মূল আয়াতে (নাসূহ-نَّصُوحًا) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ৷ আরবী ভাষায় যার অর্থ নিষ্কলুষতা ও কল্যাণকামিতা ৷ খাঁটি মধু যা মোম ও অন্যান্য আবর্জনা থেকে মুক্ত করা হয়েছে তাকে আরবীতে “নাসূহ“ বলা হয় ৷ ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে দেয়া এবং ফাঁটা ফাঁটা কাপড় ঠিক করে দেয়া বুঝাতে আরবী “নাসূহ” শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ অতএব, তাওবা শব্দের সাথে “নাসূহ” বিশেষণ যুক্ত করলে হয় তার আভিধানিক অর্থ হবে এমন তাওবা যার মধ্যে প্রদর্শনী বা মুনাফিকীর লেশমাত্র নেই৷
অথবা তার অর্থ হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের কল্যাণ কামনা করবে এবং গোনাহ থেকে তাওবা করে নিজেকে মন্দ পারিণাম থেকে রক্ষা করবে৷ অথবা তার অর্থ হবে গোনাহর কারণে তার দীনদারীর মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তাওবা দ্বারা তা সংশোধন করবে৷
অথবা সে তাওবা করে নিজের জীবনকে এমন সুন্দর করে গড়ে তুলবে যে, অন্যের জন্য সে উপদেশ গ্রহণের কারণ হবে এবং তাকে দেখে অন্যরাও তার মত নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে৷
'তাওবায়ে নাসূহ'-এর আভিধানিক অর্থ থেকে এ অর্থসমূহই প্রতিভাত হয়৷ এরপর অবশিষ্ট থাকে তাওবায়ে নাসূহ এর শরয়ী অর্থ৷
আমরা এর শরয়ী অর্থের ব্যাখ্যা পাই যির ইবনে হুবাইশের মাধ্যমে ইবনে আবী হাতেম কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীসে৷ যির ইবনে হুবাইশ বলেনঃ আমি উবাই ইবনে কা'বের (রা) কাছে 'তাওবায়ে নাসূহ' এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃআমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একই প্রশ্ন করেছিলাম৷ তিনি বললেনঃ এর অর্থ হচ্ছে, কখনো তোমার দ্বারা কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তুমি নিজের গোনাহর জন্য লজ্জিত হবে৷ তারপর লজ্জিত হয়ে সে জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং ভবিষ্যতে আর কখনো ঐ কাজ করো না৷
হযরত উমর (রা),
হযরত আবদুল্লাহ (রা) ইবনে মাসউদ এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকেও এ অর্থই উদ্ধৃত হয়েছে৷
অন্য একটি বর্ণনা অনুসারে হযরত উমর 'তাওবায়ে নাসূহ'র সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবেঃ
'তাওবা'র পরে পুনরায় গোনাহ করা তো দূরের কথা তা করার আকাংখা পর্যন্ত করবে না ৷ (ইবনে জারীর)৷
হযরত আলী (রা) একবার এক বেদুঈনকে মুখ থেকে ঝটপট করে তাওবা ও ইসতিগফারের শব্দ উচ্চারণ করতে দেখে বললেন, এতো মিথ্যাবাদীদের তাওবা৷
সে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সত্যিকার তাওবা কি? তিনি বললেন সত্যিকার তাওবার সাথে ছয়টি জিনিস থাকতে হবেঃ
(১) যা কিছু ঘটেছে তার জন্য লজ্জিত হও৷
(২) নিজের যে কর্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে গাফলতি করছ তা সম্পাদন কর৷
(৩) যার হক নষ্ট করেছ তা ফিরিয়ে দাও৷
(৪) যাকে কষ্ট দিয়েছ তার কাছে মাফ চাও৷
(৫) প্রতিজ্ঞা করো ভবিষ্যতে এ গোনাহ আর করবে না৷ এবং
(৬) নফসকে এতদিন পর্যন্ত যেভাবে গোনাহর কাজে অভ্যস্ত করেছ ঠিক তেমনি ভাবে আনুগত্যে নিয়োজিত কর৷ এতদিন পর্যন্ত নফসকে যেভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার মজায় নিয়োজিত রেখেছিলে এখন তাকে তেমনি আল্লাহর আনুগত্যের তিক্ততা আস্বাদন করাও(তাফসীরে কাশশাফ)৷
তাওবা সম্পর্কিত বিষয়ে আরো কয়েকটি জিনিস ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকারঃ
প্রথমতঃ প্রকৃতপক্ষে তাওবা হচ্ছে কোন গোনাহের কারণে এ জন্য লজ্জিত হওয়া যে, তা আল্লাহর নাফরমানী৷ কোন গোনাহের কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বদনামের কারণ অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণ হওয়ায় তা থেকে বিরত থাকার সংকল্প করা তাওবার সংজ্ঞায় পড়ে না৷
দ্বিতীয়তঃ যখনই কেউ বুঝতে পারবে যে, তার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানী হয়েছে, তার উচিত ততক্ষনাত তাওবা করা, এবং যেভাবেই হোক অবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণ করা কর্তব্য, তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়৷
তৃতীয়তঃ তাওবা করে বারবার তা ভঙ্গ করা, তাওবাকে খেলার বস্তু বানিয়ে নেয়া এবং যে গোনাহ থেকে তাওবা করা হয়েছে বার বার তা করতে থাকা তাওবা মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ ৷ কেননা, তাওবার প্রাণ সত্তা হচ্ছে, কৃত গোনাহ সম্পর্কে লজ্জিত হওয়া কিন্তু বার বার তাওবা ভঙ্গ করা প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে লজ্জার অনুভূতি নেই৷
চতুর্থতঃ যে ব্যক্তি সরল মনে তাওবা করে পুনরায় ঐ গোনাহ না করার সংকল্প করেছে মানবিক দুর্বলতার কারণে যদি পুনরায় তার দ্বারা সেই গোনাহর পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে এ ক্ষেত্রে পূর্বের গোনাহ পুনরুজ্জীবিত হবে না তবে পরবর্তী গোনাহের জন্য তার পুনরায় তাওবা করা উচিত৷
পঞ্চমতঃ যখনই গোনাহর কথা মনে পড়বে তখনই নতুন করে তাওবা করা আবশ্যক নয়৷ কিন্তু তার প্রবৃত্তি যদি পূর্বের পাপময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দ পায় তাহলে গোনাহের স্মৃতিচারণ তাকে আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে লজ্জাবোধ সৃষ্টির কারণ না হওয়া পর্যন্ত তার বার বার তাওবা করা উচিত৷ কারণ, যে ব্যক্তি সত্যিই আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে তাওবা করেছে সে অতীতে আল্লাহর নাফরমানী করেছে এই চিন্তা করে কখনো আনন্দ অনুভব করতে পারে না; তা থেকে মজা পাওয়া ও আনন্দ অনুভব করা প্রমাণ করে যে, তার মনে আল্লাহর ভয় তার মনে গভীরভাবে
শেকড় গাড়তে পারেনি৷
No comments:
Post a Comment