Tuesday, January 14, 2025

ইসলাম ও গ্যাসলাইটিং

 মিথ্যা বলা গ্যাসলাইটিংয়ের প্রধান হাতিয়ার

gaslighting, an elaborate and insidious technique of deception and psychological manipulation, usually practiced by a single deceiver, or “gaslighter,” on a single victim over an extended period.
গ্যাসলাইটিং , এর একটি বিস্তৃত এবং কপট কৌশলপ্রতারণা এবং মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশন, সাধারণত একটি একক প্রতারক দ্বারা অনুশীলন করা হয়, বা "গ্যাসলাইটার", একটি বর্ধিত সময়ের জন্য একক শিকারের উপর। এর প্রভাব হল সত্য থেকে মিথ্যা, সঠিক থেকে ভুল, বা চেহারা থেকে বাস্তবতাকে আলাদা করার তাদের নিজস্ব ক্ষমতার উপর ভুক্তভোগীদের আত্মবিশ্বাসকে ধীরে ধীরে হ্রাস করা, যার ফলে তাদের চিন্তাভাবনা বা অনুভূতিতে গ্যাসলাইটারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্তদেরআত্মসম্মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা মানসিক সমর্থন এবং বৈধতার জন্য গ্যাসলাইটারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে অভিপ্রেত (এবং অর্জিত) ফলাফল শিকারদের তাদের বিবেক কেড়ে নেওয়া। ঘটনাটি ক্লিনিকাল সাহিত্যে একটি ফর্ম হিসাবে প্রমাণিত হয় নার্সিসিস্টিক অপব্যবহার যার মাধ্যমে চরম নার্সিসিস্টরা দুর্বল লোকেদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মানসিক ক্রীতদাসে রূপান্তর করার মাধ্যমে ধ্রুবক নিশ্চিতকরণ এবং সম্মানের জন্য তাদের প্যাথলজিকাল প্রয়োজনীয়তা মেটানোর চেষ্টা করে, যাদের নার্সিসিস্টরা তাদের শিকারের জন্য বিদ্বেষপূর্ণভাবে ঘৃণা করে। যেহেতু গ্যাসলাইটাররা নিজেরাই সাধারণত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তারা প্রায়শই তারা কী করছে বা কেন তারা তা করছে সে সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয়।
গ্যাসলাইটিং শব্দটি 1938 সালের একটি ব্রিটিশ মঞ্চ নাটকের শিরোনাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে,গ্যাস লাইট , যা পরবর্তীতে একটি চলচ্চিত্র হিসাবে উত্পাদিত হয়েছিল,গ্যাসলাইট , যুক্তরাজ্যে (1940) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (1944)। এই নাটকগুলি স্পষ্টভাবে, যদি কিছুটা সরলভাবে, কৌশলটির কিছু মৌলিক উপাদানকে চিত্রিত করে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে: ভুক্তভোগীদের স্বজ্ঞাতভাবে উদ্ভট বা আপত্তিকর কিছুর সত্যতা বোঝানোর চেষ্টা করা জোরপূর্বক জোর দিয়ে বা ভাসাভাসা প্রমাণ মার্শাল করে; স্পষ্টতই অস্বীকার করা যে কেউ এমন কিছু বলেছে বা করেছে যা একজন স্পষ্টতই বলেছে বা করেছে; ভুক্তভোগীদের বিপরীত উপলব্ধি বা অনুভূতিকে অবৈধ বা প্যাথলজিকাল হিসাবে বরখাস্ত করা; জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং গ্যাসলাইটারের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে এমন ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যকে অভিযুক্ত করা; অন্যান্য ব্যক্তি সহ তথ্য এবং বৈধতার স্বাধীন উত্স থেকে ভুক্তভোগীদের ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করা;ক্ষতিগ্রস্থদেরতাদের স্মৃতি বা উপলব্ধির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করতে উত্সাহিত করার জন্য শারীরিক পরিবেশের হেরফের করা। নাটক এবং চলচ্চিত্রগুলিতে, উদাহরণস্বরূপ, একজন প্রতারক স্বামী তার স্ত্রীকে উন্মাদনার কাছাকাছি নিয়ে যায় এবং তাকে বোঝায় যে সে একজন ক্লেপ্টোম্যানিয়াক এবং সে কেবল অ্যাটিকের শব্দ এবং তাদের বাড়ির গ্যাসলাইটের আলোর কথা কল্পনা করেছে, যা আসলে ছিল তার স্বামী তার খালার হারিয়ে যাওয়া গয়না খোঁজার ফলাফল। যদিও নাটক এবং চলচ্চিত্রে গ্যাসলাইটার একজন পুরুষ এবং শিকার একজন মহিলা, গ্যাসলাইটার এবং তাদের শিকার যে কোনও লিঙ্গের ব্যক্তি হতে পারে।
মানুষের মনোবল ভেঙে দিয়ে তাকে মানসিক শোষণের অন্যতম একটি কায়দা হলো গ্যাসলাইটিং। এর ধর্মীয় বিধান জানার আগে আমাদের জানতে হবে, গ্যাসলাইটিং মূলত কী, কেন করা হয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরে এটি কিভাবে প্রভাব ফেলছে।
গ্যাসলাইটিং কী : ‘গ্যাসলাইটিং’ পরিভাষাটির সঙ্গে আমরা খুব বেশি পরিচিত না হলেও আমাদের সমাজে এই কাজটির প্রচলন খুব বেশি। কোনো দৃশ্যমান অস্ত্র ব্যবহার না করে মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়ার হাতিয়ার এটি।
পরিভাষায় পৈশাচিক এই মানসিক অত্যাচারে কারিগরকে কিংবা মানসিক শোষককে বলা হয় গ্যাসলাইটার। আর শোষিত ব্যক্তিকে বলা হয় ভিকটিম।
গ্যাসলাইটাররা খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের টার্গেটের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাকে যত্রতত্র লোক সম্মুখে হেয় করে অসহায় ও দুর্বল করে তোলে। ভিকটিমের মনের মধ্যে তার নিজেকে নিয়ে সংশয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব—এ ধরনের বিষয়গুলো পোক্ত করে দেয়।
গ্যাসলাইটিং কেন করা হয় : মূলত অন্য ব্যক্তির ওপর এক ধরনের মানসিক নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার জন্য এবং নিজেকে ক্ষমতাশীল পর্যায়ে রাখার জন্যই মানুষ এমন আচরণ করে থাকে। যেসব ব্যক্তি এ ধরনের ব্যবহারের শিকার হন তাঁরা দ্বিধান্বিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং ক্রমে নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং তখনই তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তির পক্ষে।
আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.)-কে হেয় করে মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য তাঁর শত্রুরা অন্যান্য অস্ত্রের মতো এই অস্ত্র ব্যবহার করতেও ভোলেনি। নবীজি (সা.)-এর শিশুপুত্র ইন্তেকাল করলে তারা প্রচার করতে শুরু করে যে, ‘তাঁর বংশ বিস্তৃত হবে না, শিকড় কাটা, তাঁর ধর্ম এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
’ (নাউজুবিল্লাহ!), প্রিয় নবীজি (সা.)-এর মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা তাদের সেই দোষারোপের জবাব মহান আল্লাহ নিজে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রাসুল) নিশ্চয়ই আমি আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামাজ পড়ুন ও কোরবানি করুন। নিশ্চয়ই যারা আপনার শত্রু, তারাই শিকড় কাটা।
(সুরা : কাউসার, আয়াত : ১-৩)
গ্যাসলাইটিংয়ের বিভিন্ন রূপ : গ্যাসলাইটিং আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রূপে বাস করে। এটা শুধু স্বামী-স্ত্রীর টক্সিক রিলেশনে সীমাবদ্ধ নয়। যেমন—১ নম্বরে রয়েছে পারিবারিক গ্যাসলাইটিং। এটি বিভিন্ন রকম হতে পারে, যেমন—স্বামী কিংবা স্ত্রী তার জীবনসঙ্গীকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ কিংবা ছোট করতে গ্যাসলাইটিং করে। তার বিভিন্ন দুর্বল দিক বের করে তাকে খোঁটা দেয়, অন্যদের সামনে হেয় করে, অসম্মান করে। তার প্রাপ্য সম্মান তো তাকে দেয়ই না, বরং বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে তাকে হতাশায় ফেলে দেয়। অথচ পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন এবং একে অপরের মতকে গুরুত্ব দিলে পরিবার অনেক সুখময় হয়। আমাদের নবীজি (সা.)-এর স্ত্রীরা সব সময় তাঁর মতকে সম্মান করেছেন। তিনিও বিভিন্ন বিষয়ে স্ত্রীদের মতকে সম্মান ও গুরুত্ব দিয়েছেন। যেমন—হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামাহ (রা.)-এর মতকে গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। (বুখারি, হাদিস : ২৭৩১)
অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবাও নিজেদের অজান্তে তাঁদের আদরের সন্তানের সঙ্গে গ্যাসলাইটিং করে বসেন। সন্তানকে অন্যের সামনে দুর্বল, বোকা, লেখাপড়ায় খারাপ, কিছু পারে না—এ ধরনের কথা বলে শাস্তি দেন। এতে সন্তানের আত্মবিশ্বাস ও কর্মোদ্দীপনা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। সে নিজেকে চরম গৌণ বা অচ্ছুত বলে ভাবতে শুরু করে। এ ধরনের কাজ সন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রতিবন্ধক। এ ধরনের আচরণের ফলে সন্তানের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি থাকে। ইসলাম সন্তানকে আদব শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনে প্রহার করারও সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু এমন কাজ করা যাবে না, যা তাকে বেপরোয়া করে তোলে, যা তাদের জীবনে অকল্যাণ বয়ে আনবে। হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেরা শেখো এবং পরিবারবর্গকে শেখাও সব কল্যাণময় রীতি-নীতি এবং তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং এসব কাজে অভ্যস্ত করে তোল।’
(ফাতহুল কাদির : ৫/২৪৬)
সামাজিক গ্যাসলাইটিং : আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা ইচ্ছা করে অন্য মানুষের বয়স, চেহারা, পোশাক, লিঙ্গ, জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাস নিয়ে বাজে মন্তব্য করে বা ছোট করে। এটাকে জাতিগত গ্যাসলাইটিং বলে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা, কোনো সম্প্রদায় যেন অন্য কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা কোরো না এবং তোমরা একে অন্যকে মন্দ উপনামে ডেকো না। ঈমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তাওবা করে না, তারাই তো জালিম।’
(সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১১)
আমাদের সমাজে আলেমরাও এই গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন, বিশেষ করে মাদরাসাপড়ুয়া ছাত্ররা অনেক সময় তাদের আত্মীয় থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধবের দ্বারাও গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হয়, যা তাদের প্রতি চরম অন্যায়। উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘ওই ব্যক্তি আমার আদর্শের ওপর নেই, যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের আলেমদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান করে না।’ (মুসনাদে আহমাদ,
হাদিস : ২২১৪৩, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস : ৩৮৪)
আরেক প্রকারের গ্যাসলাইটিং হলো, রাজনৈতিক গ্যাসলাইটিং। রাজনৈতিক গ্যাসলাইটিং হচ্ছে যখন একটি রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলকে হেয় করার জন্য মিথ্যা বলে বা জনগণের কাছে মিথ্যা বলে। অনেক সময় নিজেদের ভুল ঢাকার জন্য এমন বিতর্কের জন্ম দেয় যে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে যায়।
চাকরির ক্ষেত্রেও মানুষ নানাভাবে হেয় হয়। একজন দক্ষ কর্মীকেও তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করার মাধ্যমে পেশাগতভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও গ্যাসলাইটিং হয়। সৎ ও যোগ্য কর্মীরাই কর্মক্ষেত্রের সিন্ডিকেটগুলোর দ্বারা নানাভাবে গ্যাসলাটিংয়ের শিকার হয়। সামনে-পেছনে অযৌক্তিক সমালোচনা করে তাদের ফোটানো ফুলকে ভুল আখ্যা দিয়ে, তাদের নিষ্ঠা ও ত্যাগকে কৌশলে অবমাননা করে তাদের কোণঠাসা করে দেওয়া হয়। ইসলামে এ ধরনের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, দুর্ভোগ আছে প্রত্যেক এমন ব্যক্তির, যে পেছনে অন্যের বদনাম করে (এবং) মুখের ওপরও নিন্দা করে।
(সুরা : হুমাজাহ, আয়াত : ১)
আর মিথ্যা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং অন্যের চরিত্র হরণের জন্য মিথ্যা অপবাদ দেওয়া মুনাফিকের স্বভাব। মুনাফিকরা আয়েশা (রা.)-কে হেয় করে মূলত নবীজি (সা.) ও মুসলমানদের সংশয়ে ফেলে দেওয়ার জন্য আয়েশা (রা.)-এর চরিত্র নিয়ে মিথ্যা রটিয়েছিল। তখন মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করে তাদের সেই মিথ্যা প্রপাগান্ডার জবাব দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা এ অপবাদ রটনা করেছে, তারা তোমাদেরই একটি দল। এটাকে তোমরা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর মনে কোরো না, বরং এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। তাদের থেকে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে, যতটুকু পাপ সে অর্জন করেছে। আর তাদের থেকে যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্য রয়েছে মহা আজাব। (সুরা : নুর, আয়াত : ১১)
গ্যাসলাইটাররা যে পদ্ধতিই অবলম্বন করে, তার উদ্দেশ্য থাকে ভিকটিমকে ‘ওয়াসওয়াসায়’ ফেলে দেওয়া। সম্ভবত এরাও তাদের একটি অংশ, সুরা নাসে মহান আল্লাহ যে মানব শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচতে মানুষকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
এককথায় বলতে গেলে গ্যাসলাইটিং পদ্ধতিতে সাময়িক কাউকে ঠকিয়ে ও দমিয়ে পৈশাচিক শান্তি পেলেও এর পরিণাম ভয়াবহ। কারণ গ্যাসলাইটের শিকার হওয়া ব্যক্তি মাজলুম হয়। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, বিশ্বনবী (সা.) যখন মুয়াজ (রা.)-কে ইয়েমেনে পাঠান এবং তাঁকে বলেন, মাজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা, তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। (বুখারি, হাদিস : ২৪৪৮)
মহান আল্লাহ সবাইকে এ কাজ থেকে হেফাজত করুন।
সূত্র: মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
নিজ পাঠ
গ্যাসলাইটিং: এক ধরনের মানসিক শোষণ
'তুমি তো কিছুই বোঝো না', 'আরেহ বোকা', 'তোমাকে দিয়ে এসব জটিল কাজ হবে না', 'আরে ও তো শিল্পী মানুষ, এসব হিসাব বুঝবে নাকি!'– এমনই আরও অনেক কটূক্তি আমাদের আশেপাশে প্রায়ই ঘুরপাক খায়। শুনে একটু মন খারাপ হয় কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো 'যথেষ্ট' কি না, বুঝে উঠতে না পেরে মুখ বুজে থাকা। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এসব কথাবার্তাই গ্যাসলাইটিং।
মানুষের নেতিবাচক আচরণ হিসেবে শব্দটির প্রচলন শুরু হয় একটি নাটকের মাধ্যমে। ১৯৩৮ সালে 'গ্যাস লাইট' নামে নাটকটি মঞ্চায়িত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একই গল্প ও নাম অবলম্বনে ১৯৪০ সালে মুক্তি পায় একটি চলচ্চিত্র। অবশ্য জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় ১৯৪৪ সালের 'গ্যাস লাইট' সিনেমাটি থেকে, যাতে চার্লস বয়ার ও ইনগ্রিড বার্গ্যমান অভিনয় করেছিলেন। প্রতিটিতেই গল্পের মূল ছাঁচটা ছিল এক। একজন পুরুষ প্রোটাগনিস্ট তার স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, তার সব ভাবনাই মিথ্যা, কল্পনামাত্র– এমনকি তাদের বাড়ির গ্যাস লাইটের জ্বলা-নেভাও। তিনি বাস্তবকে অবাস্তবরূপে তার স্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করছিলেন। এমনকি স্ত্রী চরিত্রটিও এক পর্যায়ে সেসব কথা বিশ্বাস করে ফেলেন এবং নিজেকে পাগল ভাবতে শুরু করেন।
ঠিক এমনটাই ঘটে যখন কোনো ব্যক্তি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন। গ্যাসলাইটিং একপ্রকার মানসিক শোষণ। বলা যায়, মানসিক শোষণের বিভিন্ন কায়দার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে গ্যাসলাইটিং। অন্যসব শোষণের মতো এ প্রক্রিয়াতেও দুটো পক্ষ থাকে। শোষক বা গ্যাসলাইটার ও শোষিত বা ভিকটিম। গ্যাসলাইটার ব্যক্তিটির চেষ্টা থাকে ভিক্টিমের মনের মধ্যে নিজেকে নিয়ে সংশয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব– এ ধরনের বিষয়গুলো পোক্ত করে দেওয়ার। মূলত অন্য ব্যক্তির ওপর এক ধরনের মানসিক নিয়ন্ত্রণ পাবার জন্য ও নিজেকে ক্ষমতাশীল পর্যায়ে রাখার জন্যই মানুষ এমন আচরণ করে থাকে।
কাউন্টারিং
এ ধরনের গ্যাসলাইটিংয়ে ব্যক্তি অন্যের স্মৃতি নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। যেকোনো কিছু বলার পর বা কোনো মতামত দেবার পর, 'তুমি নিশ্চিত তো?', 'তুমি তো সব ভুলে যাও' – এ ধরনের কথাবার্তা নিয়মিত বলার মাধ্যমে এই চর্চাটি করা হয়। এবং এর মধ্য দিয়ে ভিক্টিম নিজেও এক সময় বিশ্বাস করে ফেলেন যে তার কিছুই মনে থাকে না, তিনি আসলে বিষয়টি ভুলে গেছেন বা ভুল বলছেন। এ ধরনের গ্যাসলাইটিংয়ের বেশ চূড়ান্তরকম উদাহরণ দেখা যায় সত্যজিৎ রায়ের 'বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম' গল্পটিতে।
উইথহোল্ডিং
কথোপকথনে গ্যাসলাইটিংয়ের আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে 'উইথহোল্ডিং'। এর মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে ইচ্ছে করে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করেন, যাতে অপর ব্যক্তিটি নিজের কথা নিয়ে অতি সচেতন হয়ে পড়েন। কিংবা তার মনে হয়, তিনি কিছুই গুছিয়ে বা বুঝিয়ে বলতে পারছেন না। এতে করে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নতুন আসা শিক্ষকদের সঙ্গে এমনটা অনেক অমনোযোগী শিক্ষার্থীই করে থাকে।
তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা
'ট্রিভিয়ালাইজিং' বা তুচ্ছকরণ হচ্ছে অত্যন্ত স্থূল কিন্তু বহুল প্রচলিত গ্যাসলাইটিংয়ের নমুনা। অপর ব্যক্তিটিকে সারাক্ষণ হেয় করা, তাদের অনুভূতিগুলোর যথাযথ মূল্য নেই– এমনটা মনে করানোর চেষ্টা হয় এ প্রক্রিয়ায়। বন্ধুদের দল বা কর্মক্ষেত্র, এমনকি পরিবার থেকে শুরু সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নরম স্বভাবের মানুষদের সঙ্গে এমনটা করার চর্চা রয়েছে। বিষয়টিকে 'হাস্যকর' ধরে নিয়ে হাসাহাসি করার মাধ্যমে যে কারও মানসিক স্বাস্থ্যের কতটা ক্ষতি হচ্ছে, তারা কীভাবে অনেক বেশি সংশয়গ্রস্ত ও অনেক কম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন– সেদিকে কম লোকই খেয়াল করেন। তাই হয়তো ছোটবেলায় খেলার সাথীদের ডাকা 'দুধভাত' তকমাটি অনেকেই আজীবন গায়ে নিয়ে ঘোরেন।
ডিনায়াল বা অস্বীকৃতি
খুব সহজ ভাষায় বললে, মিথ্যা বলা। মিথ্যা বলা গ্যাসলাইটিংয়ের প্রধান হাতিয়ার। অতীতে কোনো কিছু করে বা বলে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে সেটি একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া, অস্বীকার করা ইত্যাদি 'ডিনায়াল'-এর অংশ। নিজে মিথ্যা বলে অপর ব্যক্তিকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা চলে এতে।
স্টেরিওটাইপিং বা ছাঁচিকরণ
ব্যক্তির জেন্ডার, পেশা, এলাকা ইত্যাদি নিয়ে একটা আরোপিত ধারণার চর্চাই স্টেরিওটাইপিংয়ের মূলে। যেমন ধরা যাক, 'নোয়াখালির মানুষ তো, তাই খাবার পরই চলে যাচ্ছে' বা 'মেয়ে মানুষের বুদ্ধি!' – এ ধরনের খোঁচা মারা কথাবার্তার মাধ্যমে মানুষকে প্রতিনিয়ত গ্যাসলাইট করা হয়। এতে করে ভিক্টিম যদি আবার প্রতিবাদ করে, তখন সে 'মজা বোঝে না' বলে আবার তুচ্ছ করার প্রবণতাও দেখা যায়।
চলতি জীবনে আমরা বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগে সংযুক্ত হই। বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করি। এর মধ্যে সংবেদনশীল-অসংবেদনশীল, দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের পরিচয় ঘটে থাকে। চোখ বুজে বোধ হয় কেউই বলতে পারবেন না কখনো গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হননি বা মনের ভুলেও অন্যের সঙ্গে এমন আচরণ করেননি। তবে সচেতনতার কোনো সময় হয় না, যেকোনো সময়ই এসব বিষয়ে একটু সচেতন, একটু সংবেদনশীল হওয়া যায়। গ্যাসলাইটিংয়ে শিকার হলে সরাসরি প্রতিবাদ করা এবং অন্যের সঙ্গে গ্যাসলাইটিং না করার চর্চা হোক। সবার মানসিক সুস্থতা বজায় থাকুক।
তথ্যসূত্র: ফোর্বস, হোমওয়ার্ক, নিউপোর্ট ইনিস্টিটিউট
https://bangla.thedailystar.net/life-living/news-467821
নিজ পাঠ

No comments:

Post a Comment