অফ করে...
রাস্তায় দুজন সাহাবী নবিজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন মহিলার সাথে দেখতে পেলেন। তারা দুজন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
কিন্তু, নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে ডাকলেন- "তোমরা এদিকে এসো।"
সাহাবীদ্বয় কাছে আসার পর নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, "এতো আমার স্ত্রী সাফিয়া বিনতু হুয়ায়্যী।"
সাহাবী দুজন বেশ লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, "সুবহানাল্লাহ, ইয়া রাসূলাল্লাহ!" অর্থাৎ, তারা বুঝাতে চাইলেন, তারা কি স্বয়ং নবিজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে কোনো মন্দ ধারণা করতে পারেন?
নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,
"শয়তান মানুষের শরীরে রক্তের মতো চলাচল করে। আমি আশংকা করছিলাম যে, সে তোমাদের মনে কোনো সন্দেহ না ঢুকিয়ে দেয়!" [সহীহ বুখারী: ২০৩৮]
সীরাত পাঠ এজন্যই এতো ভালো লাগে। সেই যুগ, যে যুগকে নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) 'শ্রেষ্ঠ যুগ' বলেছেন, সেই প্রজন্ম, যে প্রজন্মের মানুষকে তিনি 'শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম' বলেছেন; সেই প্রজন্মেও তিনি কতোটা স্মার্ট ছিলেন! সুবহানাল্লাহ!
শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের মানুষের মনেও শয়তান সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে পারে। এজন্য নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্দেহ দূরীকরণের জন্য নিজে উদ্যোগী হয়ে সংশয় নিরসন করলেন। গুজব বাতাসের চেয়েও দ্রুত বেগে ছড়ায়। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সন্দেহবশত গুজব ছড়ানোর রাস্তাটি বন্ধ করে দিলেন।
সাফিয়া (রা) ছিলেন খাটো গড়নের। তাই যখন তিনি বাহনে আরোহণ করতেন তখন রাসূল (সা) তাকে ঢেকে দিতেন। তারপর হাঁটু বিছিয়ে দিতেন। সাফিয়া (রা) সে হাঁটুতে পা দিয়ে বাহনে আরোহণ করতেন। প্রত্যেক স্ত্রীই তাঁর কাছে ছিলেন রাণীর মতো। একজন রাণী রাজার কাছ থেকে যতোটা মর্যাদা পায়, তাঁর স্ত্রীরা তার চেয়েও বেশি সম্মান পেতেন।
একবার সব স্ত্রীদের নিয়ে রাসূল (সা) ভ্রমণে বের হলেন। হঠাৎ করেই সাফিয়া (রা) এর উটটি অসুস্থ হয়ে বসে পড়ল। সাফিয়া (রা) এ অবস্থা দেখে কেঁদে ফেললেন। তখন রাসূল (সা) এসে তার চোখের জল নিজ হাত দিয়ে মুছে দিলেন।
আবার, রূপকথায় যেমন ‘অতঃপর রাজা-রাণী একত্রে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’- এমন দেখা যায়, তাঁর জীবন তেমনও ছিল না। তাঁর স্ত্রীরা কখনো কখনো রাগ করে তাঁর সাথে সারাদিন কথা বলতেন না। তিনি সহ্য করতেন। একবার তিনিই রাগ করে এক মাস তাঁর স্ত্রীদের সাথে দেখা করেননি। কারো কোন আচরণে কষ্ট পেলে কখনোই উগ্রপন্থা অবলম্বন করতেন না। যে স্ত্রীর প্রতি মনোক্ষুন্ন হতেন, তার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিতেন। হাসি-ঠাট্টা করা কমিয়ে দিতেন। একসময় সেই স্ত্রীই নিজের ভুল বুঝতে পারতেন। তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতেন।
একদিন ঘরে এসে দেখলেন সাফিয়া (রা) কাঁদছেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, হাফসা (রা), সাফিয়া (রা)-কে ‘ইহুদীর মেয়ে’ বলেছেন। তিনি সাফিয়া (রা) কে সান্তনা দিয়ে বললেন, “তুমি একজন নবীর (হারুনের) কন্যা, একজন নবী (মূসা) তোমার চাচা, আরেকজন নবী তোমার স্বামী। কীভাবে সে (হাফসা) তোমার থেকে উত্তম হয়?”
একজন মানুষকে দূর থেকে দেখলে অসাধারণ মনে হয়। ভুলের উর্ধ্বে মনে হয়। দূরত্ব যত কমে, মানবীয় দূর্বলতা ততো প্রকাশ পায়। কখনো কখনো ভেতরের কদর্য রূপও প্রকাশ পায়, যেটা হয়তো দূর থেকে আমরা চিন্তাও করতে পারি না। এ কারণেই একজন মানুষের ভেতর ও বাহিরের আসল রূপ সবচেয়ে ভালোভাবে জানতে পারে তার জীবনসঙ্গিনী। রাসূল (সা) তাই বলতেন,
“তোমাদের মধ্যে সেই তো সবচেয়ে উত্তম, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আমি আমার স্ত্রীদের নিকট সবচেয়ে উত্তম।”
রাসূল (সা) ছিলেন স্বামী হিসেবে পৃথিবীর সকল স্বামীর রোল-মডেল। তাঁর স্ত্রীরাই সে কথার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। আয়েশা (রা) তাই তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতেন,
“কেন আমার মতো একজন নারী, আপনার মতো একজন পুরুষকে নিয়ে আত্নসম্মানবোধ করবে না?”
সাফিয়া (রা) নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন,
“আমি আল্লাহর রাসূলের চেয়ে উত্তম আচরণের কোন ব্যক্তিকে দেখিনি।”
কখনোই কোন নারীকে তিনি প্রহার করেননি। মানুষদেরকে স্ত্রীদের প্রতি সদয় হবার নির্দেশ দিতেন। বলতেন,
“নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে পাজরের বাঁকা হাড় থেকে। যদি একেবারে সোজা করতে চাও, তাহলে কিন্তু ভেঙ্গে ফেলবে।”
বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি পুরুষদেরকে নারীদের প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
রাসূল (সা) এর জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই উমার (রা) এর মতো কঠোর স্বভাবের মানুষ পর্যন্ত বলেছিলেন,
“একজন মানুষের উচিত তার স্ত্রীর সাথে শিশুর মতো খেলা করা। আর যখন প্রয়োজন তখন বাইরে আসল পুরুষের মতো আচরণ করা।”
তথ্যসূত্র:
তাবাকাত ইবনে সা'দ: ৮/৯১, ড. মুহাম্মদ আবদুল মাবুদ, আসহাবে রাসূলের জীবনকথা: ৮/৩০০।
No comments:
Post a Comment