তাজমহল, সিলিকোসিস্ আর শ্রমিকের মরণ
প্রশ্নটা ছিল, "তাজমহল কে তৈরি করেন?"
পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে চমকে উঠলেন মানিক বাবু। ক্লাস ৮ এর ইতিহাস পরীক্ষার খাতা, এটা কি উত্তর ! প্রথমে এক চোট হাসলেন তারপর রাগ হল এত কষ্ট করে ইতিহাস পড়ানোর এই রেজাল্ট ! লাল কালির পেনটা দিয়ে লাইনটা কেটে একটা বড় করে শূন্য বসিয়ে দিলেন মানিক বাবু। হোপলেস! কিস্যু হবে না। খাতা ঘুরিয়ে নামটা দেখলেন তারিফ আহমেদ।
ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে স্কুলের, বাকি খাতা গুলো স্কুল থেকে এসে দেখতে হবে আর দেরি করলে ট্রেনটা মিস্ হয়ে যাবে। খাতার বান্ডিলটা বেঁধে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে তাকের উপর রেখে স্কুলে যাওয়ার জন্য উঠলেন মানিক বাবু।
মানিকবাবু উত্তর চব্বিশ পরগনার অজ পাড়া গ্রামের একটি স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক।
ছাত্রদের পড়ানোর ব্যাপারে কোনো ত্রুটির কথা বলে সবচেয়ে বড় শত্রুও মানিকবাবুর দিকে আঙুল তুলতে পারবে না। প্রায় পঁচানব্বই ভাগ ছাত্রই খুব গরীব পরিবারের। কারোর বাবা ভ্যান টানে, কেউ বা দিন মজুরের কাজ করে কেউ বা ইট ভাটার শ্রমিক, ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই স্কুল থেকে ফিরে কেউ বা স্কুল কামাই করে বিভিন্ন কাজ করে কিছু পয়সা রোজগারের জন্য। তারমধ্যেও মানিকবাবু স্বপ্ন দেখেন তার ছাত্রদের নিয়ে, নিজের পকেট থেকে পয়সা খরচ করে টুকটাক বইপত্র কিনে দেন, নিজের খরচেই আঁকা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন, স্কুলছুট ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে আবার স্কুলে ফেরত আনেন। তিনি তো স্কুলের কেবল ইতিহাস শিক্ষক নন, একই সাথে প্রধান শিক্ষক।
টিফিনের পর ৮ এর ক্লাস ছিল মানিক বাবুর। ক্লাসে ঢোকার সময়ই মনে পড়ে গেলো সকালের খাতা দেখার কথা ,হ্যাঁ ছেলেটির নাম মনে আছে তারিফ আহমেদ,মনে থাকবে না! ছিঃ ছিঃ কি উত্তর, এতদিন ইতিহাস পড়ানোর ফল তার? ছেলেটি কে চেনেন মানিকবাবু। কালো করে, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,কান দুটো একটু খাড়া খাড়া।
ক্লাসে ঢুকে চক, ডাস্টার রেখে চেয়ারে বসেই বললেন, "তারিফ কোথায়?এসেছে আজ?" বাকি ছাত্ররা সমস্বরে উত্তর দিল, "না স্যার।" মানিকবাবু মনে মনেই বললেন," এদের দিয়ে কিস্যু হবে না, আমারই পণ্ডশ্রম।"
তারপর ৫ দিন কেটে গেলো,তারিফ স্কুলে আসছে না। টিচার্স রুমে এসে মানিকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, "আপনারা কেউ ক্লাস ৮ এর তারিফ আহমেদের ব্যাপারে জানেন? ১০ দিন হয়ে গেলো আসছে না।" অঙ্কের দিলীপবাবু মোবাইল খুটখুট করতে করতে বললেন, "দ্যাখেন স্কুল-টুল ছেড়ে কোথাও কাজে ঢুকল হয়ত, ওই বাসস্ট্যান্ডের ওখানে মফিজুলের চায়ের দোকান, ও যেন কি একটা হয় তারিফের,গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসুন।"
ছুটির পর স্কুল থেকে বেড়িয়ে সটান মফিজুলের চায়ের দোকানে হাজির হলেন মানিকবাবু।
আরে আসেন আসেন মাস্টারমশাই,বুসেন...
-না গো আমি চা খেতে আসিনি,পরে একদিন আসব,বলছি তুমি তারিফ কে চেন? আমাদের স্কুলে পড়ে, দিন দশেক হল আসছে না। কি হয়েছে কিছু...
আরে আর বুলেন না মাস্টারমশাই, ওর বাপ পাথর খাদানে কাজ করত, ফিরেছে কি সব রোগ নিয়ে সিলিকুসিস না কি যেন একটা, আর বেশিদিন বাঁচবে না মুনে হয়...
কথাটা শুনে যেন ধাক্কা লাগল মানিকবাবুর, অতোটুকু একটা ছেলে। এবার পড়বে কি করে ও? আসার পথে ট্রেন বেশ ফাঁকা ছিল, মানিকবাবুর মন খুছখুছ করছে,কি এমন রোগ যে বাঁচবে না তারিফের বাবা?স্মার্টফোনটা খুলে মানিক বাবু সার্চ করলেন, সিলিকুসিস। সার্চ রেজাল্ট এল সিলিকোসিস। অসংখ্য আর্টিকল, একের পর এক পড়তে লাগলেন মানিকবাবু। বাড়ি ফিরেও পড়ে চললেন।অনেক ওয়েবসাইট, ব্লগ পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। সিলিকোসিসকে বলা যেতে পারে শ্রমঘটিত রোগ, যারা পাথর খাদানে পাথর ভাঙার কাজ করেন তাঁদের ফুসফুসে দীর্ঘদিন ধরে সিলিকা জমতে জমতে এই রোগ হয়। শুধুমাত্র ভারতবর্ষে এই রোগে ৫০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত! কোনো রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই অল্প মজুরীতে বেশি লাভ করার জন্য খাদানের মালিকরা নিশ্চিন্ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় পড়াশোনা না জানা সরল গ্রামের মানুষদের।
মানিকবাবু তাকিয়ে রইলেন বাড়ির দেওয়ালের দিকে, এই ইমারত, রাস্তা, ব্রিজ তৈরি হচ্ছে,তৈরি হয়ে এসেছে শ্রমিকদের রক্ত ঘাম আর প্রাণের বিনিময়ে, এক মাস আগে ক্লাস ৫ এর প্রশান্তর বাবা মুম্বাইয়ে বহুতলে কাজ করতে গিয়ে পরে মারা যায়, অথচ এ যেন সাধারণ মৃত্যু, কেউ সাজা পাবে না। কেউ এদের কথা বলবে না, লিখবে না। চোখের সামনে যেন দেখতে পেলেন একদল মানুষকে, হাড় সর্বস্ব, ধুঁকছে, ক্রমাগত কেশে চলেছে তবুও একটা বিরাট পাথর বয়ে নিয়ে চলছে। কারোর পক্ষাঘাত, কেউ দৃষ্টি হারিয়েছে, কারোর হাত নেই পা নেই, তাঁদের পিষে দিয়ে ছুটে চলেছে অত্যাধুনিক গাড়ি, মাথা তুলছে শপিং মল...
মানিক বাবু উঠে দাঁড়ালেন। তাক থেকে লাল পেনটা নিলেন, নিচ থেকে পরীক্ষার খাতার বান্ডিলটা বের করলেন,হ্যাঁ এই তো রোল নং ২৩, তারিফ আহমেদ, ১ এর 'ছ' নম্বর কোশ্চেনের উত্তর, ৫ দিন আগে তারিফের এই উত্তরটাই প্রচণ্ড রাগ করে কেটে দিয়েছিলেন মানিকবাবু, আসলে তিনি ইতিহাস ভুল শিখেছেন বরং বলা ভালো ভুল শেখানো হয়েছে। দেশের কোটি কোটি ছাত্রকে যেভাবে ভুল শেখানো হয়। মানিক বাবু নিজের দেওয়া ক্রস চিহ্নটাকে ভালো করে কাটলেন, তারপর বড় করে একটা রাইট দিলেন,পাশে ফুল মার্কস ১
প্রশ্ন টা ছিল, "তাজমহল কে তৈরি করেন?"
তারিফ উত্তর লিখেছিল, "মার্বেল মিস্ত্রিরা।"
কিছু মানুষ হয়ত কিছু তৈরি করে টাকা লাগিয়ে শ্রমকে ক্রয় করে, তারপর শ্রমিককে ভুলে যায়।
কিন্তু কিছু মানুষ তাদের সমস্ত শ্রম দিয়ে একদিন মৃত্যু শয্যায় পড়ে যায়, তবুও তার কোন প্রশংসা হয় না, এটাই সমাজের নীতি এবং আমাদের নীতি!
“মানুষের বুক কতো চাপা কান্না
শুনেও কেউতো শোনে না
সমাজের অবিচারে অকারণে ধুকে মরে
প্রতিকার তা কেবা চায়..
মানুষ যে বড় অসহায়!”
-সংগৃহিত
No comments:
Post a Comment