জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা একটি প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। যার মাধ্যমে মানুষের জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়। ইমাম ইবনে আসির (রহ.) বলেন, মানুষের প্রত্যেকটি প্রশংসনীয় কাজের দুটি নিন্দনীয় দিক আছে। বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি।
আল্লাহ তাআলা চান বান্দা যেন সব ধরনের নিন্দনীয় দোষ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবৃত্ত রাখে। কারণ নিন্দনীয় ও মন্দ কাজ থেকে বান্দা নিজেকে যত দূরত্বে রাখবে ততই সে মধ্যপন্থার দিকে এগিয়ে যাবে। (জামিউল উসুল ১/৩১৮)
আর পৃথিবীতে যত ধর্ম রয়েছে তার মধ্যে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরাই সবচেয়ে বেশি মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। কারণ অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেউ নবীদের প্রভুত্বের সিংহাসনে আসীন করে, কেউ আবার নবীদের অসম্মান করে।
তাই তো আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে সৃষ্টি করে বলেন, ‘এভাবে আমি তোমাদের মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি, যাতে করে তোমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমণ্ডলীর জন্য এবং যাতে রাসুল সাক্ষ্যদাতা হন তোমাদের জন্য।’ (সুরা: বাকারাহ, আয়াত: ১৪৩)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, যেহেতু আল্লাহ মুসলিম জাতিকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছেন তাই তাদেরকে পরিপূর্ণ শরিয়ত, সুগঠিত প্রজ্ঞা এবং সুস্পষ্ট মাজহাবের মাধ্যমে বিশেষায়িত করেছেন।
আল্লামা ইবনে জারির (রহ.) বলেন, উম্মতে মুহাম্মদির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তারা দ্বিনের ব্যাপারে মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী উম্মাহ। যারা দ্বিন নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না, যেভাবে খ্রিস্টানরা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে ঈসা (আ.)-এর মর্যাদার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে।
আবার শিথিলতা প্রদর্শন করে দ্বিনকে উপেক্ষাও করে না যেমন, ইহুদিরা আল্লাহর কিতাবকে পরিবর্তন, নবীদের হত্যা, আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যাচার ও কুফুরির মাধ্যমে দ্বিনকে অবহেলার বস্তু বানিয়েছে। বরং মুসলিম উম্মাহ হলো মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী ও স্থিতিশীল শ্রেষ্ঠ জাতি। (তাফসিরে তাবারি: ৩/১৪২)
ইমাম শাত্বিবি (রহঃ) বলেন, শরিয়ত প্রবর্তনে বান্দার সামর্থ্যের প্রতি ইনসাফের সঙ্গে সর্বোচ্চ খেয়াল রাখা হয়েছে। যেমন : বান্দার নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কষ্ট হবে না, তবে এতে অলসতাও করা যাবে না। যদি কোথাও শরিয়ত প্রণেতার পরিবর্তনের কারণে বা এমন কোনো বিষয় পাওয়া যায়, যার জন্য বাহ্যত মনে হয় এ ক্ষেত্রে কোনো একদিকের পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে এবং শরিয়ত ইনসাফপূর্ণ মধ্যপন্থা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখন বুঝত হবে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে সমতা রক্ষার জন্য।
যেমন- কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগীর শরীরের অবস্থা, জীবনযাপন ও রোগের মাত্রা অনুযায়ী চিকিতসা করে থাকেন। তারপর যখন সে সুস্থ হয় তখন তার শারীরিক অবস্থার প্রতি খেয়াল রেখে সে অনুযায়ী মধ্যপর্যায়ের জীবনাচার ঠিক করে দেন। এমনিভাবে শরিয়তও সর্বদা তার নির্ধারিত সামঞ্জস্যপূর্ণ মধ্যপন্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত।... (আল মুওয়াফাকাত ২/৩৩৯-৩৪০)
তা ছাড়া ইসলাম ধর্মে মধ্যপন্থার এই নীতি কেবল ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং বিশ্বাস, ইবাদত, লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, আইন-কানুন, ভাব ও অনুভূতি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়াবলি, বুদ্ধি, আবেগ, অন্তর ও আদর্শ- সব কিছুতেই ইসলাম মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। যেমন : খরচের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তিরস্কৃত, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৯)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবনযাপনে কৃপণতার নিন্দা করে এবং অপচয়ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাত বলেছেন এতটা নির্দয় কৃপণ হয়ো না যে কাউকে একটি কানাকড়িও দেবে না, আবার এতটা বাড়াবাড়িও করো না নিজের সামর্থ্যের বাইরে ব্যয় করে তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।
ইবাদতে মধ্যপন্থা অবলম্বন প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, মধ্যপন্থা অবলম্বনের অর্থ হলো সঠিক পন্থায় আমল করা এবং ইবাদতে নিজের সাধ্যের প্রতি খেয়াল রাখা। যা করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে তাতে কোনো ঘাটতি না করা। আর সাধ্যাতীত কোনো কাজ না করা।
মহান আল্লাহ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের তাওফিক দান করুন।
রেফারেন্স: মুফতি ইবরাহিম সুলতান
No comments:
Post a Comment