Wednesday, June 24, 2020

কস্তুরী ও আমার মানব-হিতৈষী দাদার চিকিতসাঃ আব্বার কাছে শোনাঃ বিরল স্মৃতিচারণ

আমার শ্রদ্ধেয় দাদা মরহুম ছমির উদ্দিন প্রামাণিক। উনি চিকিতসা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে নয় বরং একজন গ্রামের একজন অ্যাপোথিকারীর (Apothecary: a person who prepared and sold medicines and drugs) অ্যাসিস্ট্যান্ট তথা কম্পাউন্ডার থেকে। ৪০-৫০এর দশকে বাংলার গ্রামে চিকিতসকের মহা সংকট ছিল বিষয়টি আমার বয়সী যারা তারা সবাই জানেন। অ্যাপোথিকারীকে অনেকেই বৃটিশ বা পাকিস্তানী আমলে কবিরাজ বা নগ্নপদী ডাক্তার বা Bare-foot Doctor বলতো। অনেকে এদেরকে কোয়াক(Quack doctor) বা হাতুড়ে বা নাড়ীটেপা ডাক্তার বলতো। এরা ছিল Rural Healthcare Provider. এদের কোন প্রকার প্রশিক্ষণ ছিলনা চিকিতসা পেশার।
ধীরে ধীরে আমার দাদার ডাক্তারীর যশ গ্রামান্তরে ছড়াতে থাকে। দাদাকে অনেকেই “পন্ডিত” বলে ডাকতো। কারণ দাদা স্কুল ঘর তৈরী করে গ্রামের মানুষকে অক্ষর জ্ঞান শিক্ষা দিতেন আর সেই সুবাদে আমাদের পাড়াটি ছিল “পন্ডিত পাড়া।” এখনো আমাদের পাড়ার সেই সুনাম অক্ষুন্ন। পন্ডিত পাড়ার লোক হিসেবে আমাদের বা আমাদের প্রজন্মের সুনাম এখনো প্রচুর। আমাদের পাড়াটি এখনো একটি বাতিঘর। দাদার আধ্যাত্মিক বুতপত্তি ছিল যেটা আব্বার মুখেই শোনা। দাদা যে দহলিজে বা বৈঠকখানায় বসে চিকিতসা দিতেন সেখানে বাংলা, আসাম তথা ভারতের বাংলা-আরবী-ফার্সীভাষী বহু বিশিষ্টজনের আনাগোনা ছিল আর সেটাও ছিল আমাদের গ্রামের খন্দকার পাড়ার মাদ্রাসা দার-উল-ঊলুমের কারণে। মাদ্রাসা এলাকায় বাস করতেন দাদার বন্ধু হাবিবুর রহমান খন্দকার -যার আধ্যাত্মিক বুতপত্তি ছিল সে সময় সর্বজনবিদিত। দাদার দহলিজে বহু বিশিষ্টজনের সাথে আমারও সাক্ষাত হয়েছে ছোট বেলায় যারা আমাকে কোলে নিতেন, আদর করতেন- এটা স্পষ্ট করেই মনে আছে এখনো। আমার আব্বাও ৫টি ভাষা জানতেন। তিনিও ছিলেন বগুড়ার বৃটিশ মেডিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করা ডাক্তার। দাদার অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল আমার মা। মায়ের কাছে শুনেছি দাদা মা’কে বলতো, “ছোট বৌ, আমি বেঁচে থাকতে তুই পারলে কিছু শিখে রাখ আমার কাছ থেকে।” মায়ের কাছে গল্প শুনেছি দাদা বিষাক্ত সাপ ধরে এনে সেটাকে তেলে জ্বাল দিয়ে বাতের ব্যথার ওষুধ তৈরী করতো। দাদা মারা যাবার পরও সে ধরনের অনেক তেল বা আরো কিছু ওষুধ আমার মায়ের কাছে ছিল। মায়ের থেকে আমার বড় ভাই ও আমি চিকিতসার জন্য অনেক ওষুধ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি।
ডাক্তারীর যশ নিয়ে দাদা গ্রাম গ্রামান্তরে হেঁটেই যেতেন সে সময় বাহন স্বল্পতার কারণে। তখনকার দিনে একমাত্র দ্রুতগামী বাহন ছিল টাট্টু ঘোড়া। তবে দাদাকে ঘোড়ায় চড়তে দেখিনি আমি। দাদা অ্যালোপ্যাথি ওষুধের পাশাপাশি শল্য-চিকিতসা, ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাক, ইউনানী বা হোমিওপ্যাথীর চিকিতসাও দিতেন। তার বিশেষ গুণ ছিল যে তিনি অসুখের ডায়গনোসিস (Diagnosis) আর প্রোগনোসিস (Prognosis) দুটোই নিখুঁতভাবে বুঝতেন। এ কারণে তিনি গ্রাম বা গ্রামান্তরের মানুষের অগাধ বিশ্বাস তিনি অর্জন করতে পেরেছিলেন। লোকে বলতো পন্ডিত ভাই ছাড়া রোগী ভাল হবে না। তাই তাকেই ডাকা হোক।
একবার আমাদের গ্রামের এক লোক অনেকদিন ধরে অসুস্থ থাকার পর বিছানা নিলে তাকে আর ফেরানো গেলো না। এর আগে দাদা তার চিকিতসা করেছিলেন, ওষুধ-পথ্যও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে থাকে। হঠাত সেই লোকটির বাড়ী থেকে কান্নার রোল উঠলে দাদাকে অনেক পরে খবর দেয়া হলো তার জানাযা পড়ানোর জন্য। দাদা সে বাড়ীতে গেলেন। মৃত লোকটির পাশে জলচৌকীর ওপর বসলো। দাদা তার নিকটজনদের বল্লো মুখ থেকে কাফনের কাপড় সরাতে। তারা তাই করলো। দাদা পকেট থেকে কস্তুরীর ঢেলা বের করে মৃত লোকটির নাকে ধরলো। কারণ, দাদার সন্দেহ ছিল লোকটি মারা যায়নি বরং কোমায় ছিল। কোমা হলো অচেতনতার একটি গভীর অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তিকে জাগ্রত করা সম্ভব নয় (দেখুনঃ NDE- near-death experience), এবং তিনি ব্যাথা সৃষ্টিকারী কোনো উদ্দীপনা, আলো, বা শব্দের প্রেক্ষিতে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে পারেন না। কোমায় থাকার অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো স্বাভাবিকভাবে ঘুম থেকে ওঠার চক্র অনুপস্থিত থাকে এবং তিনি স্বেচ্ছামূলক কোনো প্রকার কার্য সম্পাদন করতে পারেন না। কোমায় থাকা রোগীদের মধ্যে সচেতন অবস্থায় থাকার সকল প্রকার লক্ষণ সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে এবং তারা সচেতনভাবে কোনো কিছু অনুভব করতে, কথা বলতে, বা নড়াচড়া করতে পারেন না। কোমা প্রাকৃতিক কারণে বা চিকিতসার অংশ হিসেবে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হতে পারে।
আব্বার বর্ণনা অনুসারেঃ বিশেষভাবে অভিজ্ঞ আমার দাদা লোকটির নাকে প্রায় বেশ কিছু সময় নিয়ে কস্তুরীর ঢেলা ধরে রাখার পর লোকটি একটু নড়ে ওঠে। এর পর তার নিকটজনদের বলা হলো কাফনের কাপড় সরিয়ে ফেলতে। কস্তুরীর অ্যকশান লোকটির শরীরে ভালভাবে শুরু হলে লোকটি মৃত শয্যা থেকে একেবারে উঠে বসে পড়ে ও দাদাকে সালাম দেয়। কথাও বলে দাদার সাথে। বলে, “পন্ডিত ভাই, কখন এসেছেন।”
গ্রামের লোকদের কাছে এ ছিল এক অভুতপূর্ব কারিশম্যাটিক ব্যাপার। হৈ চৈ পড়ে যায় চারদিকে। এমন ঘটনার পরে তাদের প্রিয় পন্ডিত ভাইয়ের যশ আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে।
এ ঘটনার পরে লোকটি অনেক বছর বেঁচে ছিলো।
এ সবই ছিল আল্লাহ পাকের বিচিত্র খেলা।
People take musk for stroke, coma, nerve problems, seizures (convulsions), heart pains, and sores. (https://www.rxlist.com/musk/supplements.htm)
কস্তুরীঃ
কস্তুরী মূলত সুগন্ধী গ্রন্থি বা Scent Gland. পুরুষ হরিণের পেটে অবস্থিত সুগন্ধী গ্রন্থি নিঃসৃত একটি সুগন্ধী। মিলন ঋতুতে পুরুষ হরিণের পেটের কাছের গ্রন্থি থেকে সুগন্ধ বের হয়, যা স্ত্রী হরিণকে আকৃষ্ট করে৷ মিলন ঋতুর শেষে গ্রন্থিটি হরিণের দেহ থেকে খসে পড়ে যায়৷ সেটা সংগ্রহ করে রোদ শুকিয়ে কস্তুরী তৈরি করা হয৷ হরিণের দশ বছর বয়সে নাভির এ গ্রন্থি পরিপক্ব বা ম্যাচিউর হয়। এ সময় হরিণটিকে হত্যা করে নাভি থেকে পুরো গ্রন্থিটি বের করে নেওয়া হয়। তারপর রোদে শুকানো হয়। একটা পূর্ণাঙ্গ কস্তুরী গ্রন্থির ওজন প্রায় ৬০-৬৫ গ্রাম।
এটি বিশেষ ধরনের প্রাণিজ সুগন্ধি। হরিণের নাভি থেকে পাওয়া যায় এই কস্তুরী, যা মহামূল্যবান সুগন্ধি হিসেবে পরিচিত।
সুগন্ধি বহু গুণসম্পন্ন এবং বহু নামসম্পন্ন। এর ঘ্রাণ প্রকৃত যোজনগন্ধা বললে কম বলা হয়। কথিত আছে কস্তুরীর এক তিল পরিমাণ কোন বাড়িতে ফেললে বহু বছর সেখানে এর ঘ্রাণ থাকে। তিন হাজার ভাগ নির্গন্ধ পদার্থের সঙ্গে এর এক ভাগ মেশালে সমস্ত পদার্থই সুবাসিত হয় কস্তুরীর ঘ্রাণে।
কস্তুরী সংগ্রহকারীরা এই সুগন্ধিকে প্রায় প্রকৃত অবস্থায় রাখেন না; সচরাচর অন্য পদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করেন। অন্য পদার্থের মধ্যে রক্ত বিশেষ একটি উপাদান। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের সঙ্গে কস্তুরীর বিশেষ সাদৃশ্য আছে। কস্তুরীর সুবাসেও আছে বৈচিত্র্য এবং এটি ভিন্ন ভিন্ন নামেও।
সুগন্ধি ফুলের মতোই যুগ যুগ ধরে মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে কস্তুরী মৃগ। এই মৃগ অর্থাত হরিণ এক প্রজাতির পুরুষ হরিণ। ইংরেজি নাম ‘মাস্ক ডিয়ার’। এরা খুব লাজুক স্বভাবের। তাই নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ করে একান্ত নির্জনে।
হিমালয় পর্বতমালার উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উতকৃষ্ট কস্তুরীমৃগ পাওয়া যায়। ওই অঞ্চলে একপ্রকার ছোট আকারের হরিণ আছে, তারা ছাগলের চেয়ে বড় নয় কিন্তু দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এদের পা অতি সরু, মাথা সুন্দর এবং চোখ চমতকার উজ্জ্বল। এই হরিণ অন্য হরিণ থেকে আলাদা নয়। অত্যন্ত শীতল পার্বত্য পরিবেশে বাস করায় এদের লোম সরু না হয়ে অত্যন্ত মোটা ও পালকের মতো হয়। এ ছাড়া পামির মালভূমির গ্রন্থি পর্বতমালায় তৃণভূমি সমৃদ্ধ উপত্যকায় এই হরিণ পাওয়া যায়।
কস্তুরী মৃগের ওপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের মতো দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। এ ধরনের দাঁত সব প্রজাতির হরিণের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এই দেখেই কস্তুরী মৃগ সনাক্ত করা হয়।
এই প্রজাতির হরিণ আত্মরক্ষায় পটু। কিন্তু তারা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পারে না, কারণ এদের দেহের তীব্র ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ অনুসরণ করে শিকারি ঠিকই এদের সন্ধান পেয়ে যায়। এই হরিণের নাভি থেকেই মূলতঃ এই সুগন্ধি দ্রব্য সংগ্রহ করা হয়।
পুরুষ হরিণের নাভি মুখের গ্রন্থিতে এক বিশেষ ধরনের কোষের জন্ম হয়। এই কোষ যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন এ থেকেই সুঘ্রাণ বের হতে থাকে। হরিণের ১০ বছর বয়সে সুগন্ধি কোষ পূর্ণতা লাভ করে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে হরিণটির নাভিতে এই কোষের জন্ম, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উতসের সন্ধানে। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে তার নিজের দেহ থেকেই।
কস্তুরী যখন সংগ্রহ করা হয় তখন এর গন্ধ এতটা উগ্র থাকে যে হরিণের নাভিকোষ কেটে নেওয়ার সময় শিকারীরা মোটা কাপড় দিয়ে নিজেদের নাক বেঁধে নেয়। অনেক সময় এ গন্ধ সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারো কারো চোখ, নাক থেকে জল ও মুখ থেকে লালা ঝরা শুরু হয়। এমনকি জীবনহানিও ঘটে।
Don't confuse musk with musk root (Ferula sumbul). It has a musky odor and a bitter aromatic taste. (https://en.wikipedia.org/wiki/Muskroot)
বর্ণনাঃ নিজের
কস্তুরী ও মাস্ক-ডিয়ার: উইকিপিডিয়া

No comments:

Post a Comment