Monday, December 30, 2024

স্ত্রীদের সাথে মহানবীর আচরণ

 নবী চরিত্রে মানুষের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ। যা অনুসরণ করলে মানুষের পার্থিব জীবন যেমন কল্যাণ ও বরকতময় হবে তেমনি আখিরাতে। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে, তাদের জন্য রয়েছে রাসূলুল্লাহ সা:-এর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সূরা আল-আহজাব : ২১) সুতরাং রাসূল সা:-এর উত্তম আদর্শে ওই ব্যক্তি অবশ্যই আদর্শবান হবে, যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী করে এবং সে যেন বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করে। বর্তমান সমাজের অধিকাংশ মুসলমান এই দু’টি গুণ থেকে দূরে সরে গেছে। দুনিয়াবি ফেতনা-ফাসাদের বস্তু নিয়ে অতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের অন্তরে রাসূল সা:-এর আদর্শের কোনো স্থান নেই। নবীপ্রেমের প্রয়োজনীয়তা প্রায় গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। ফলে ইসলামের সৌন্দর্য তারা উপভোগ করতে পারছে না।

এই নিবন্ধে আমরা নবী চরিত্রের একটি দিক ‘স্বামী হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা: কেমন ছিলেন’ এ বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। একজন আদর্শ স্বামী হিসেবে মহানবী সা:-এর জীবনসংশ্লিষ্ট অসংখ্য আদর্শ শিক্ষণীয় ঘটনা রয়েছে মানুষের জন্য। যার সব ঘটনা এই নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে তুলে আনা সম্ভব নয়। তার পরও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অতীব প্রয়োজনীয় কতগুলো বিষয়, যা আমাদের পারিবারিক জীবনের শান্তি ও সমৃদ্ধি বজায় রাখতে গুরুত্ব অবদান রাখবে সেগুলো  এখানে  আলোচনা করা হলোঃ

স্ত্রীদের সাথে আচার-ব্যবহারে রাসূল সা: ছিলেন মানুষের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ। দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে একজন স্বামী তার স্ত্রীর সাথে ইতিবাচক আচরণের মাধ্যমে, কিভাবে তাঁর প্রভাব সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যগুলো দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করে তুলতে পারে তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাসূল সা:। পবিত্র আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে ভদ্রভাবে জীবনযাপন করো:..।’ (সূরা নিসা, ৪:১৯)। স্ত্রীদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে রাসূল সা: হলেন সর্বোত্তম মানুষ। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাছে তোমাদের চেয়ে উত্তম...।’ (সুনানু তিরমিজি : ৩৮৯৫) স্ত্রীদের তিনি সুমধুর আচরণে আগলে রাখতেন। স্ত্রীদের সাথে সুন্দর আচার-ব্যবহার ছিল তাঁর পারিবারিক জীবনের অন্যতম ভূষণ।
স্ত্রীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অসংলগ্ন ও অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণগুলোতে তিনি ধৈর্যধারণ করতেন। তাদের ছোট-খাটো ভুলগুলোকেও তিনি এড়িয়ে যেতেন। দাম্পত্য জীবনের প্রকৃত সুখ বলতে যা আমরা বুঝি তার সবই ছিল রাসূল সা:-এর পরিবারে।

স্ত্রীদের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটানো
স্ত্রীদের সাথে একান্ত সময় কাটানো খুবই উপভোগ্য বিষয়। কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থায় বহুমুখী কর্মব্যস্ততার অজুহাতে অনেক পুরুষ দায়সারাভাবে স্ত্রীদের নামমাত্র সময় দিয়ে থাকেন। অনেকে আবার এটিকে প্রয়োজনীয় বলে মনেও করেন না। ফলে তাদের মধ্যে নানা ধরনের পারিবারিক কলহ লেগেই থাকে। রাসূল সা: এর স্ত্রীরা কখনো স্বামী থেকে দূরে থাকতেন না। প্রতিদিন তারা স্বামীর দেখা পেতেন। এ প্রসঙ্গে উম্মুল মুমিনিন মা আয়েশা রা: বলেন, ‘এমন দিন খুব কমই যেত, যেদিন তিনি আমাদের সবার কাছে আসতেন না। সব স্ত্রীর সাথেই তিনি অন্তরঙ্গ হতেন। তবে সহবাস করতেন না। এরপর যার কাছে রাত যাপনের পালা হতো, তিনি সেখানে রাত যাপন করতেন....।’ (আবু দাউদ : ২১৩৫) স্বামীকে অবশ্যই একটা সময় নির্দিষ্ট করতে হবে স্ত্রীকে দেয়ার জন্য। ফজরের সালাতের পর রাসূল সা: নামাজের স্থানেই বসে থাকতেন। তাকে ঘিরে সাহাবিরাও বসতেন। সূর্য ওঠা পর্যন্ত ওখানেই বসে থাকতেন তারা। এরপর রাসূল সা: একে একে সব ক’জন স্ত্রীর কাছে যেতেন। তাদের সালাম করতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন। এরপর যেদিন যার পালা হতো তার কাছেই চলে যেতেন। অন্য এক হাদিসে আয়েশা রা: বলেন, ‘আসরের পর রাসূল সা: স্ত্রীদের কাছে আসতেন। সবার সাথে দেখা করতেন। এরপর একজনের সাথে একান্তে সময় কাটাতেন।’ (বুখারি : ৫২১৬)

বিশ্বস্ত, অধিকার সচেতন ও স্ত্রীদের প্রতি কৃতজ্ঞ
স্ত্রীদের প্রতি রাসূল সা:-এর আচরণ ছিল মায়া-মহব্বতে পূর্ণ। স্ত্রীর জীবদ্দশায় যেমন তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন তেমনি তার মৃত্যুর পরে তার প্রতি মনের ভালোবাসা বজায় রাখতেন। এমনকি তার স্ত্রীর বান্ধবী ও প্রিয়জনদের সাথেও সসুম্পর্ক বজায় রাখতেন। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে তিনি কোনো সঙ্কোচবোধ করতেন না। খাদিজা রা: সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার অন্তরে তার ভালোবাসা ঢেলে দেয়া হয়েছে।’ (মুসলিম : ২৪৩৫) হজরত খাদিজা রা:-এর আলোচনা এলেই রাসূল সা: তাঁর প্রশংসা করতেন। তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এমনকি কখনো তিনি তাঁর প্রশংসা করতে বিতৃষ্ণাবোধ করতেন না। খাদিজা রা:-এর মৃত্যুর পর তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে স্মরণে রাখতে মোটেই ভুলে যাননি। বরং তাঁকে গুণবতী, জ্ঞানী ইত্যাদি প্রশংসাসূচক শব্দমালায় তার তারিফ ও কল্যাণ কামনা করতেন। খাদিজা রা:-এর কথা মনে পড়ে এমন কোনো বস্তু দেখলে বা এমন কোনো আওয়াজ শুনলে রাসূলুল্লাহ সা: আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। চেহারায় এক ধরনের নির্মল হাসির রেখা ফুটে উঠত। যিনি তাঁর বৈবাহিক জীবনের ৩৮ বছরের ২৫ বছর কাটিয়েছেন খাদিজা রা:এর সাথে। আয়েশা রা:-কে তিনি অত্যন্ত মহব্বত করতেন। তাঁর এই অনুরাগের কথা তিনি গোপন রাখতেন না। আমর বিন আস রা: একবার রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে? রাসূল সা: উত্তর দিলেন, ‘আয়েশা।’ আমর রা: এরপর জানতে চাইলেন, পুরুষদের মধ্যে কে? রাসূল উত্তর দিলেন, ‘আয়েশার বাবা।’ (সহিহ বুখারি : ৩৬৬২)

পানপাত্রের একই স্থানে মুখ লাগিয়ে পানি পান করা
পানপাত্রের যে অংশে মুখ লাগিয়ে আয়েশা রা: পানি পান করতেন ঠিই সেই একই অংশে মুখ লাগিয়ে বিশ^নবী সা: পানি পান করতেন। তাঁর পান করা অবশিষ্ট পানিও তিনি পান করতেন। যদিও তিনি ওই সময় ঋতুবর্তী অবস্থায় ছিলেন। শুধু তাই নয়, আয়েশা সিদ্দিকা রা: তাঁকে গোশতযুক্ত হাড় খেয়ে দিতেন। বিশ^নবী সা: ঠিক সেই একই জায়গায় মুখ লাগিয়ে গোশত খেতেন যেখানে মুখ লাগিয়ে আয়েশা সিদ্দিকী রা: খেয়েছেন।

স্ত্রীর রানের ওপর মাথা রেখে ঘুমানো
আয়েশা রা: বলেন, ‘আমি হায়েজ অবস্থায় থাকলেও নবীজি সা: আমার কোলে ঠেস দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।’ (বুখারি: ৩৬৭২)। একবার এক সফরে আয়েশা রা: এর হার হারিয়ে গেল। ফলে কাফেলাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় থামতে হলো, যেখানে পানি ছিল না। তখন আবু বকর রা: মেয়েকে তিরস্কার করে বললেন, তোমার কারণে পুরো কাফেলা কষ্টে পড়ে গেল। এই সময় তাঁকে তিরস্কারস্বরূপ আবু বকর রা: আঙুল দিয়ে কোমরে ধাক্কা দিতে লাগলেন। আয়েশা রা: বলেন, তখন আমার উরুর ওপর রাসূল সা: মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছেন। রাসূল সা: আমার কোলে ঘুমিয়ে থাকার কারণে আমি একটুও নড়িনি।’ (বুখারি : ৪৬০৭)।

স্ত্রীকে সুন্দর নামে ডাকা
রাসূল সা: আয়েশা রা: কে হুমায়রা নামেও ডাকতেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা: বলেন, ‘কিছু হাবশি বালক মসজিদে খেলাধুলা করছিল। রাসূল সা: আমাকে ডেকে বললেন, হুমায়রা, তুমি কি তাদের খেলাধুলা দেখতে চাও?...’ (আস-সুনানুল কুবরা: ৮৯৫১) এমনকি তিনি আয়েশা সিদ্দিকা রা: কে উম্মে আব্দুল্লাহ উপনামেও ডাকতেন। যদিও তার কখনো সন্তান হয়নি। আদর-সোহাগ ও ভালোবাসা প্রকাশে রাসূল সা: স্ত্রীকে এভাবে সম্বোধন করতেন। আর স্ত্রীদের জন্য সবচেয়ে সুন্দর নামগুলো নির্বাচন করতেন।

কোনো স্ত্রী সাক্ষাতে এলে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন
সাফিয়া রা: বলেন, ‘একবার রাসূল সা: ইতিকাফরত ছিলেন। আমি রাতে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য এলাম। দু’জনে কথাবার্তা বললাম। এরপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে তিনিও আমাকে দিয়ে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালেন...।’ (মুসলিম : ২১৭৫) স্ত্রীর প্রতি সদাচরণ দেখাতে আল্লাহর রাসূল সা: ইতিকাফের মতো জরুরি বিষয়ে থাকার পরও নিজ স্ত্রীকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসেছেন। এমন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না যেখানে দেখা যায়, রাসূল কোনো স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন বা তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা: বলেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ ছাড়া রাসূল সা: কোনো কিছুকে নিজ হাতে প্রহার করেননি। তিনি কোনো স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন আর না কোনো খাদিমের।’ (মুসলিম : ২৩২৮) মহানবী সা: বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর বান্দীদের প্রহার করো না।’ এ কথা শোনার পর উমর রা: রাসূল সা: কাছে এসে বললেন, ‘মহিলারা যদি স্বামীর অবাধ্য হয়।’ এই কথার জবাবে রাসূল সা: মহিলাদের মৃদু প্রহারের অনুমতি দেন। এরপর রাসূল সা:-এর স্ত্রীদের কাছে মহিলারা এসে নিজ নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল। তখন রাসূল সা: বললেন, ‘মুহাম্মদের পরিবারের কাছে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। ওই সব স্বামী ভালো মানুষ নয়।’ (ইবনে মাজাহ : ১৯৮৫) রাসূল সা: বলেন, ‘মুমিন স্বামী তার স্ত্রীকে ঘৃণা করতে পারে না। কারণ, একজন মুমিনের চারিত্রিক কোনো দিক যদি অপছন্দনীয় হয়, অন্য আরেকটি বৈশিষ্ট্য তাকে সন্তুষ্ট করবেই।’ (মুসলিম : ২৬৭২)

স্ত্রীর অনুভূতির প্রতি সচেতনতা
স্ত্রীর অনুভূতির প্রতি সচেতন থাকা প্রত্যেক স্বামীর নৈতিক দায়িত্ব। যা সুন্নাত রাসূল হিসেবে পরিগণিত। প্রিয় নবী সা: এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি বুঝতেন কখন স্ত্রীর উপর সন্তুষ্ট আর কখন অসন্তুষ্ট। মহানবী সা: আয়েশা সিদ্দিকা রা: কে বললেন, আয়েশা, তুমি কখন আমার ওপর খুশি থাকো আর কখন রাগান্বিত হও, তা আমি বুঝতে পারি। আমি বললাম, আপনি কী করে তা বুঝতে পারেন? তখন তিনি বললেন, তুমি আমার উপর প্রসন্ন থাকলে বলো, না! মুহাম্মদের রবের কসম। আর যখন তুমি রেগে থাকো তখন বলো, না! ইবরাহিমের রবের কসম। শুনে আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রাসূল! কেবল আমি আপনার নামটাই মুখে আনি না।’ (বুখারি : ৫২২৮) এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় খুবই উল্লেখযোগ্য তা হলো- আনাস রা: বলেন, একদিন সাফ্যিয়া রা: জানতে পারলেন, হাফসা রা: তাঁকে ইহুদির মেয়ে বলেছেন। এই কথা শুনে সাফ্যিয়া রা: কাঁদতে লাগলেন। নবীজী এসে তাঁকে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় দেখলেন। আর বললেন, কী হয়েছে? তুমি কাঁদছ কেন? তিনি বলেন, হাফসা আমাকে বলেছেন যে, আমি নাকি ইহুদির মেয়ে। রাসূল সা: তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘তুমি একজন নবীর মেয়ে। একজন নবী তোমার চাচা। তুমি একজন নবীর স্ত্রী। সে কীভাবে তোমার উপর গৌরব বোধ করে?’ সুতরাং প্রত্যেক পুরুষেরই উচিত নিজ স্ত্রীর রাগ-অভিমানের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তার অনুভূতির প্রতি সচেতন থাকা, তাহলে সে মানসিক বিষণ্নতা বা সাময়িক দুঃখবোধ থেকে নিজেকে সহজেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

স্ত্রীদের প্রতি নবীজির সহমর্মিতা : সাফিয়্যা বিনতে হুয়াই রা: থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল সা: একবার স্ত্রীদের নিয়ে হজের সফরে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি বাহন থেকে নেমে উটগুলোকে জোরে হাঁকিয়ে চললেন। উটগুলোও দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। এটি দেখে তখন রাসূল সা: বললেন, ‘মহিলাদের নিয়ে সাবধানে চলো।’ এভাবে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আকস্মিকভাবে সাফিয়্যা রা: এর উটটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর এই উটটি দেখতে সবচেয়ে সুন্দর ছিল। উটটিকে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে সাফিয়্যা রা: কেঁদে উঠলেন। এই ঘটনা রাসূল সা:কে জানালে তিনি সাফিয়্যা রা: এর দিকে এগিয়ে এলেন এবং সাফিয়্যা রা:-এর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু নিজ হাতে মুছে দিলেন। এই তুচ্ছ বিষয়টিকেও রাসূল সা: মোটেই অবজ্ঞা করলেন না বরং তার প্রতি পূর্ণ সহমর্মিতা দেখালেন যা স্ত্রীর প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসার প্রকাশ। স্ত্রীর বিপদ-আপদে স্বামীকে এগিয়ে আসতে হয়। তার বিষণœ অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিতে হয়। তখন সে ভাবে, তার পাশে তার স্বামীও রয়েছে। তখন সে নিজেকে অনেক বেশি হালকাভাবে। প্রশান্তির ¯্রােতধারা তার অন্তরে বয়ে যায়।

স্ত্রীদের দেয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ : রাসূল সা: তাঁর কথা ও কাজে এমন সব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যার অনুশীলন আমাদের পারিবারিক জীবনকে শান্তি ও সুখময় করে তুলবে। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক হৃদ্যতাকে আরো বাড়িয়ে দেবে। ‘কোনো একবার আবু বকর রা: রাসূল সা: এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ঐ সময় তিনি আয়েশা রা: কে জোর গলায় রাসূল সা: এর সাথে কথা বলতে শুনলেন। অনুমতি পেয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন। এরপর তিনি আয়েশা রা: কে ‘হে উম্মে রুমানের মেয়ে বলে সম্বোধন করলেন। আর তাঁকে ধরে বললেন, ‘তুমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলছো!’ ঠিক ঐ সময় নবীজি বাবা ও মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন ও আবু বকরকে থামালেন। আবু বকর রা: বের হয়ে গেলে রাসূল সা: আয়েশা রা: কে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বললেন, ‘দেখলে কিভাবে তোমাকে ওই লোকের হাত থেকে বাঁচালাম?’ এর কিছুক্ষণ পর আবু বকর রা: আবারো প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। ভেতরে এসে তাদের দুজনকেই হাসতে দেখলেন।

আর তাদের বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যুদ্ধের সময় আপনারা যেভাবে আমাকে দলে নিয়েছিলেন, সন্ধির সময়ও সেভাবে দলে নিন।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৯২৭) এ প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনা স্মরণযোগ্য তা হলো- উমর রা: বলেন, একবার আমি কোনো একটা ব্যাপারে আমার স্ত্রীর সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলি। তখন আমার স্ত্রীও ঠিক সেই একইভাবে আমার সাথে কথা বলল এবং আমার সাথে তর্ক করল। কিন্তু এটা আমার পছন্দ হলো না। তখন আমার স্ত্রী বলল, ‘আপনি আমার আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করছেন! আল্লাহর কসম, রাসূল সা: এর স্ত্রীরাও তাঁর সাথে রাগ করে কথা বলেন। তাদের কেউ কেউ তো রাগ করে পুরো দিন রাসূল সা: এর সাথে কথা বলেন না। আমি তার কথায় আশ্চর্য হলাম। আমি হাফসার কাছে গেলাম। তাকে বললাম, হাফসা, তোমাদের মধ্যে কি কেউ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নবীজির সা: এর সাথে রাগ করে কথা বন্ধ রাখে? তিনি বললেন, হ্যাঁ...।’ স্ত্রীদের অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণে ধৈর্য ধরা, তাদের ছোটখাটো ত্রুটিগুলো ভুলে যাওয়া, স্বামীর অধিকার আদায়ে ভুল-ত্রুটি হলে তা ক্ষমা করা স্বামীর মহত্বের লক্ষণ। নারীদের সাথে সবসময় ইতিবাচক মনোভাব ও আচরণ বজায় রাখা একজন দায়িত্বশীল স্বামীর পরিচয়। তাদের উপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করা ঘৃণিত কাজ হিসেবে বিবেচিত। সেই কারণে রাসূল সা: নারীদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে কুরাইশদের আচরণ ছেড়ে আনসারদের আচরণ গ্রহণ করেন।

স্ত্রীর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ :  নবী সা: তাঁর হাজারও কর্মব্যস্ততার মাঝেও স্ত্রীদের প্রতি দায়িত্ব কখনো ভুলে যেতেন না। তাদের মানসিক প্রশান্তি লাভের দিকে তিনি সবসময় খেয়াল রাখতেন। এ প্রসঙ্গে আয়েশা রা: বলেন, ‘একবার আমি রাসূল সা: এর সাথে সফরে বের হলাম। তখনো আমি কিশোরী। শারীরিকভাবে হালকা ছিলাম। শরীরে তেমন মেদ জমেনি। রাসূল সা: সাহাবিদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। রাসূল সা: এর নির্দেশে তারা এগিয়ে গেল। এরপর রাসূল সা: আমাকে বললেন, চলো, দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমরা প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। দৌড় প্রতিযোগিতায় আমি তাঁকে হারিয়ে দিলাম। তিনি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকলেন। (এর অনেক দিন পর) আমার শরীর মোটা হতে লাগল। দেহে মেদ জমল। ততদিনে আগের প্রতিযোগিতার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কোনো এক সফরে রাসূল সা: সাহাবিদের বললেন, তোমরা এগিয়ে যাও। রাসূল সা: এর আদেশে তারা এগিয়ে গেল। তারপর তিনি আমাকে বললেন, চলো, দৌড় প্রতিযোগিতা করি। আমি এবারও প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করলাম। এবার তিনি আমাকে পেছনে ফেলে দিয়ে বিজয়ী হলেন। হাসতে লাগলেন। বললেন, এই বিজয় সেই বিজয়ের বদলা।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২৫৭৪৫; আবু দাউদ : ২৫৭৮ ও ইবনে মাজাহ : ১৯৭৯)

সূত্র: মুহাম্মদ মিজানুর রহমান


No comments:

Post a Comment