Wednesday, April 15, 2020

দিন যায়, কথা থাকে

বড় বোন ‘আবিদা খাতুনকে আমি দেখিনি। তাকে মনেও পড়েনা। মায়ের মুখে শুনেছি বড় বোন গত হয়েছে যখন অমি ৩ কি ৪ বছরের। বাবার মুখে আরো পরে বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছি বোনটি আমার ছিল অপরূপা। আরো বড় হলে আমার তৃতীয় বোনকে দেখেছি সে ও ছিল অপরূপা। ডাক নাম ছিল জোস্না। আরেক নাম রাইসুন্নিছা। সত্যিই যেন জোস্না। রূপে ঝলমল। বোনকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করতাম। সে ও আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতো। কি যে ভালবাসতো যার বোন নাই যে কোন দিন বুঝবেনা। বোনের বাড়ী যেতাম সুযোগ পেলেই। তার বাড়ী দূরে। তাই হেঁটেই যেতে হতে গাঁয়ের পথ ধরে। বড় ভাল লাগতো সর্পিল আকারের মেঠো পথ ধরে হেঁটে যেতে। বোনের বাড়ীর মাটির ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছিল তারই তৈরী করা কাপড়ের ওপরে সূঁই-সুতোর কাজ বাঁধানো ফ্রেমে। লেখা ছিল “দিন যায় কথা থাকে।” ওই বাঁধানো ফ্রেমে লেখাটির কথা মনে হলে এখনো আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। প্রিয় সহোদারার মুখখানা সামনে চলে আসে। বোন নেই- কিন্তু আমার কাছে তার স্মৃতিটা ফেলে গেছে। আমিও আমার ছেলে বেলা- বোনের গাঁয়ের বাড়ীতে ফেলে এসেছি।
আজ সঙ্গ নিরোধের ২০তম দিনে “দিন যায়, কথা থাকে”- এ বাক্যটি মনে হতেই সূরা আল ‘আসর’কে মনে এলো গভীরভাবে। এ সূরায় এ কথার ওপর সময়ের কসম খাওয়া হয়েছে যে, মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে এবং এই ক্ষতি থেকে একমাত্র তারাই রক্ষা পেয়েছে যারা চারটি গুণাবলীর অধিকারী:
(১) ঈমান
(২) সতকাজ
(৩) পরস্পরকে হকের উপদেশ দেয়া এবং
(৪) একে অন্যকে সবর করার উপদেশ দেয়া৷
আল্লাহর এই বাণীর অর্থ সুস্পষ্টভাবে জানার জন্য এখন এখানে প্রতিটি অংশের ওপর পৃথকভাবে চিন্তা -ভাবনা করা উচিত৷ ইমাম রাযী এই পর্যায়ে একজন মনীষীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন৷ তিনি বলেছেন: "একজন বরফওয়ালার কাছে থেকে আমি সূরা আসরের যথাযথ অর্থ বুঝেছি৷ সে বাজারে জোর গলায় হেঁকে চলছিল, “দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পূঁজি গলে যাচ্ছে৷ দয়া করো এমন এক ব্যক্তির প্রতি যার পূঁজি গলে যাচ্ছে৷” তার একথা শুনে আমি বললাম, এটিই হচ্ছে বাক্যের আসল অর্থ৷ মানুষকে যে আয়ুষ্কাল দেয়া হয়েছে তা বরফ থেকে পানি হয়ে যাবার মতো দ্রুত গলে যাচ্ছে৷ একে যদি নষ্ট করে ফেলা হয় অথবা ভুল কাজে ব্যয় করা হয় তাহলে সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতি৷ "কাজেই দ্রুত ধাবমান সময়ের কসম খেয়ে এই সূরায় যে কথা বলা হয়েছে তার অর্থ এই যে, এই দ্রুত গতিশীল সময় সাক্ষ দিচ্ছে, এই চারটি গুণাবলী শূন্য হয়ে মানুষ যে কাজের নিজের জীবন কাল অতিবাহিত করে তার সবটুকুই ক্ষতির সওদা বৈ নয়? এই চারটি গুণে গুণান্বিত হয়ে যারা দুনিয়ায় কাজ করে একমাত্র তারাই লাভবান হয়৷ এটি ঠিক তেমনি ধরনের একটি কথা যেমন একজন ছাত্র পরীক্ষার হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রশ্ন পত্রের জবাব দেবার পরিবর্তে অন্য কাজে সময় নষ্ট করছে তাকে আমরা হলের দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে অংগুলি নির্দেশ করে বলি: এই দ্রুত গতিশীল সময় বলে দিচ্ছে তুমি নিজেই ক্ষতি করছো৷ যে ছাত্র এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব দেবার কাজে ব্যয় করছে একমাত্র সে ই লাভবান৷
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ডাক-গাড়ী কবিতায় দ্রুত ধাবমান “ওয়াক্ত” বা “সময়ের” প্রতিধ্বনি করেছেন নিখুঁতভাবেঃ
ডাক-গাড়ী
অন্ধকারের অতল অন্ধকারে
ডাক-গাড়ী শুধু ডাক নিয়ে চলে
শুধু চলে আর চলে
কোথা ভেসে যায় লাঞ্ছিত বুক বেদনা- অশ্রুজলে
আর কোথা মরে ক্ষয়মাণ প্রাণ নিপীড়িত পলে পলে-
সে সকল দিকে তাকায়না ডাক-গাড়ী
গাঢ় আঁধারের বুক চিরে চিরে শুধু
রাত্রির পথে চলে।
২.
ডাক-গাড়ী চলে নিশীথের কালা তন্দ্রা ছিন্ন করে’
পার হয়ে কত বিনিদ্র বিভাবরী-
কত দেশ দেশ ঘুরে
অজানা অচেনা সুরে
কত সে আশায় দোল খেয়ে আর নিরাশায় দিয়ে পাড়ি
পথে চলে ডাকগাড়ী।
৩.
ডাক-গাড়ী চলে আনমনে বেগে, কখনো পিছন ফিরি’
দেখেনা সে কত অশ্রু জমেছে আঁখির তারকা ঘিরি’,
কত যে যাত্রী এল আর গেল খবর নাহিতো তার
কত যে যাত্রীনী বাতায়নে এসে হাসিল যে শেষ বার
সে দিকে তাহার খেয়াল নাহিক মোটে
চপল চলার পাগল নেশায় স্মৃতি সব পথে লোটে।
৪.
তুমি বলে যাবে, ভয় নাই কোন, মোর মনে ভয় জাগে
সময় কাটেনা আনন্দে অনুরাগে;
যে ডাক গাড়ীর পান্থ আমরা হায়,
সে-গাড়ী কখনো ফেল হ’লে আর খুঁজে নাহি পাওয়া যায়।
৫.
ডাক-গাড়ী চলে মাঝে মাঝে থেমে বিশ্রাম-মঞ্জিলে
আর্তনাদের বুক-ভাঙা সুর বেজে উঠে হুইসিলে
বেজে উঠে হুইসিলে
সারাটি জনম চালালে শুধুই থির নাহি হ’তে দিলে।
৬.
ডাক-গাড়ী চলে বিশ্রামহীন, শুধু চলে-শুধু চলে
আমারো চলার বিরাম নাহি যে কালো জীবনের তলে,
কালো জীবনের তলে
আমি চলি, সাথে ডাক-গাড়ী চলে- নিরাশায় পথ চলে।
-এ চলা নিখিল মানব জাতির। সময়ের সাথে চলা। আমাদের সকলের ভাষা সকলের অন্তর্লোকের গভীর অনুভূতি এখানে মুর্ত হয়ে উঠেছে। এ যেন সেই আপ্ত বাক্য-প্রতিধ্বনিত উচ্চারণ “টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান।” ডাকগাড়ী কখনো কখনো বিরতির স্টেশনে থেমে আবার ছেড়ে যায় হুইশেল বাজিয়ে। বুক চেরা সে হুইশেলের আর্তনাদ যাত্রীদের সচেতন করে দিয়ে যায়। ঘুর্ণায়মান মহাজাগতিকতার আবর্তমান পৃথিবীতে ‘গতিতে জীবন মম স্থিতিতে মরণ’- এ দার্শনিক তত্ত্বই এখানে ফুটে উঠেছে প্রবলভাবে।
কবি যতীন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত তার “হাট” কবিতার কিয়দংশে জীবনকে এভাবে দেখিয়েছেন সময়ের প্রেক্ষিতে-
“দিবসেতে সেথা কত কোলাহল চেনা অচেনার ভীড়ে
কতনা ছিন্ন চরণচিহ্ন ছড়ানো সে ঠাঁই ঘিরে
মাল চেনাচিনি দর জানাজানি
কানাকড়ি নিয়ে কত টানাটানি
হানাহানি ক‘রে কেউ নিলো ভরে কেউ গেল খালি ফিরে,
দিবসে থাকেনা কথার অন্ত চেনা অচেনার ভীড়ে।
কত যে আসিল, কত না আসিছে কত না আসিবে হেথা
ওপারের লোক নামালে পসরা ছোটে এপারের ক্রেতা।”
সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment