Saturday, December 21, 2024

পাপ কখনো চাপা থাকে না

 এটিএম এর সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধা মা। ঝুঁকে পড়েছেন বয়সের ভারে। হাতে একটা ছোট কাপড়ের ব্যাগ। আর এক হাতে ফোন। ব্যাগের ভিতর কিছু কাগজপত্র উঁকি দিচ্ছে। আমি ঢুকতে যাচ্ছি এটি এম রুমে, হঠাৎ বৃদ্ধা টেনে ধরলেন হাতটা। বাবা তুমি টাকা তুলবে? ভাবলাম গেল বোধ হয় কিছু। বললাম ''বলুন কি চাই'' ?

আমার ধারণা মিথ্যা প্রমানিত করে বৃদ্ধা বললেন , আমার কিছু টাকা তুলে দেবে বাবা? আমি ওই ঘরে ঢুকতে ভয় পাই। আমার খুবই প্রয়োজন টাকার।আমি বললাম চলুন ভেতরে। বৃদ্ধা বললেন না বাবা আমি ওই ঠান্ডা ঘরে যেতে পারব না। আমি বাইরে থাকছি তুমি তুলে এনে দাও। এই নাও এটিএম কার্ড। টাকা তোলার নম্বরটা হল ১২ ১২। আমি অবাক। এই ভাবে এটিএম এর পিন কেউ বলে দেয়?
বললাম এই নম্বর কাউকে বলতে নেই। উনি বললেন তাতে কি হয়েছে? তুমি কি বেশী টাকা তুলে নেবে?
না না সেটা পারবেনা। অগত্যা বললাম বলুন কত টাকা। বাবা ন হাজার টাকা তুলবে।
দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। আমি ন হাজার পরপর তিন বার তুললাম। ন হাজারের বেশী হলে ফোনে ওটিপি যাবে জানি। সেই জন্যই ন হাজার করেই তুললাম। অর্থাৎ আঠারো হাজার টাকা পেলাম। ভাবলাম এতে আর কি এমন পাপ হবে?এমন খারাপ কাজ করিনি কোনদিন। কিন্তু আজ আর লোভ সামলাতে পারলাম না। বাবার অপারেশনের খরচাটা হয়ে যাবে। বাবা আবার ভালো করে হাঁটতে পারবেন। নিলাম টাকাটা। গরীবের সব সময় ন্যায় নীতি দেখলে চলে না।
এরপর নিজের দু হাজার টাকা তুললাম। বাইরে বেরিয়ে ন হাজার টাকা বৃদ্ধার দিকে বাড়িয়ে বললাম '' নিন মা। ন হাজারই তুললাম। একটু হেসে বৃদ্ধা টাকাটা নিলেন। এটিএম কার্ডটাও ফেরৎ দিলাম। বৃদ্ধা অনেক আর্শীবাদ করলেন।
তারপর বললেন," এতগুলো টাকা নিয়ে যাবো?আমার বড় ভয় হচ্ছে। একটু সাথে যাবে বাবা? তুমি তো বাস থেকে নামলে দেখলাম। তোমার তো গাড়ি নেই। ঐ সামনেই বোস পাড়ার বোধোদয় ক্লাবের উপর তলায় আমি থাকি। নীচটা ছেড়ে দিয়েছি ক্লাব করার জন্য। অনেক দিন ধরেই বলছিল ছেলে গুলো। অনেক ছেলে থাকে ক্লাবে সবসময়। ওরাই তো আমায় দেখে অসময়ে। একা মানুষ। এত বড় বাড়ি। ওখানে পৌঁছে দিলেই হবে। ওই যে টোটোটা যাচ্ছে ডাক ওটাকে।"
উঠে বসলাম টোটোতে‌। বৃদ্ধা খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। বললাম একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারী আমি। মাইনেতো আর বেশী পাইনা। বিয়ে করেছি। একটি ছেলেও আছে। ওকে স্কুলে ভর্তি করব এবার। বাবা অসুস্থ। প্রায়ই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। স্নায়ুর গোলমাল। কোলকাতা নিয়ে গিয়ে অপারেশন করালে সারবে। এখন হাঁটতে পারেনা। অপারেশন হলে হাঁটতে পারবে। কিন্তু কুড়ি হাজার টাকা খরচ। কোথায় পাবো? চেষ্টা করছি যদি জোগাড় করতে পারি। তাহলে বাবা আবার আগের মত সুস্থ হয়ে যাবেন।স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারবেন। এসে গেছি ওনার বাড়ীর কাছে। আমি বললাম আমি তাহলে আসি মা। বৃদ্ধা মা কিন্তু ছাড়বেন না। বললেন তাকি হয় বাবা? আমার বাড়িতে এসে একটু মিষ্টি মুখ না করে চলে যাবে? চলো ওপরে। নীচে সিঁড়ির পাশে ক্লাব ঘর। ক্লাব ভর্তি ছেলে। সবাই দেখছে আমাদের। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম।
একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। তবে যে বললেন একা থাকি‌? বৃদ্ধা মা বললেন ও কমলী। কথা বলতে পারেনা। তবে শুনতে পায়। আমার রান্না বান্না থেকে সব ওই করে। শুধু টাকা তোলার কাজটা পারেনা। বিরাট বড় বাড়ি। সামনের ঘরে আমাকে বসতে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন বৃদ্ধা।ভাবলাম পালিয়ে যাই। কিন্তু তা আর হল না। বৃদ্ধা মা ইসারা করতেই কমলী মিষ্টি এনে দিল। অনেক গুলো মিষ্টি। সাথে কয়েকটা কাজু কিসমিস।তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেললাম। আমি তাড়াতাড়ি পালিয়ে যেতে পারলে যেন বেঁচে যাই।
বললাম, ''আমি আসি মা এবার''।
বৃদ্ধা বললেন ,''একটু দাঁড়াও বাবা আমি এক্ষুনি আসছি। বলে আবার ঢুকে গেলেন ভিতরে। বৃদ্ধা যখন ফিরে এলেন তখন ওনার হাতে দু হাজার টাকা। বললেন,'' বাবা এটা নাও''।
আমি বললাম,'' এটা আবার কেন দিচ্ছেন? আমি আপনাকে টাকা তুলতে একটু সাহায্য করেছি মাত্র। তার জন্য আবার টাকা কেন?''
আমাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন,'' ওই যে তোমার বাবার অপারেশন করাতে কুড়ি হাজার খরচ বললে। তোমার কাছে তো আঠারো হাজার আছে, এই দুই হাজার না নিলে তো হয়ে যাবে। তুমি যখন টাকা তুললে তিনবার, তখন আমার ফোনে পরপর তিন বার ম্যাসেজ এল। ন হাজার করে তিনবার তোলা হল। আমি তো রিটায়ার্ড শিক্ষিকা।মূর্খ তো আর নই। আমার স্বামী অধ্যাপক ছিলেন। এটি এম এর ঠান্ডা ঘরে টাকা তুলতে গিয়ে আমার চোখের সামনেই স্ট্রোক হয়ে মারা যান। সেই থেকে আমি এটিএম এর ঐ ঠান্ডা ঘরে ঢুকিনা। তারপর থেকে এটিএম এ যাই না। ওখানে ঢুকলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় এ সেই ঠান্ডা ঘর যেখানে চিরঘুমে ঢলে পড়েছিল আমার প্রানবন্ধু।তোমাকে বাড়িতে এনেছিলাম টাকাটা ফেরৎ নেব বলে। ক্লাবের ছেলেদের বললে ওরাই টাকাটা আদায় করে দিত তোমার কাছ থেকে। কিন্তু তোমার চুরির উদ্দেশ্য শুনে বুঝলাম তুমি চোর নও। ভীষণ ভালোবাসো তোমার বাবাকে। যে সন্তান চুরি করে বাবার চিকিৎসার জন্য সে তো চোর নয় বাবা। সে এক অসহায় অসমর্থ সন্তান। যে ইচ্ছা থাকলেও বাবার চিকিৎসা করাতে পারেনা।''
আমি নতজানু হয়ে বৃদ্ধা মায়ের পায়ের কাছে ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া টাকাগুলো রেখে পাদুটো জড়িয়ে ধরে বললাম, ''আমাকে ক্ষমা করে দিন মা। আর কখনো এমন করবোনা। উনি আমাকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো জল। চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে উনি বললেন," যাও। বাবাকে সুস্থ করে তোল। আরো টাকা লাগলে বলো।'' এক করুনাময়ী নারীর মাতৃ স্নেহে স্নান করে শপথ নিলাম জীবনে আর কোনদিন অন্যায় করবোনা।
বর্তমান সমাজে এতটুকু অন্যায়কে তো কেউ পাপই মনে করে না!"
-সংগ্রহ করা
May be an image of card, plant and text
d 1 other

No comments:

Post a Comment