Thursday, April 5, 2018

মুখের কথার ব্যবহার ও অপব্যবহার বিষয়ে আল কুরআন কি বলে?


আল কুরআন বার বার বলেছে যে, মানুষের কথা বলবার ক্ষমতা আল্লাহ পাকের এক সুমহান নিয়ামাত তাই এর সঠিক ব্যবহার হওয়া উচিত কথা বলার যোগ্যতা মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে আল কুরআন স্পষ্টভাবেই বলেছে যে প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে ভদ্র, সুন্দর এবং অর্থপূর্ণ কথা বলা আর সেই সাথে কথার অপব্যবহার না করা আর কুরআন একটি উপমা দিয়ে বলেছে যে ভাল কথা এমন এক বৃক্ষের মত যার শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত আর খারাপ এমন এক বৃক্ষের মত যার নেই কোনই ভিত্তিমূল আর কুরআন আরো বলেছে যে আল্লাহর দেয়া কথা বলবার ক্ষমতা আর অন্যের সাথে ভাব বিনিময়ের যোগ্যতা প্রতিটি মানুষ যেন সচেতনভাবে আর দায়িত্বের সাথে ব্যবহার করে
রেফারেন্স ০১. আল কুরআন থেকে: এবং তাকে কথা শিখিয়েছেন 'Allamahul bayaan (সূরা আর রাহমান, আয়াত ০৪)
. এর একটি অর্থ হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করা অর্থা কোন কিছু বলা এবং নিজের উদ্দেশ্যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করা৷ দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে পার্থক্য বৈশিষ্ট স্পষ্ট করে তোলা৷ এখানে এর অর্থ হচ্ছে ভাল মন্দ কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যকার পার্থক্য৷ দুটি অর্থ অনুসারে ক্ষুদ্র আয়াতাংশটি ওপরে বর্ণিত যুক্তি প্রমাণকে পূর্ণতা দান করে৷ বাকশক্তি এমন একটি বিশিষ্ট গুণ যা মানুষকে জীবজন্তু পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিকূল থেকে পৃথক করে দেয়৷ এটা শুধু বাকশক্তিই নয়৷ এর পেছনে জ্ঞান বুদ্ধি, ধারণা অনুভূতি, বিবেক সংকল্প এবং অন্যান্য মানসিক শক্তি কার্যকর থাকে যেগুলো ছাড়া মানুষের বাকশক্তি কাজ করতে পারে না৷ এজন্য বাকশক্তি প্রকৃতপক্ষে মানুষের জ্ঞানী স্বাধীন সৃষ্টজীব হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ৷ আর আল্লাহ তা'আলা বিশেষ গুণটি যখন মানুষকে দান করেছেন তখন এটাও স্পষ্ট যে, জ্ঞান অনুভূতি এবং ইখতিয়ারবিহীন সৃষ্টিকূলের পথ প্রদর্শনের জন্য শিক্ষার যে প্রকৃতি পদ্ধতি উপযুক্ত হতে পারে মানুষের শিক্ষার প্রকৃতি পদ্ধতি তা হতে পারে না৷ একইভাবে মানুষের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ গুণ হলো আল্লাহ তায়ালা তার মধ্যে একটি নৈতিক অনুভূতি (Moral sense) সৃষ্টি করে দিয়েছেন যার কারণে সে প্রকৃতিগতভাবেই ভাল মন্দ, ন্যায়, অন্যায়, জুলুম ইনসাফ এবং উচিত অনুচিতের মধ্যে পার্থক্য করে এবং চরম গোমরাহী অজ্ঞতার মধ্যেও তার ভিতরের আত্মজ্ঞান অনুভূতি লোপ পায় না৷ দুটি বিশেষ বৈশিষ্টের অনিবার্য দাবী হচ্ছে মানুষের জ্ঞানলোক সমৃদ্ধ স্বাধীন জীনের জন্য শিক্ষাদানের পন্থা পদ্ধতি জন্মগতভাবে লব্ধ শিক্ষা পদ্ধতি-যার সাহায্য মাছকে সাঁতার কাটা, পাখীকে উড়ে বেড়ানো এবং মানুষের নিজ দেহের মধ্যে চোখের পাতাকে পলক ফেলা, চোখকে দেখা, কানকে শোনা এবং পাকস্থলীকে হজম করা শেখানো হয়েছে-থেকে ভিন্ন হতে হবে৷ জীবনের ক্ষেত্রে মানুষ নিজেও শিক্ষক, বই পুস্তক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার -প্রোপাগাণ্ডা ধর্মীয় শিক্ষা, লেখা, বক্তৃতা, বিতর্ক যুক্তি প্রমাণের মত উপায় উপকরণকেই শিক্ষা মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করে এবং শুধু জন্মগতভাবে লব্ধ জ্ঞানকে যথেষ্ট মনে করে না৷ তাহলে মানুষের স্রষ্টার ওপরে তাদের পথ প্রদর্শনের যে দায়িত্ব বর্তায় তা সম্পাদন করার জন্য যখন তিনি রসূল কিতাবকে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন তখন তা বিস্ময়ের ব্যাপার হবে কেন? সৃষ্টি যেমন হবে তার শিক্ষাও তেমন হবে এটা একটা সহজ যুক্তিগ্রাহ্য কথা৷  যে সৃষ্টিকে শেখানো হয়েছে তার জন্য 'কুরআন' হতে পারে শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম৷ যেসব সৃষ্টকে 'বায়ান' শেখানো হয়নি তাদের উপযোগী শিক্ষা মাধ্যম 'বায়ান' শেখানো হয়েছে এমন সৃষ্টির জন্য উপযোগী হতে পারে না৷ 
. তুমি কি দেখছো না আল্লাহ কালেমা তাইয়েবার উপমা দিয়েছেন কোন্জিনিসের সাহায্যে? এর উপমা হচ্ছে যেমন একটি ভালো জাতের গাছ, যার শিকড় মাটির গভীরে প্রোথিত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে পৌঁছে গেছে৷ Alam tara kaifa darabal laahu masalan kalimatan taiyibatan kashajaratin taiyibatin asluhaa saabitunw wa far'uhaa fis samaaa' (সূরা ইব্রাহিম আয়াত ২৪)
"কালেমা তাইয়েবা"র শাব্দিক অর্থ "পবিত্র কথা" কিন্তু এ শব্দের মাধ্যমে যে তাতপর্য গ্রহণ করা হয়েছে তা হচ্ছে, এমন সত্য কথা এবং এমন পরিচ্ছন্ন বিশ্বাস যা পুরোপুরি সত্য সরলতার ওপর প্রতিষ্ঠিত উক্তি আকীদা কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে অপরিহার্যভাবে এমন একটি কথা ও বিশ্বাস হতে পারে যার মধ্যে রয়েছে তাওহীদের স্বীকৃতি, নবীগণ ও আসমানী কিতাবসমূহের স্বীকৃতি এবং আখেরাতের স্বীকৃতি৷ কারণ কুরআন এ বিষয়গুলোকেই মৌলিক সত্য হিসেবে পেশ করে৷
অন্য কথায় এর অর্থ হলো, পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থা যেহেতু এমন একটি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত যার স্বীকৃতি একজন মুমিন তার কালেমা তাইয়েবার মধ্যে দিয়ে থাকে, তাই কোন স্থানের প্রাকৃতির আইন এর সাথে সংঘর্ষ বাধায় না, কোন বস্তুর আসল, স্বভাব ও প্রাকৃতিক গঠন একে অস্বীকার করে না এবং কোথাও কোন প্রকৃত সত্য ও সততা এর সাথে বিরোধ করে না৷ তাই পৃথিবী ও তার সমগ্র ব্যবস্থা তার সাথে সহযোগিতা করে এবং আকাশ তথা সমগ্র মহাশূন্য জগত তাকে স্বাগত জানায়৷

অন্যদিকে অসত বাক্যের উপমা হচ্ছে, একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়, যার কোন স্থায়িত্ব নেই৷ Wa masalu kalimatin khabeesatin kashajaratin khabee satinij tussat min fawqil ardi maa lahaa min qaraar (সূরা ইব্রাহিম আয়াত ২৬)
এটি কালেমা তাইয়েবার বিপরীত শব্দ৷ যদিও প্রতিটি সত্য বিরোধী ও মিথ্যা কথার ওপর এটি প্রযুক্ত হতে পারে তবুও এখানে এ থেকে এমন প্রতিটি বাতিল আকীদা বুঝায়, যার ভিত্তিতে মানুষ নিজের জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলে৷ এ বাতিল আকীদা নাস্তিক্যবাদ, নিরীশ্বরবাদ, ধর্মদ্রোহিতা, অবিশ্বাস শিরক, পৌত্তলিকতা অথবা এমন কোন চিন্তাধারাও হতে পারে যা নবীদের মাধ্যমে আসেনি৷
৩৮. অন্য কথায় এর অর্থ হলো, বাতিল আকীদা যেহেতু সত্য বিরোধী তাই প্রাকৃতিক আইন কোথাও তার সাথে সহযোগিতা করে না৷ বিশ্ব জগতের প্রতিটি অণুকণিকা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে৷ পৃথিবী ও আকাশের প্রতিটি বস্তু তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়৷ জমিতে তার বীজ বপন করার চেষ্টা করলে জমি সবসময় তাকে উদগীরণ করার জন্য তৈরী থাকে৷ আকাশের দিকে তার শাখা প্রশাখা বেড়ে উঠতে থাকলে আকাশ তাদেরকে নিচের দিকে ঠেলে দেয়৷ পরীক্ষার খাতিরে মানুষকে যদি নির্বাচন করার স্বাধীনতা ও কর্মের অবকাশ না দেয়া হতো তাহলে এ অসতজাতের গাছটি কোথাও গজিয়ে উঠতে পারতো না৷ কিন্তু যেহেতু মহান আল্লাহ আদম সন্তানকে নিজের স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবণতা অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ দান করেছেন, তাই যেসব নির্বোধ লোক প্রাকৃতিক আইনের বিরুদ্ধে লড়ে এ গাছ লাগাবার চেষ্টা করে তাদের শক্তি প্রয়োগের ফলে জমি একে সামান্য কিছু জায়গা দিয়েও দেয়, বাতাস ও পানি থেকে সে কিছু না কিছু খাদ্য পেয়েই যায় এবং শূন্যও তার ডালপালা ছড়াবার জন্য অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু জায়গা তাকে দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়৷ কিন্তু যতদিন এ গাছ বেঁচে থাকে ততদিন তিতা, বিস্বাদ ও বিষাক্ত ফল দিতে থাকে এবং অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথেই আকস্মিক ঘটনাবলীর এক ধাক্কাই তাকে সমূলে উতপাটিত করে৷
পৃথিবীর ধর্মীয়, নৈতিক, চিন্তাগত ও তামাদ্দুনিক ইতিহাস অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই কালেমায়ে তাইয়েবা তথা ভালো কথা এবং মন্দ কথার এ পার্থক্য সহজে অনুভব করতে পারে৷ সে দেখবে ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ভালো কথা একই থেকেছে৷ কিন্তু মন্দ কথা সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য৷ ভালো কথাকে কখনো শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলা যায়নি৷ কিন্তু মন্দ কথার তালিকা হাজারো মৃত কথার নামে ভরে আছে৷ এমনকি তাদের অনেকের অবস্থা হচ্ছে এই যে, আজ ইতিহাসের পাতা ছাড়া আর কোথাও তাদের নাম নিশানাও পাওয়া যায় না৷ স্ব স্ব যুগে যেসব কথার প্রচণ্ড দাপট ছিল আজ সে সব কথা উচ্চারিত হলে মানুষ এই ভেবে অবাক হয়ে যায় যে, একদিন এমন পর্যায়ের নির্বুদ্ধিতাও মানুষ করেছিল৷
তারপর ভালো কথাকে যখনই যে জাতি বা ব্যক্তি যেখানেই গ্রহণ করে সঠিক অর্থে প্রয়োগ করেছে সেখানেই তার সমগ্র পরিবেশ তার সুবাসে আমোদিত হয়েছে৷ তার বরকতে শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি বা জাতিই সমৃদ্ধ হয়নি বরং তার আশপাশের জগতও সমৃদ্ধ হয়েছে৷ কিন্তু কোন মন্দ কথা যেখানেই ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে শিকড় গেড়েছে সেখানেই তার দুর্গদ্ধে সমগ্র পরিবেশ পুতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে এবং তার কাঁটার আঘাত থেকে তার মান্যকারীরা নিরাপদ থাকেনি এবং এমন কোন ব্যক্তিও নিরাপদ থাকতে পারেনি যে তার মুখোমুখি হয়েছে৷

রেফারেন্স ০২. ইসলামী শিক্ষা সিরিজ থেকেঃ . জামাল আল বাদাবী: পৃষ্ঠা ২৫৫

No comments:

Post a Comment