Saturday, May 6, 2017

সুস্বাস্থ্যে ‘পিএইচ’


শরীরস্থ বিভিন্ন তরলের পটেনশিয়াল হাইড্রোজেন বা ‘পিএইচ’-এর মাত্রা সাধারণতঃ ৭.৩৫ থেকে ৭.৪৫ এর মধ্যে হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন যে স্বাস্থ্যবান ব্যক্তির শরীরস্থ তরলে ‘পিএইচ’-এর মাত্রা বেশি, ৭.৪ এর কাছাকাছি আর রুগ্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা কম হয়ে থাকে। ‘পিএইচ’-এর মাত্রা ৬.৮-এর নিচে বা ৭.৮-এর ওপরে হলে তা মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে।

‘পিএইচ’এর সঠিক মাত্রা শরীরস্থ বিভিন্ন এনজাইম এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যক্ষম রেখে শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু শরীর এসিডিক হয়ে পড়লে খাদ্য থেকে প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ এবং অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদান শোষণ করার ক্ষমতা কমে যায়। শরীর তখন বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ, হাড় ও কোষকলার অভ্যন্তরস্থ খনিজ পদাথসমূহ শোষণ করতে থাকে। ফলে কোষকলাগুলো সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে এবং শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।

ক্ষারধর্মী শরীর খাদ্য থেকে সঠিক মাত্রায় খনিজসমূহ আহরণ করতে পারে যা রক্তের কার্যক্রম স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রেখে শরীরস্থ সব কোষকলায় অক্সিজেন সরবরাহ করতে এবং অম্লধমী বর্জ্যসমূহ পরিত্যাগ করতে সাহায্য করে। ফলে শরীরে সহজে রোগ বাসা বাঁধতে পারে না ও অসুস্থতা বা ক্ষত থেকে সহজে আরোগ্য লাভ করা যায়।
‘পিএইচ’ মাত্রার ভারসাম্যহীনতার কারণে শরীরে হরমোনের সমস্যা, দুর্বলতা, হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা ও অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন ও অগভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, ওজন বৃদ্ধি, কিডনির সমস্যা, রোগ প্রতিরোধজনিত সমস্যা, ‘ফ্রি রেডিকেল’ সংক্রান্ত ক্ষতি ত্বরান্বিত হওয়া, হাড়ের দুর্বলতা এবং ভঙ্গুরজনিত সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়া, লিভারের কার্যক্ষমতা হ্রাস, হজম শক্তি হ্রাস ও বর্জ্য পরিত্যাগজনিত সমস্যা, জন্ডিস, ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়া, ছত্রাক জাতীয় সংক্রমণ বৃদ্ধি, পাকস্থলিতে এসিডের আধিক্য বা আলসার হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি, ঠোঁটের কোণ ফেটে যাওয়া, নখ ভঙ্গুর হয়ে ওঠা, চুল পড়ে যাওয়া, বিষণœতার প্রবণতা বৃদ্ধি, কর্ম প্রেরণা ও উৎসাহ হ্রাস, তন্দ্রালু ভাব, মাথাব্যথা, অরুচি, বিভ্রান্তি, চোখ, দাঁত ও মাড়ির সমস্যা, গলা ও এবং টনসিলে সংক্রমণ, ত্বক শুষ্ক হয়ে ওঠা ইত্যাদি বহু ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকি ‘পিএইচ’ মাত্রার দ্রুত পরিবর্তনের কারণে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কোষকলার ক্ষতির কারণে শরীরের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, সব ধরনের ক্যান্সার কোষকলার ক্ষেত্রে দুটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ- একটি হচ্ছে অক্সিজেনের অভাব আর অপরটি হচ্ছে ‘পিএইচ’ এসিডিক হয়ে ওঠা।
শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুস শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। কোনো কারণে এসিড বেড়ে ‘পিএইচ’ কমে গেলে ফুসফুস শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বেশি পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শরীর থেকে বের করে দেয়। ফলে হাইড্রোজেন আয়নের উৎপাদন কমে গিয়ে ‘পিএইচ’ স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরে আসে। ঠিক একইভাবে বিপরীত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর ক্ষারের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে।
তৃতীয় ধাপে কিডনি শরীরে সঠিক মাত্রায় ‘পিএইচ’ ধরে রাখার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী এসিড বা ক্ষার শোষণ করার পরিমাণ কমায় বা বৃদ্ধি করে। বিপাকীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যখন শরীরে এসিড তৈরি হয় অথবা মাংসপেশিতে ল্যাকটিক এসিড তৈরি হয় তখন অতিরিক্ত এই এসিডকে মোকাবেলা করার জন্য কিডনি থেকে বাইকার্বনেটের নিংসরণ ঘটে। আবার শরীরে ক্ষারের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে কিডনি বাই-কার্বনেট নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যাতে শরীর প্রয়োজনীয় মাত্রায় ‘এসিডিক’ হয়ে ওঠে।
হার্টএ্যাটাক, ক্যান্সার, যকৃতের সমস্যা, ‘সিজার’, ইত্যাদি কারণে এমনকি অতি মাত্রায় ব্যায়াম বা রৌদ্রে খেলাধূলা করা থেকেও শরীরে ‘ল্যাকটিক এসিড’-এর পরিমাণ বেড়ে গিয়ে শরীর অম্লতাযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। হাঁপানি, বুকে আঘাত প্রাপ্তি, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, বুকের মাংসপেশির দুর্বলতা ইত্যাদি শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় ফুসফুস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমণ ও অক্সিজেন গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধা প্রাপ্ত হয়। ফলে শরীরে কার্বন-ডাই-অক্সাইড-এর আধিক্য দেখা দেয়।
মাদক সেবন, মদ্যপান, বেশি মাত্রায় এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার, কম ঘুম, ঘুম বা মানসিক চাপ হ্রাসের ওষুধ এর যথেচ্ছ ব্যবহার, ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করা, বেশি পরিমাণে এসিডিক খাদ্য গ্রহণ, খাদ্যে কৃত্রিম রাসায়নিকের পরিমাণ বৃদ্ধি, বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা বা গৃহে ব্যবহৃত পরিষ্কারকে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্বারা সম্পাতিত হওয়া, কীটনাশক, দূষিত বায়ু সেবন, বায়ুতে বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি, রোগ-প্রতিরোধক কোষকলার বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর বিক্রিয়া ইত্যাদি কারণে কোষকলাগুলো সঠিক পরিমাণে অক্সিজেন বা পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হয় এবং শরীর অম্লধর্মী হয়ে ওঠে।
একই সঙ্গে একাধিক রক্ত পরীক্ষা দ্বারা শরীরে অম্লতার আধিক্য নির্ণয় করা হয়। শিরা থেকে রক্ত নিয়ে রক্তে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। মুখের লালা বা থুথু পরীক্ষা করেও ‘পিএইচ’-এর মাত্রা সম্পর্কে জানা যায়। শরীরে ক্যালসিয়াম, আমিষ, শর্করা এবং অন্যান্য ইলেকট্রোলাইট-এর মাত্রা এবং কিডনিতে সমস্যা আছে কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা হয়। ফুসফুসের কার্যক্ষমজনিত সমস্যা নির্ণয়ের জন্য বুকের এক্সরে অথবা ধমণীসমূহ পরীক্ষা করার জন্য ‘পালমোনারী টেস্ট’ করা হয়।
অম্লতাজনিত সমস্যা থেকে আরোগ্য লাভের আশংকা অনেকটাই রোগটির কারণের ওপর নির্ভর করে। সঠিক চিকিৎসায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। তবে সূচনায় রোগ-নির্ণয় করা গেলে চিকিৎসা সহজতর হয়ে ওঠে।
শরীরে অম্লতার আধিক্য পাওয়া গেলে সাধারণভাবে সোডিয়াম-বাই-কার্বনেট দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। এটি মুখে খাওয়ানো যেতে পারে বা ইনজেকশনের আকারে শিরার মধ্যে প্রয়োগ করা যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যায় ফুসফুসের বায়ু চলাচলের পথ মুক্ত করে দেয়ার জন্য ওষুধ দেয়া হয়। কিডনির অকার্যকারিতার ক্ষেত্রে সোডিয়াম সাইট্রেট দেয়া হয়। কখনও কখনও রোগীকে অক্সিজেনও দেয়া হতে পারে।
যদিও পরিবেশে বিদ্যমান অনেক উপাদানই শরীরে দূষণ বা অম্লতার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে তবে খাদ্যাভ্যাসই এর প্রধান কারণ। বেশির ভাগ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা লবণ থাকে যা রক্ত শিরাগুলোকে সংকীর্ণ করে তোলে এবং অম্লতার বৃদ্ধি ঘটায়। কোমল পানীয় এবং প্রক্রিয়াজাত ফলের রস বা অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে বিদ্যমান চিনি, সংরক্ষকদ্রব্য (preservative), কৃত্রিম রং, সাদা আটা, উচ্চ আমিষযুক্ত খাদ্য, আইসক্রিম, ডুবো তেলে ভাজা খাদ্যদ্রব্য, আচার, ইত্যাদি শরীরে অম্লতা বৃদ্ধি করে।
পক্ষান্তরে কাঁচা শাক-সবজি ও ফলমূলে পটাশিয়াম থাকায় তা অম্লতার বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক রক্ষক হিসেবে কাজ করে। যদিও টক জাতীয় ফল খেতে অম্ল কিন্তু এ জাতীয় ফল যেমন লেবু, কমলা, টমেটো ইত্যাদি শরীরে অম্লতা বৃদ্ধি তো করেই না উপরন্তু শরীরকে ক্ষারযুক্ত করে তোলে। পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন, কলা, মাশরুম, খেজুর, লেটুস, কিসমিস, মধু, মিষ্টি আলু, ডিম পোচ, শসা, গাজর, আপেল ইত্যাদি শরীরকে ক্ষারধর্মী করে তোলে।
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার ৭৫% ফল-মূল, শাক সবজি ও উদ্ভিজ আমিষসমৃদ্ধ এবং বাকি ২৫% অম্লতা ধর্মী যেমন, প্রাণিজ আমিষ, শস্য ও দুগ্ধজাত দ্রব্য হওয়া উচিৎ। খাদ্যদ্রব্য যতটা সম্ভব ‘অরগাণিক’ হওয়া প্রয়োজন। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করাও জরুরি। ‘আপেল সিডার’ সিরকা ইত্যাদি ‘পিএইচ’ সমৃদ্ধ পানীয় পান করা যেতে পারে। পানিতে লেবু বা ‘বেকিং সোডা’ মেশালে তা বেশি ক্ষারযুক্ত হয়ে ওঠে।
Source: ড. জাকিয়া বেগম ০৬ মে, ২০১৭

No comments:

Post a Comment