Wednesday, May 20, 2020

তাওবায়ে “নাসূহ“


মূল আয়াতে (নাসূহ-نَّصُوحًا) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে আরবী ভাষায় যার অর্থ নিষ্কলুষতা কল্যাণকামিতা খাঁটি মধু যা মোম অন্যান্য আবর্জনা থেকে মুক্ত করা হয়েছে তাকে আরবীতেনাসূহ বলা হয় ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে দেয়া এবং ফাঁটা ফাঁটা কাপড় ঠিক করে দেয়া বুঝাতে আরবীনাসূহ” শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ অতএব, তাওবা শব্দের সাথেনাসূহ”  বিশেষণ যুক্ত করলে হয় তার আভিধানিক অর্থ হবে এমন তাওবা যার মধ্যে প্রদর্শনী বা মুনাফিকীর লেশমাত্র নেই৷
অথবা তার অর্থ হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের কল্যাণ কামনা করবে এবং গোনাহ থেকে তাওবা করে নিজেকে মন্দ পারিণাম থেকে রক্ষা করবে৷ অথবা তার অর্থ হবে গোনাহর কারণে তার দীনদারীর মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তাওবা দ্বারা তা সংশোধন করবে৷
অথবা সে তাওবা করে নিজের জীবনকে এমন সুন্দর করে গড়ে তুলবে যে, অন্যের জন্য সে উপদেশ গ্রহণের কারণ হবে এবং তাকে দেখে অন্যরাও তার মত নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে৷
'তাওবায়ে নাসূহ'-এর আভিধানিক অর্থ থেকে অর্থসমূহই প্রতিভাত হয়৷ এরপর অবশিষ্ট থাকে তাওবায়ে নাসূহ এর শরয়ী অর্থ৷
আমরা এর শরয়ী অর্থের ব্যাখ্যা পাই যির ইবনে হুবাইশের মাধ্যমে ইবনে আবী হাতেম কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে৷ যির ইবনে হুবাইশ বলেনঃ আমি উবাই ইবনে কা'বের (রা) কাছে 'তাওবায়ে নাসূহ' এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃআমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একই প্রশ্ন করেছিলাম৷ তিনি বললেনঃ এর অর্থ হচ্ছে, কখনো তোমার দ্বারা কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তুমি নিজের গোনাহর জন্য লজ্জিত হবে৷ তারপর লজ্জিত হয়ে সে জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং ভবিষ্যতে আর কখনো কাজ করো না৷
হযরত উমর (রা), হযরত আবদুল্লাহ (রা) ইবনে মাসউদ এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকেও অর্থই উদ্ধৃত হয়েছে৷
অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে হযরত উমর 'তাওবায়ে নাসূহ' সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেঃ
'তাওবা' পরে পুনরায় গোনাহ করা তো দূরের কথা তা করার আকাংখা পর্যন্ত করবে না (ইবনে জারীর)
হযরত আলী (রা) একবার এক বেদুঈনকে মুখ থেকে ঝটপট করে তাওবা ইসতিগফারের শব্দ উচ্চারণ করতে দেখে বললেন, এতো মিথ্যাবাদীদের তাওবা৷
সে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সত্যিকার তাওবা কি? তিনি বললেন সত্যিকার তাওবার সাথে ছয়টি জিনিস থাকতে হবেঃ
() যা কিছু ঘটেছে তার জন্য লজ্জিত হও৷
() নিজের যে কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে গাফলতি করছ তা সম্পাদন কর৷
() যার হক নষ্ট করেছ তা ফিরিয়ে দাও৷
() যাকে কষ্ট দিয়েছ তার কাছে মাফ চাও৷
() প্রতিজ্ঞা করো ভবিষ্যতে গোনাহ আর করবে না৷ এবং
() নফসকে এতদিন পর্যন্ত যেভাবে গোনাহর কাজে অভ্যস্ত করেছ ঠিক তেমনি ভাবে আনুগত্যে নিয়োজিত কর৷ এতদিন পর্যন্ত নফসকে যেভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার মজায় নিয়োজিত রেখেছিলে এখন তাকে তেমনি আল্লাহর আনুগত্যের তিক্ততা আস্বাদন করাও(তাফসীরে কাশশাফ)
তাওবা সম্পর্কিত বিষয়ে আরো কয়েকটি জিনিস ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকারঃ
প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে তাওবা হচ্ছে কোন গোনাহের কারণে জন্য লজ্জিত হওয়া যে, তা আল্লাহর নাফরমানী৷ কোন গোনাহের কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বদনামের কারণ অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণ হওয়ায় তা থেকে বিরত থাকার সংকল্প করা তাওবার সংজ্ঞায় পড়ে না৷
দ্বিতীয়তঃ যখনই কেউ বুঝতে পারবে যে, তার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী হয়েছে, তার উচিত ততক্ষনাত তাওবা করা, এবং যেভাবেই হোক অবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণ করা কর্তব্য, তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়৷
তৃতীয়তঃ তাওবা করে বারবার তা ভঙ্গ করা, তাওবাকে খেলার বস্তু বানিয়ে নেয়া এবং যে গোনাহ থেকে তাওবা করা হয়েছে বার বার তা করতে থাকা তাওবা মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ কেননা, তাওবার প্রাণ সত্তা হচ্ছে, কৃত গোনাহ সম্পর্কে লজ্জিত হওয়া কিন্তু বার বার তাওবা ভঙ্গ করা প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে লজ্জার অনুভূতি নেই৷
চতুর্থতঃ যে ব্যক্তি সরল মনে তাওবা করে পুনরায় গোনাহ না করার সংকল্প করেছে মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি পুনরায় তার দ্বারা সেই গোনাহর পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে ক্ষেত্রে পূর্বের গোনাহ পুনরুজ্জীবিত হবে না তবে পরবর্তী গোনাহের জন্য তার পুনরায় তাওবা করা উচিত৷
পঞ্চমতঃ যখনই গোনাহর কথা মনে পড়বে তখনই নতুন করে তাওবা করা আবশ্যক নয়৷ কিন্তু তার প্রবৃত্তি যদি পূর্বের পাপময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দ পায় তাহলে গোনাহের স্মৃতিচারণ তাকে আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে লজ্জাবোধ সৃষ্টির কারণ না হওয়া পর্যন্ত তার বার বার তাওবা করা উচিত৷ কারণ, যে ব্যক্তি সত্যিই আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে তাওবা করেছে সে অতীতে আল্লাহর নাফরমানী করেছে এই চিন্তা করে কখনো আনন্দ অনুভব করতে পারে না; তা থেকে মজা পাওয়া আনন্দ অনুভব করা প্রমাণ করে যে, তার মনে আল্লাহর ভয় তার মনে গভীরভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি৷

No comments:

Post a Comment