Saturday, June 13, 2020

বড় বুবর কাছে শিখেছি: “রিপল ইফেক্ট (RIPPLE EFFECT)

“পর ধন নাহি লবে,
চিরদিন সুখে রবে”
আমার সব বড় বোন আবিদা খাতুন। তার কাছে শেখা হয়নি আমার কোন কিছুই। তিনি গত হয়েছেন আমি যখন সিরাজগঞ্জের ভাষায়, “গ্যাদা বাচ্চা।” মানে হলো এক্কেবারে ছোট্ট বাবু। আমার এই বোনটি ছিলেন অনেক গুণী যেটা শুনেছি আব্বার মুখে।
তার পরের বড় বোন বুলবুল। ভাল নাম খাদিজা খাতুন। নামটি আব্বার রাখা। আব্বা জিজ্ঞেস করেছিলাম বুবুর নাম ‘বুলবুল’ কেন রাখলেন? তিনি বল্লেন কবি নজরুলের বুলবুলের নাম আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছিল। কবির “বুলবুল” যখন মারা যায় তখন কবি তার নামে করুন এক গান লিখেছিলেন, “ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।” কাছে থেকে দেখলাম, “বলিতে বলিতে রুমালে চোখ মুছিলেন মোর বাপ।”
বুঝেছিলাম আব্বা আবিদা বুবুর জন্য তথা মেয়েদের জন্য কতটা আবেগি ছিলেন। আব্বাকে কখনো দেখিনি টানাটানির সংসারে ৫ মেয়েকে নিয়ে ভাবতে। বরং মেয়েরাই ছিলো তার আনন্দের মহাসাগর।
বুলবুল বুবু বাপের বাড়ীতে বেড়াতে আসতো আমের সময়। সব বোনেরাই আসতো সে সময়- কেবল আবিদা বুবু ছাড়া। আবিদা বুবুর জন্য মায়ের মনটা খুবই খারাপ হতে দেখেছি। মা বলতো সবাই এলো, “আমার আবিদাটা এলোনা।”
আমি ভাই-বোনদের সবাকার ছোট। আমি সব বোনের কোলে কোলে গিয়ে শেষ করতে পারতাম না। কাড়াকাড়ি লেগে যেতো বোনদের মধ্যে আমাকে নিয়ে।
বুলবুল বুবু বাপের বাড়ীতে এসে যত দিন থাকতো সকাল বেলা শীতল পাটিতে মাটির বারান্দায় বসে আমাকে নিয়ে মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাবুর “শিশু শিক্ষা” বই নিয়ে পড়াতে বসতো। আমিও বোনের কোলের মধ্যে বসেই তার সাথে সূর করে পড়তাম-
বার মাস তিথি যত।
একে একে হয় গত ॥
বার মাস সাত বার।
আসে যায় বার বার।।
লেখা পড়া করে যেই।
গাড়ী ঘোড়া চড়ে সেই ॥
লেখা পড়া যেই জানে।
সব লোক তারে মানে ॥
কটু ভাষী নাহি হবে।
মিছা কথা নাহি কবে ॥
পর ধন নাহি লবে।
চিরদিন সুখে রবে ॥
পিতামাতা গুরুজনে।
সেবা কর কায় মনে ॥
পড়া শেষ হলে বোন আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতো পয়লাতেই তো ভুল পড়লি? তার দিকে তাকাই আমি। ভুলটা বুঝিনি? বোন বল্লো ওটা হবে “বার” হবে, “বারো” নয় বুঝলি কি না? আমি মাথা নাড়ি। এক লাইন পরে যেটা আছে সেটা হবে “বারো।” তাজ্জব বনে যাই। ভাবি বোনটা খুবই জানে! এর পর আর ভুল হয়নি।
অনুপ্রেরণামূলক কবিতার শেষের দিকে আসি। লেখা আছে-“পর ধন নাহি লবে, চিরদিন সুখে রবে।”
বুবুর দিকে তাকাই। বুবু বুঝতে পারে আমি কি বলতে চাই, কি জানতে চাই। বুবু বলে, অন্য মানুষের ধন সম্পত্তি নেয়া যাবে না। বুঝলি কি না?। বুবুকে আবার বলি। বুবু খোলাসা করে বলেঃ
এই ধর তোর সামনে সোনার দলা পড়ে অছে, তুই সেটা নিবি না। আমি দুষ্টুমি করে বলি সেটা কেউ না কেউ তো নেবে? না হয় আমিই নিলাম? বুবু বলে, ‘যখন থেকে তুই ওটা “তোর” করে নিবে তখন থেকেই তোর খারাপ লাগা শুরু হবে।’ বলি আমি, “কেনো? বুবু বলে সোনার দলা কুড়িয়ে নেয়ার পর তুই সেটা কোথায় রাখবি? চৌকির তলায়, খাটের তলায়, মায়ের ঘরের বাক্সে?। কোনওখানে রেখে শান্তি পাবিনে। মনে হবে আমার জিনিস বোধকরি কেউ নিলো! এই বুঝি চুরি হয়ে গেলো। ঘুমাতেও পারবি না। সব সময় চোখে চোখে রাখতে হবে ওটাকে। মন খারাপ হতে থাকবে। তার চেয়ে যদি না নিস্? তাহলে এই ঝামেলাটা আর হবেনা। নাক ডেকে ঘুমাতে পারবি। খেলতে পারবি, বেড়াতে পারবি। এখানে ওখানে নিশ্চিন্তে যেতে পারবি। আমি বুবুর ব্যাখ্যা শুনে তাজ্জব বনে যাই। ছোট্ট ঘিলুতে বড় বড় সম্পদ ভরছে -ভারী ভারী জিনিস INFUSE হচ্ছে- যা সোনার দলার চেয়েও দামী।
আমি বড় হয়েছি। বুলবুল বুবু নেই, চলে গেছেন ফিরদৌসে। কিন্তু আমাকে সুবিশাল এক সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যা আমি যেনো ধারন করতেই পারছিনা। মনে হয় তার কথা, “তোর সামনে সোনার দলা পড়ে অছে, তুই সেটা নিবি না।” এ এক “রিপল ইফেক্ট” (RIPPLE EFFECT) -continuing and spreading results of an event or action.
আমি আরো বড় হয়েছি। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে বড় বড় পাশ দিয়েছি। অন্যের জিনিস অন্যায়ভাবে নেয়ার সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট নিয়ে অনেক পড়েছি। সেই ২ লাইনের ব্যাখ্যা যেনো শেষ হচ্ছেনা।
আল কুরআন পড়েছি। পড়েছি, “অন্যের সম্পদ আত্মসাত করার পরিনাম ভয়াবহ।”
আর তোমরা নিজদের মধ্যে তোমাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না এবং তা বিচারকদেরকে (ঘুষ হিসেবে) প্রদান করো না। যাতে মানুষের সম্পদের কোন অংশ পাপের মাধ্যমে জেনে বুঝে খেয়ে ফেলতে পারো।
আর তোমরা অন্যায় ভাবে পরস্পরের মাল গ্রাস করো না এবং জানা সত্ত্বেও অসত উপায়ে লোকের মাল গ্রাস করার উদ্দেশে তা বিচারকের নিকট নিয়ে যেয়ো না। -সূরা আল বাক্করাহ, ১৮৮ নং আয়াত
এই আয়াতে মানুষের সম্পদে স্বতন্ত্র অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। একজন মানুষ অন্যায়ভাবে যেমন মিথ্যা শপথ, ডাকাতি, চুরি, ঘুষ নিয়ে ও সুদ খেয়ে অন্যের সম্পদ হরণ করবে তা হারাম।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জে বলেন, একজন মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের মান-সম্মান, রক্ত, সম্পদ সবকিছু হারাম। (সহীহ বুখারী হা: ৬৮, সহীহ মুসলিম হা: ১৬৭৯)
হাফেয ইবনে কাসীর (রহঃ) বলেন: এখানে ঐ সব ব্যক্তিদের আলোচনা করা হচ্ছে, যাদের কাছে অপরের কোন প্রাপ্য থাকে কিন্তু প্রাপকের নিকট তার প্রাপ্য অধিকারের কোন প্রমাণ থাকে না, ফলে এ দুবর্লতার সুযোগ গ্রহণ করে সে আদালতের আশ্রয় নিয়ে বিচারকের মাধ্যমে নিজের পক্ষে ফায়সালা করিয়ে নেয় এবং এভাবে সে প্রাপকের অধিকার হরণ করে। এটা জুলুম ও হারাম। আদালতের ফায়সালা জুলুম ও হারামকে বৈধ ও হালাল করে দিতে পারে না। আদালত কেবল বাহ্যিক দিক অবলোকন করে বিচার করে।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি একজন মানুষ। লোকজন আমার নিকট বিবাদ নিয়ে উপস্থিত হয়ে থাকে। স্বভাবত একজন অপরজন অপেক্ষা বেশি যুক্তিতর্কে পারদর্শী হয়ে থাকে। তার যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি হয়তো তারই পক্ষে ফায়সালা দিয়ে থাকি (অথচ প্রকৃত ঘটনা এর বিপরীত)। তবে জেনে রাখ: যে ব্যক্তির পক্ষে এরূপ ফায়সালা দেয়ার ফলে কোন মুসলিমের হক আমি তাকে দিয়ে দেই, ওটা হবে তার জন্য জাহান্নামের আগুনের টুকরা। অতএব সেটা সে গ্রহণ করবে বা ছেড়ে দেবে। (সহীহ বুখারী হা: ২৬৮০)
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন: হে আদম সন্তান! জেনে রাখ, বিচারকের মীমাংসা তোমার জন্য হারামকে হালাল এবং অন্যায়কে ন্যায় করে দিতে পারে না। বিচারক সাক্ষীদের সাক্ষ্য অনুসারে বাহ্যিক অবস্থা দেখে বিচার করে। তাছাড়া তিনি মানুষ, তার দ্বারা ভুল হওয়াও সম্ভব। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়তের তাফসীর)
অতএব এরূপ ধোঁকাবাজী ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ ভোগ করলে এর বিনিময়ে তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
বান্দার হক কে আমরা তুচ্ছ মনে করি, কিন্তু বান্দার হক নষ্ট করা আল্লাহর হক নষ্ট করা হইতেও ভয়াবহ।
আল্লাহর হক নষ্ট করলে আল্লাহ চাইলে শির্ক ব্যতীত অন্য যে কোন গুনাহ ক্ষমা করতে পারেন বলে আমাদের বলেছেন!
নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে! এছাড়া যাকে ইচ্ছা, ক্ষমা করেন! যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে সুদূর ভ্রান্তিতে পতিত হয়! (সূরা নিসা: ১১৬)
তবে এই আয়াতে উল্লেখিত গুনাহ হচ্ছে নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত যেগুলো আল্লাহর হক সেগুলো পালন না করার গুনাহ!
বান্দার হক নষ্ট করার গুনাহ ক্ষমা করার এখতিয়ার আল্লাহ নিজ হাতে রাখেন নি! যেমন, আমি যদি একজনকে ধোঁকা দিয়ে ১ টি টাকাও নিয়ে নিই, কোন কথা বা গালির সাহায্যে মনে কষ্ট দেই, তবে একমাত্র সেই লোক (যার হক নষ্ট করলাম) সে বাদে আর কেউ ক্ষমা করতে পারবে না!
প্রকৃত মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার কথা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে! আর মুহাজির সেই ব্যক্তি, আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা যে পরিত্যাগ করে! (সহীহুল বুখারী: ৬৪৮৪)
একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে হেয় মনে করে! এক মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও মান-সম্মান অন্য মুসলিমের জন্য হারাম! (সহিহ মুসলিম: ৬৪৩৫)
মহান আল্লাহ, সুরা হুজুরাত-এর পরপর তিনটি আয়াতে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করছেন! ঝগড়া হলে মীমাংসা করে নেওয়াঃ-
নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই, তাই তোমাদের ভাইদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও আর আল্লাহকে ভয় কর যেন তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও! (আল-হুজুরাত, ৪৯/১০)
বুলবুল বুবু আমাকে মাত্র দু’লাইন পড়িয়েছেন। বুবু ব্যাখ্যা কোরে যা বুঝিয়েছেন সেই ব্যাখ্যা যে এত বড় পরিসরের হবে তা বুঝতে পারিনি।
আমি এখনো পড়ছি কেবল পড়ছি।
শেষ হয়না এই “রিপল ইফেক্ট।”

No comments:

Post a Comment