ইলিশ (বৈজ্ঞানিক নাম:Tenualosa ilisha, Hilsa ilisha) বাংলাদেশের জাতীয় মাছ।
তুমুল বর্ষণ বা ইলশে গুঁড়ি, বর্ষার ধরন যা–ই হোক না কেন, বাঙালি মনে বর্ষার সঙ্গে ইলিশের সম্পর্ক যেন জোড়া লেগে গেছে। সময় বড় খারাপ চলছে, করোনা ভাইরাসের এই কালে মানুষ স্বাদের কথা শিকেয় তুলে খুঁজছেন পুষ্টিগুণ! বাঙালির খাওয়া কন্টিনেন্টালের চাকা ছেড়ে ফিরে এসেছে মা -দাদীর তুলসি -হলুদে৷ সবেতেই হিসেব যাক বাবা দিনের কৌটার ভিটামিন সি খাওয়া হল, জিঙ্কটা ঠিক গেল তো! তবে বাঙালিকে খুশি করার মতো খবর আছে এখানে৷ তাদের সবচেয়ে পছন্দের মাছ -অর্থাত ইলিশ খেতে পারেন জমিয়ে৷ কারণ মাছের রাজা তো আর সে শুধু শুধু হয়নি, পুষ্টিগুণে ভরপুর এই সুস্বাদু মাছ ৷
ফ্যাট ২ ধরণের হয় আর ইলিশ মাছে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি৷ তবে সেটি হল ভাল ফ্যাট- হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এইচ.ডি.এল৷ ইলিশ মাছে পলি আনস্যাচুরেটেড এবং মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণই বেশি যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারি৷ মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছ সবচেয়ে পুষ্টিকর৷ মোটামুটি সাতশো গ্রাম থেকে এক কেজির ওজনের ইলিশ মাছের মধ্যেই একমাত্র পলি ও মনো আন-স্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায়৷
এর চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ মাছ হলেই জানবেন সেটিতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ অনেক বেশি৷ সেটা আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর৷ তবে একদম কম ওজনের ইলিশ মাছ যাকে খোকা বা জাটকা ইলিশও বলা হয় সেটা কিন্তু ততটা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ নয়৷ এই মাছে প্রোটিনের পরিমাণ বেশ কম৷
তাই মাঝারি সাইজের ইলিশ মাছ আছে প্রচুর প্রোটিন, জিঙ্ক, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়ামের মতো খনিজ৷ ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে রয়েছে ২২.৩ শতাংশ প্রোটিন৷ করোনা কালে জিঙ্কের গুরুত্ব সকলেই এতদিন জেনে গেছেন৷ এছাড়াও জিঙ্ক ডায়াবেটিস রোগীদের পক্ষে খুব ভালো৷ সেলেনিয়াম আবার অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের কাজ করে৷ এছাড়াও রয়েছে ক্যালসিয়াম আর আয়রনের পুষ্টিগুণও৷
ইলিশ মাছ এবং ইলিশ মাছের তেল হার্টের জন্যও খুব ভালো৷ যাদের কোলেস্টরল বেশি তারাও ইলিশ মাছ খাবেন৷ কারণ তা খারাপ কোলেস্টেরল বা লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এল.ডি.এলকে কমিয়ে দেয়৷ এল.ডি.এল বেড়ে গেলে কিন্তুহার্ট ব্লকের সমস্যা হতে পারে৷
ভিটামিন এ, ডি এবং ই-ও ভরে রয়েছে ইলিশ মাছে৷ বিশেষ করে ভিটামিন ডি কিন্ত্ত খুব কম খাবারেই পাওয়া যায়৷ বাতের ব্যাথা কমাতে ও অস্টিওপোরোসিসের জন্যও ইলিশ মাছ খুব ভালো৷
ইলিশ মাছে আরজিনিন থাকায় তা ডিপ্রেশনের জন্যও খুব ভালো৷ তাছাড়া ইলিশ মাছ ক্যান্সার প্রতিরোধক৷ হাঁপানি-র উপশমেও উপকারি৷ আবার সর্দি কাশি প্রতিরোধেও দারুণ কার্যকরী৷
ইলিশের পাতুরি-ভাপা-ঝাল -ঝোলও সবই সুস্বাদু তাই যেটা ইচ্ছা সেটাই খেতে কোনও বাধা নেই৷ কিন্তু একটাই জিনিস মাথায় রাখবেন ইলিশ মাছটা যেন প্রচণ্ড কড়া করে না ভাজা হয়৷ কারণ উঁচু আঁচে প্রোটিন যেমন নষ্ট হয়ে যায় ঠিক তেমনিই অন্যান্য গুণগুলিও নষ্ট হয়ে যায়৷ তাই মাছটা যেন কম ভাজা হয় শুধু এটাই নজর রাখবেন৷
ইলিশ এক নজরে
১। হার্ট- ইলিশ মাছে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। অন্য দিকে প্রচুর পরিমাণ ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকে। ফলে হার্ট থাকে সুস্থ।
২। রক্ত সঞ্চালন- সামুদ্রিক মাছে থাকা ইপিএ ও ডিএইচএ ওমেগা-থ্রি-অয়েল শরীরে ইকসিনয়েড হরমোন তৈরি রুখতে পারে। এই হরমোনের প্রভাবে রক্ত জমাট বেঁধে শিরা ফুলে যায়। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন ভাল হয়। থ্রম্বসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে।
৩। বাত- ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের সঙ্গে অস্টিওআর্থারাইটিসের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। প্রতি দিনের ডায়েটে সামুদ্রিক মাছ থাকলে বাতের ব্যথা, গাঁট ফুলে গিয়ে যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
৪। চোখ- তেলযুক্ত মাছ খেলে চোখের স্বাস্থ্য ভাল থাকে, চোখ উজ্জ্বল হয়। বয়সকালে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসার মোকাবিলা করতে পারে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। ইলিশ মাছের মধ্যে থাকা ভিটামিন এ রাতকানার মোকাবিলা করতেও সাহায্য করে।
৫। প্রয়োজনীয় খনিজ- ইলিশ মাছে রয়েছে আয়ডিন, সেলেনিয়াম, জিঙ্ক, পটাশিয়াম। থায়রয়েড গ্ল্যান্ড সুস্থ রাখে আয়ডিন, সেলেনিয়াম উত্সেচক ক্ষরণে সাহায্য করে যা ক্যানসারের মোকাবিলা করতে পারে। এ ছাড়াও ভিটামিন এ ও ডি-র উত্কৃষ্ট উত্স ইলিশ মাছ।
৬। ফুসফুস- বহু গবেষণায় দেখা গিয়েছে সামুদ্রিক মাছ ফুসফুসের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে কার্যকরী। শিশুদের ক্ষেত্রে হাঁপানি রোধ করতে পারে ইলিশ মাছ। যাঁরা নিয়মিত মাছ খান তাঁদের ফুসফুস অনেক বেশি শক্তিশালী হয়।
৭। অবসাদ- ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড অবসাদের মোকাবিলা করতে পারে। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার (SAD), পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশন কাটাতে পারে ইলিশ মাছ।
৮। ত্বকের যত্নে- সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে ওমেগা ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। নিয়মিত মাছ খেলে একজিমা, সোরেসিসের হাত থেকে রক্ষা পায় ত্বক। ইলিশ মাছে থাকা প্রোটিন কোলাজেনের অন্যতম উপাদান। এই কোলাজেন ত্বক টাইট ও নমনীয় রাখতে সাহায্য করে।
৯। পেটের যত্নে- ডায়েটে তেলযুক্ত মাছ থাকলে পেটের সমস্যা অনেক কম হয়। আলসার, কোলাইটিসের হাত থেকে রক্ষা করে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যসিড।
১০। ব্রেন- মস্তিষ্কের ৬০ শতাংশই তৈরি ফ্যাট দিয়ে। যার অধিকাংশই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। যাঁরা নিয়মিত মাছ খান তাঁদের মধ্যে বয়স কালে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক কম দেখা যায়। শিশুদের মস্তিষ্কের গঠনেও সাহায্য করে ডিএইচএ। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার(ADHD) রোধ করতে পারে ইলিশ মাছ। স্মৃতিশক্তি, পড়াশোনায় মনযোগ বাড়ায়।
শুধু দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার প্রায় ২৬ কোটি মানুষ ইলিশ মাছ খায়। স্যামন ও টুনার পরেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে জনপ্রিয় মাছ হচ্ছে ইলিশ। ওয়ার্ল্ড ফিশের হিসাবে ওমেগা-৩ পুষ্টিগুণের দিক থেকে স্যামন মাছের পরেই ইলিশের অবস্থান।
বিশ্বজুড়ে বর্তমানে ইলিশের পুষ্টিগুণের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ইলিশ মাছে ক্ষতিকর স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ একেবারেই কম। অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকায় রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা কম থাকে। ফলে হৃদ্যন্ত্র থাকে সুস্থ। ইলিশ মাছ খেলে শরীরে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। থ্রম্বসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে। এ ছাড়া ভিটামিন এ ও ডির উতকৃষ্ট উতস ইলিশ। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াল, বাঙালির ইলিশই তো সেরা।
No comments:
Post a Comment