যখন পৃথিবীতে রাজত্ব করছিল সবচাইতে নিকৃষ্ট, নির্দয়, নরপিশাচ শাসক ফিরাউন। সম্ভবত, পৃথিবী আর কখনোই তার মতন দ্বিতীয় কোনো জালিম শাসককে অবলোকন করবে না। তার অত্যাচার আর নির্যাতনের মাত্রা ছিল অতি ভয়ংকর। হবেই-বা না কেন? নিজেকে সে ‘খোদা’ দাবি করত। খোদার শান, মান আর মর্যাদার আসনে কল্পনা করে সে নিজেকে জগতের একচ্ছত্র অধিপতি ধরে নিত। তার এই মিথ্যে দাবির সাথে যারাই দ্বিমত করত, তাদের কপালে জুটত—মৃত্যু! সেই মৃত্যুগুলো কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিল না। কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারত, কাউকে পানিতে চুবিয়ে মারত। যেন মৃত্যুর বাহারি আয়োজনে ভরপুর থাকত তার সংসদ।
ফিরাউন ধরে ধরে বনি ইসরাইলের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত। ফিরাউন জানত, তাকে বধ করার জন্য এই বনি ইসরাইলের মধ্যেই সত্য ইলাহের একজন সত্য নবি প্রেরিত হবে। সে ভাবত, বনি ইসরাইলের ঘরে জন্ম নেওয়া সকল পুত্র সন্তানকে হত্যা করতে পারলেই তার পথের কাঁটা সাফ করে ফেলা যাবে।
এই নিষ্ঠুর, নির্দয় জালিমের হাত থেকে নিজের সন্তানকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল শিশু মুসার মায়ের অন্তর। চোখের সামনে প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানের নির্মম মৃত্যুদৃশ্য অবলোকন করা দুনিয়ার কোনো বাবা-মায়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। কীভাবে বাঁচাবেন পুত্রকে তিনি? কীভাবে তাকে আড়াল করবেন জালিম বাহিনীর নাগপাশ থেকে? অস্থির চঞ্চলা হয়ে পড়লেন তিনি। মুসার মায়ের হৃদয়ের এই ব্যাকুলতা আল্লাহর কাছে গোপন থাকল না। তিনি শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে একটা বাক্সে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য মুসার মাকে নির্দেশ দিলেন। ব্যাপারটা কুরআনে এসেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন—
"আর আমি মুসার মায়ের নিকট এই মর্মে নির্দেশ পাঠালাম যে, তুমি তাকে দুধ পান করাও। অতঃপর যখন তুমি তার ব্যাপারে আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে " (সূরা কাসাস, আয়াত ৭)
চিন্তা করুন। একদিকে ফিরাউন বাহিনীর হাত থেকে সন্তানকে প্রাণে বাঁচাতে মায়ের অন্তর মরিয়া। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, শিশুটাকে যেন বাক্সবন্দি করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে, এ যেন মৃত্যুর আগেই মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া। ডাঙার বাঘের ভয়ে জলের কুমিরের সামনে সন্তানকে ঠেলে দেওয়ার মতন ব্যাপার। আমার এবং আপনার মনে যে ভাবনার উদয় হচ্ছে তা কি মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও উদয় হয়নি? হ্যাঁ, হয়েছে। তবে, তার মনের সেই ভীতি, সেই ভয়, সেই সন্দেহ তখনই দূর হয়ে গেল, যখন তিনি আল্লাহর কাছ থেকে আশার বাণী শুনতে পেলেন। সুমহান আল্লাহ বললেন—
"আর একদম ভয় করবে না এবং চিন্তাও করবে না। নিশ্চয়ই আমি তোমার সন্তানকে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেবো এবং তাকে রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত করব" (সূরা কাসাস, আয়াত ৭)
ওই জায়গায় আমি কিংবা আপনি হলে যে ভয় এবং যে ভীতি আমাদের অন্তরকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরত, একই ভয় মুসা আলাইহিস সালামের মায়ের মনেও জেঁকে বসেছিল। তবে তিনি হতোদ্যম হয়ে যাননি। আশা ছেড়ে দেননি। তিনি চোখমুখ বন্ধ করে এমন এক সত্তার ওপর ভরসা করেছিলেন যার দেওয়া আশা কখনো মিথ্যে হয় না। যিনি কখনোই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। এরপর ফলাফল কী হলো তা আমরা সকলেই জানি। মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা রক্ষা করেছিলেন। কেবল রক্ষাই করেননি, যে শত্রু হন্যে হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসে ছিল, সেই শত্রুর অন্দরমহলেই শিশু মুসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা বড় করে তুলেছিলেন। এই পরিকল্পনা কার? কে এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা রাখেন? তিনি সুমহান আল্লাহ।
"তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহ কৌশল করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী " (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৫৪)
আমরা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ঘটনাও স্মরণ করতে পারি। শিশু ইউসুফ ছিলেন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের সবচেয়ে প্রিয় সন্তান। ইউসুফের প্রতি পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের এই অবর্ণনীয় ভালোবাসাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি তার অন্য সহোদরেরা। হিংসার বশবর্তী হয়ে, খেলার নাম করে তারা ছোট্ট ইউসুফকে ফেলে দেয় এক অন্ধকার কূপের মধ্যে।
পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে এসে তারা খুব সুন্দর কাহিনি ফেঁদে বসল। বলল, ‘বাবা, খেলার মাঠ থেকে ইউসুফকে বাঘ খেয়ে ফেলেছে!’ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম জানতেন, তার ছেলেরা তার কাছে এসে মিথ্যে কথা বলছে। তিনি এটাও জানতেন, তারা নিশ্চিত ইউসুফের কোনো ক্ষতি করে বসেছে। এতৎসত্ত্বেও তিনি কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করলেন না। প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে হারানোর বেদনায় মাথা চাপড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন না। এমনকি ছেলেদের তিনি কোনো কটু কথা, কোনো হুমকি-ধমকি পর্যন্তও দিলেন না। তিনি কী বলেছিলেন জানেন? কুরআনে এসেছে-
"সুতরাং, আমার করণীয় হচ্ছে সুন্দর এবং সুস্থিরভাবে ধৈর্যধারণ করা। আর তোমরা আমার কাছে যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে আল্লাহই হলেন আমার একমাত্র সাহায্যদাতা "(সূরা ইউসূফ, আয়াত ১৮)
আল্লাহর ওপর ভরসার পারদ কতটা উঁচুতে থাকলে এমন মুহূর্তে একজন বাবা এ রকম কথা বলতে পারে? এভাবে ধৈর্যের চরম পরীক্ষা দিতে পারে? আর সেই ধৈর্যের বিনিময় কতটা বিশাল ছিল তা তো আমরা জানি। ইউসুফ আলাইহিস সালামকে পরবর্তীকালে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মিশরে অধিষ্ঠিত করেন রাজার বিশ্বস্ত লোক হিশেবে। যে ভাইগুলো তার সাথে শত্রুতা করে একদিন তাকে কূপে ফেলে দিয়েছিল, তাদেরকেই তিনি তার পায়ের কাছে এনে ফেলেছিলেন। তিনি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে, আর ইউসুফ আলাইহিস সালামের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়তম পিতাকে। সুবহানাল্লাহ! কত সুন্দর আল্লাহর জুড়ে দেওয়া মেলবন্ধন! কত চমৎকারই-না বিপদে ধৈর্যধারণের ফল!
সুতরাং, দুনিয়াবি কষ্টগুলোতে, ‘না পাওয়া’ ও ‘হারিয়ে ফেলা’ গুলোতে একজন মুমিন কখনোই হতাশ হবে না। চরম বিপদের মুহূর্তে, উভয় সংকটের সময়ে মুসা আলাইহিস সালামের মাতা আল্লাহর দেওয়া ফয়সালাই মাথা পেতে গ্রহণ করেছিলেন এবং অপেক্ষা করেছিলেন আল্লাহর কৃত ওয়াদার ফললাভের জন্য। পুত্র হারানোর শোকের দিনেও নবি ইয়াকুব আলাইহিস সালাম দেখিয়েছেন ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা। আল্লাহ তাদের কাউকেই হতাশ করেননি। আন্তরিক সবর এবং আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল তথা ভরসা করার জন্য আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় প্রদান করেছেন। মুসা আলাইহিস সালামের মাতার যিনি রব, তিনি আপনারও রব। যিনি ইয়াকুব আলাইহিস সালামের প্রতিপালক, তিনি আপনারও প্রতিপালক। মুসার মাতা যার ওপরে ভরসা করেছিলেন, আপনিও তাঁর ওপরে ভরসা করুন। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু যেখানে, আপনিও ঠিক সেই জায়গায় আপনার সমস্ত আশা আর ভরসাকে সমর্পণ করুন। যিনি মুসার মাতার অন্তরকে প্রশান্ত করতে পারেন, তিনি কি আপনার ভেঙে খানখান হয়ে যাওয়া হৃদয়ে প্রশান্তির ফল্গুধারা বইয়ে দিতে পারেন না? যিনি মুসা আলাইহিস সালামকে তার চরম শত্রুর ঘরের মধ্যে বড় তুলতে পারেন, তিনি কি চাইলে আপনার দুঃখ, আপনার ব্যথা উপশম করে দিতে পারেন না? যে মহান রব মুসার মাতার আর ইয়াকুব আলাইহিস সালামের ভরসার প্রতীক হয়েছিলেন, আস্থার প্রতীক হয়েছিলেন, সেই রবকে আপনিও আপনার সকল আশাভরসার প্রতীক বানিয়ে ফেলুন। জীবনের সমস্ত দুর্যোগে কেবল তাঁর ওপরই ভরসা করুন। দেখবেন আপনার জীবন এক অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে গেছে।
সূত্র: আরিফ আজাদ
A
No comments:
Post a Comment