আমরা যারা বাংলাদেশে ও সারা বিশ্বে কোয়ারেন্টাইন নামের খাঁচায় রয়েছি, সঙ্গ নিরোধে রয়েছি তারা অবশ্যই (আগে না জানলে এখন) বন্দীদশা বিষয়ে সম্যক ওয়াকিফহাল।
করোনা ভাইরাসের আঘাত হানার আগে ভোর বেলা যখন মসজিদে যেতাম তখন বিভিন্ন বাড়ীর ঝুল-বারান্দা থেকে বিভিন্ন পাখীর ডাক বিশেষতঃ ঘুঘু পাখীর করুন ডাক কানে ভেসে আসতো। ২-১ জন মুসল্লীকেও বলতাম যারা এই পাখীগুলোকে বন্দী করে রেখেছে তাদের উচিত হবে এদেরকে মুক্তি দেয়া। প্রাণিবিদ্যায় পড়ার কারণে আমার ভেতরে এই অনুভুতিটা প্রচ্ছন্ন না থেকে প্রকট হয়েছে। আরো মনে পড়তো, “দুপুরে ঘুঘুর ডাক আমের শাখায়, আমাদের দু’ নয়নে ঘুম দিয়ে যায়।”(চৈতালী কবিতা)
অরো আগে- ৮ ক্লাশে পড়বার সময় যখন রবীন্দ্রনাথের “দুই পাখী” কবিতাটি পড়ি- তখন থেকেই মনে মনে মুক্তির স্বাদ পেয়েছি।
আমার এই অনুভুতির অনুরণন দেখেছি সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটি কোটেশনে, “বণ্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।”
সঞ্জিব বাবু (বঙ্কিমচন্দ্রের সহোদর) একবার বন বিহারের লক্ষ্যে আসামের “পালাম” শাল বনে গিয়েছিলেন। সেখানে যেয়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেখানে প্রকৃতির বৈচিত্রময় ও অপরূপ খেলা। ভয়াল বন্য পশুরা থাকলেও তিনি সাহসে ভর করে শালবনের কিছুটা ভেতরে গেলে তিনি তো অবাক, চারদিকে পশু-পাখির অবাধ বিচরণ এবং কল-কাকলীতে মুখরিত। বিচরণকারী পশু-পাখির এতটুকু ভয়-ডর নেই। এটাই বোধ হয় প্রকৃতির স্বাভাবিক ও সহজাত বৈশিষ্ট্য বলে তিনি মনে করলেন। এটি তো আর পশু-পাখির জন্য মানুষের গড়া সাফারী পার্ক বা চিড়িয়াখানা নয়? সবকিছু প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত, মানুষের নিয়ন্ত্রণে নয়। সাহিত্যিক শ্রী সঞ্জিব বাম দিকে পায়ে হাঁটা-সরু-রাস্তার মতো দেখলেন। তাই তিনি আর গভীরে না যেয়ে, শিমুল গাছের পাশ দিয়ে দূর্বাঘাস বিছানো গালিচা স্বরূপ পথ ধরে ডান দিকে মোড় নিয়ে এগুতে লাগলেন। হঠাত্ তার চোখে পড়লো টিলার উপর একটি কুঁড়ে ঘরে একজন যুবতী উপজাতি নতুন মা তার একটি ছোট বাচ্চাকে স্তন পান করাচ্ছে। কিন্তু মায়ের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, সে তালপাতা দিয়ে পাখা বানাচ্ছে তো বানাচ্ছেই। এই বিরল বাস্তব ছবি দেখে সঞ্জিব বাবু অবাক হয়ে ঐ দিকে তাকিয়ে আছেন, কোন কিছু খেয়াল নেই। হঠাত একটি বনমোরগ কোঁক-কোঁ করে ডেকে উঠলে তাঁর আবেগপূর্ণ দৃষ্টি আবার নড়ে উঠলো। তিনি আর ওখানে না দাঁড়িয়ে সোজা বাড়ী ফিরে আসলেন। তবে একটি কথা তাঁর মনের আঙ্গিনায় খুবই উঁকি-ঝুঁকি দিতে লাগলো, তা হলো স্বাভাবিকতায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা কিছু হয়ে থাকে বা ঘটে তাই শাশ্বত সত্য ও চিরন্তন সুন্দর। তাই লিখলেন-
“বন্যরা বনে সুন্দর,
শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।”
তাই বলছি আসুন আমরা মানবিক হই। আমাদের বাড়ীর খাঁচায় যত পাখী আছে তাদের ছেড়ে দিই, আলগা করে দিই। ওরা উড়ুক নীলান্তে। দেখবেন আপনাদের বিশেষ ভাল লাগবেই।
মনে করিয়ে দিইঃ
দুই পাখী কবিতাখানি। সূচিত্রা মিত্রের কন্ঠে কবিতাটি শুনলে মনটা ভরে যাবে:
লিঙ্ক: Khnachar Pakhi Chhilo(খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে) -Suchitra Mitra (1978)
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
বনেতে যাই দোঁহে মিলে।
খাঁচার পাখি বলে-- বনের পাখি, আয়
খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।'
বনের পাখি বলে-- "না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব!'
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার--
দোঁহার ভাষা দুইমতো।
বনের পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
বনের গান গাও দিখি।
খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,
খাঁচার গান লহো শিখি।
বনের পাখি বলে-- না,
আমি শিখানো গান নাহি চাই।'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি কেমনে বন-গান গাই।'
বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল,
কোথাও বাধা নাহি তার।'
খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারি ধার।'
বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে।'
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে
বাঁধিয়া রাখো আপনারে!'
বনের পাখি বলে-- "না,
সেথা কোথায় উড়িবারে পাই!'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই!'
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
কাতরে কহে, "কাছে আয়!'
বনের পাখি বলে--না,
কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
খাঁচার পাখি বলে--হায়,
মোর শকতি নাহি উড়িবার।
No comments:
Post a Comment