Thursday, May 7, 2020

নারী ও পুরুষের মধ্যে কে সেরা?


Who is superior?
In physical fights= Men
In verbal fights= Women
In dealing with crisis= Women
In dealing with money and property= Men
In rearing with children= Women
In dealing with elders= Women
In dealing with neighbours, society= Women
In dealing with work place tensions, hard tasks, late night work= Men
In dealing with people in politics= Men
Sometimes men listen to women, sometimes women listen to men= Equal
Physical attack alone= Man win over woman.
Sol they are equal. Nobody is superior over the other.



নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য? অদ্ভুত ও উদ্ভট কথা। বোঝাই যাচ্ছে যে, আমরা যখন একবিংশ শতাব্দী অতিক্রম করছি তখনো কোনো গলি-ঘুপচিতে মধ্যযুগীয় পদ্ধতিতে চিন্তা করার মতো কিছু লোক আছে যাদের মাথায় এখনো নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করার পুরনো চিন্তা বিরাজ করছে। তারা মনে করে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য আছে। তারা বোধ হয় মধ্যযুগের লোকদের মতো এ উপসংহারে উপনীত হতে চায় যে, নারী পুরুষের তুলনায় হীনতর লিঙ্গের মানুষ, নারী পূর্ণ মানুষ নয়, নারী হচ্ছে মানুষ ও পশুর মাঝামাঝি এক ধরনের জীব। নারী স্বাধীন ও মুক্ত জীবন যাপন করার উপযুক্ত নয় ও যোগ্যতা রাখে না, নারীকে অবশ্যই পুরুষের কর্তৃত্বাধীনে ও তত্ত্বাবধানে জীবন যাপন করতে হবে, অথচ বর্তমানে এ জাতীয় কথা পুরনো ও বাসি হয়ে গেছে। আজকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এসব কথা ছিল পুরুষদের তৈরি কৃত্রিম কথা; পুরুষদের আধিপত্যের যুগে তারা তাদের শক্তির বদৌলতে এসব কথা চালু করেছিল। এখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, প্রকৃত ব্যাপার এর বিপরীত। বরং নারী হচ্ছে উন্নততর লিঙ্গের মানুষ এবং পুরুষ হচ্ছে হীনতর লিঙ্গের মানুষ ও অসম্পূর্ণতার অধিকারী।
প্রকৃত ব্যাপার এরূপ নয়। এই শতাব্দীতে এবং বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উন্নতির আলোকে নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য অধিকতর সুস্পষ্ট ও অধিকতর সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এটা কোনো কাল্পনিক বা কৃত্রিম কথা নয়, বরং এ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ও পরীক্ষালব্ধ সত্য। কিন্তু এ পার্থক্য থেকে কিছুতেই এটা প্রমাণিত হয় না যে, পুরুষ বা নারী এদের মধ্যে একজন উন্নততর লিঙ্গের মানুষ এবং অপর জন হীনতর লিঙ্গের মানুষ ও অসম্পূর্ণতার অধিকারী। সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান অন্য উদ্দেশ্যে এসব পার্থক্য তৈরী করেছে। সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান এ উদ্দেশ্যে এসব পার্থক্য তৈরী করেছে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যকার পারিবারিক বন্ধনকে অধিকতর শক্তিশালী করবে এবং তাদের মধ্যকার ঐক্যের ভিত্তিকে দৃঢ়তর করবে। সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান এ উদ্দেশ্যে এসব পার্থক্য তৈরী করেছে যে, সে স্বীয় হস্তে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক অধিকার ও কর্তব্য বণ্টন করে দেবে। একই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যকার পার্থক্যের পিছনে নিহিত উদ্দেশ্যের অনুরূপ উদ্দেশ্যে সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য তৈরী করেছে। সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান যে চোখ, কান, হাত, পা ও মেরুদন্ডকে শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশে স্থাপন করেছে তার কারণ এ নয় যে, দুই চোখ অন্যান্য অঙ্গের প্রতি দৃষ্টিপাত করবে ও তাদের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করবে এবং একে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুরতার সাথে আচরণ করবে।
পরিপূরকতা, নাকি পূর্ণতা ও অসম্পূর্ণতা?
অনেকে বলতে চায় যে, নারী ও পুরুষের মধ্যকার শারীরিক ও মানসিক সম্ভাবনার ক্ষেত্রে পার্থক্য নারীকে অসম্পূর্ণতা ও পুরুষকে পূর্ণতার অধিকারী করেছে। এরা দাবি করে যে, সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান কল্যাণের লক্ষ্যেই নারীকে অসম্পূর্ণ করে সৃষ্টি করেছে।
নারীকে অসম্পূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করার ধারণাটি আমাদের এ প্রাচ্য ভূখন্ডের মানুষের মধ্যে প্রচলিত হওয়ার বহু পূর্বে পাশ্চাত্যের লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। পাশ্চাত্যের লোকেরা নারীকে কটাক্ষ করার ও অসম্পূর্ণ বলে অভিহিত করার ক্ষেত্রে খুবই বাড়াবাড়ি করেছে। ক্ষেত্র বিশেষে তারা ধর্ম ও গীর্জার ভাষায় বলেছেঃ
‘‘নারীর নারী হওয়ার কারণে লজ্জা বোধ করা উচিত।’’
কখনো বলেছেঃ ‘‘নারী হচ্ছে সেই সৃষ্টি যার চুল লম্বা ও বিচারবুদ্ধি খাটো।’’
‘‘নারী হচ্ছে সর্বশেষ বন্য প্রাণী পুরুষ যাকে পোষ মানিয়ে গৃহবাসী বানিয়েছে।’’
‘‘নারী হচ্ছে পশু ও মানুষের মধ্যবর্তী স্তরের এক প্রাণী।’’
পশ্চিমাদের মধ্যে এ ধরনের আরো অনেক কথা প্রচলিত ছিল।
এর চেয়েও অধিকতর বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, কতক পশ্চিমা সম্প্রতি একশ’ আশি ডিগ্রী বিপরীত অবস্থান নিয়ে হাজারো দলীল দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে যে, সৃষ্টিপ্রকৃতির দিক থেকে পুরুষ হচ্ছে অসম্পূর্ণ, হীন ও নীচ সৃষ্টি, আর নারী হচ্ছে পূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতর সৃষ্টি।
অ্যাসলে মন্টেগুর লিখিত ‘নারীর প্রাকৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব’ নামক বইয়ে অযৌক্তিকভাবে ও আবোল তাবোল কথায় প্রমাণ করার চেষ্ট করেছেন যে, নারী পুরুষের তুলনায় পূর্ণতর সৃষ্টি। এ বইয়ে চিকিতসা বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট যেসব তথ্য এবং সমাজ সংক্রান্ত যেসব পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে তা সত্যিই খুবই মূল্যবান, কিন্তু তিনি যখন ব্যক্তিগতভাবে এ থেকে উপসংহার টানেন তখন তিনি তাঁর সে উদ্ভট লক্ষ্যেই উপনীত হবার চেষ্টা করেন যা বইটির শিরোনাম থেকেই সুস্পষ্ট। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন পাশ্চাত্যের লোকেরা এক সময় নারীকে এভাবে হীন, নীচ, ভীরু ও তুচ্ছ হিসেবে অভিহিত করবে, আবার আরেক সময় তাদের এ অপকর্মের ক্ষতিপূরণের জন্যে নারীর ওপর থেকে তাদের চাপিয়ে দেয়া সকল দুর্বলতা ও সকল অসম্পূর্ণতাকে তুলে নিয়ে পুরুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে বাধ্য হবে? নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যকে একজনের পূর্ণত্ব ও আরেক জনের অপূর্ণত্বরূপে গণ্য করার কী প্রয়োজন রয়েছে? কী প্রয়োজন রয়েছে যে, একবার একজনের পক্ষাবলম্বন করতে হবে, আরেক বার আরেক জনের পক্ষাবলম্বন করতে হবে?
অ্যাসলে মন্টেগু একদিকে নারীকে পুরুষের তুলনায় অধিকতর উত্তম লিঙ্গের মানুষ প্রমাণের চেষ্টা করেন, অন্যদিকে পুরুষের সুবিধাজনক অবস্থাকে ঐতিহাসিক ও সামাজিক কার্যকারণের ফল হিসেবে দাবি করেন, প্রাকৃতিক কার্যকারণের ফল হিসাবে নয়।
আসল সত্য হলো, নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য তাদের পারস্পরিক পরিপূরকতার পরিচায়ক, কারো অপূর্ণতা ও কারো পূর্ণতার পরিচায়ক নয়। যেহেতু নারী ও পুরুষকে একত্রে যৌথ জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাদের যে কারোই একাকী জীবন যাপন সৃষ্টিপ্রকৃতি থেকে বিচ্যুতি বৈ নয়, সেহেতু সৃষ্টিপ্রকৃতি তাদের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে তাদেরকে পরস্পরের সাথে খাপ খাওয়াবার জন্যে অধিকতর উপযোগী করেছে। পরবর্তীতে এ পার্থক্যসমূহ সম্বন্ধে যে আলোচনা করা হবে তা থেকে এ বিষয়টি অধিকতর সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্লেটোর মত
নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য এ প্রশ্নটি আমাদের শতাব্দীতে উপস্থাপিত কোনো নতুন প্রশ্ন নয়। এ প্রশ্নটি কমপক্ষে আড়াই হাজার বছরের পুরনো। কারণ এ প্রশ্নটি প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে এভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে।
প্লেটো অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় দাবি করেছেন যে, নারী ও পুরুষ অভিন্ন সম্ভাবনার অধিকারী এবং পুরুষ যেসব দায়িত্ব পালন করে থাকে নারীর পক্ষে হুবহু সেসব দায়িত্বই পালন করা সম্ভব, তেমনি নারীর পক্ষে সেই সব অধিকার লাভ করা সম্ভব পুরুষ যার অধিকারী।
এ শতাব্দীতে নারী সম্পর্কে যে চিন্তাধারার উদ্ভব হয়েছে তার মূল প্লেটোর চিন্তাধারায় লক্ষ্য করা যায়। এমন কি বিংশ শতাব্দীর মানুষের দৃষ্টিতেও যা চরমপন্থী ও গ্রহণের অযোগ্য বলে মনে হয় তা-ও তাঁর চিন্তাধারায় পাওয়া যায়। এ কারণেই দর্শনের আদি পিতা নামে অভিহিত এ ব্যক্তি সম্বন্ধে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে। প্লেটো তাঁর ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে এমন কি যৌথ স্ত্রী ও সন্তান, বর্ণশুদ্ধি, প্রজন্মের উন্নয়ন, কতক নারী ও পুরুষকে সন্তান জন্মদান থেকে বিরত রাখা, সন্তান জন্মদান কেবল উন্নততর গুণাবলীসম্পন্ন লোকদের মধ্যে সীমিতকরণ, পরিবারের বাইরে সন্তানদের লালন-পালন, সন্তান জন্মদান সুনির্দিষ্ট বয়সের নারী ও পুরুষদের জন্যে সীমিত রাখা – যে বয়সে শরীরে শক্তি ও আবেগ-উদ্দীপনা পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকে ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন।
প্লেটো মনে করেন, পুরুষদেরকে যেভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ঠিক সেভাবেই নারীদেরকেও সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন এবং পুরুষরা যেভাবে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নারীদেরও সেভাবেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা উচিত।
প্লেটোর বক্তব্যে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমতঃ তিনি স্বীকার করেন যে, শারীরিক শক্তির দিক থেকেও এবং মানসিক শক্তির দিক থেকেও নারী পুরুষের তুলনায় দুর্বল। অর্থাত তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে ‘পরিমাণগত’ পার্থক্যের কথা স্বীকার করেন, যদিও তিনি তাদের মধ্যে মেধা-প্রতিভা ও সম্ভাবনার বিচারে গুণগত পার্থক্য স্বীকার করেন না। প্লেটো মনে করেন, নারী ও পুরুষের মধ্যে যে মেধা-প্রতিভা ও সম্ভাবনা বিদ্যমান তা পরস্পর সমান, তবে সম্ভাবনার যেকোনো বিষয়েই নারীরা পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কিন্তু এটা এমন কোন কারণ নয় যে, এ জন্যে নারী ও পুরুষের একজনের জন্যে অপর জন থেকে স্বতন্ত্র কাজ নির্ধারণ করে দিতে হবে।
যেহেতু নারী পুরুষের তুলনায় দুর্বল এ কারণে পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করায় প্লেটো ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেনঃ ‘‘আমি এ জন্য ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যে, একজন গ্রীক হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, অ-গ্রীক হয়ে নয়; স্বাধীন হিসাবে দুনিয়ায় আগমন করেছি, দাস হিসেবে নয় এবং পুরুষ হিসেবে সৃষ্ট হয়েছি, নারী হিসেবে নয়।’’
প্লেটো যে প্রজন্মের উন্নয়ন, নারী ও পুরুষের মেধা-প্রতিভার সমভাবে লালন, যৌথ স্ত্রী ও সন্তান ইত্যাদির কথা বলেছেন, এর সব কিছুই শাসক শ্রেণীর সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাত এসব হচ্ছে শাসক দার্শনিক ও দার্শনিক শাসকদের জন্যে প্রযোজ্য – রাষ্ট্রশাসনের বিষয়টিকে তিনি এককভাবে যাদের অধিকার বলে মনে করেন। আর আমরা জানি যে, রাজনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্লেটো গণতন্ত্রের বিরোধী ও অভিজাততন্ত্রের সমর্থক। ওপরে প্লেটোর যে অভিমত তুলে ধরা হয়েছে তা অভিজাত শ্রেণীর সাথে সংশ্লিষ্ট; অ-অভিজাত শ্রেণীর ব্যাপারে তিনি ভিন্ন ধরনের মতামত প্রদান করেছেন।
প্লেটো ও এরিস্টোটলঃ পরস্পরের মুখোমুখি
প্লেটোর পরবর্তী প্রাচীন দুনিয়ার যে মনীষীর অভিমত আমাদের নিকট পৌঁছেছে তিনি হলেন প্লেটোর শিষ্য এরিস্টোটল। এরিস্টোটল তাঁর ‘পলিটিক্স্’ গ্রন্থে নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য সম্বন্ধে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে নিজ শিক্ষক প্লেটোর মতামতের ঘোরতর বিরোধিতা করেছেন। এরিস্টোটল মনে করেন যে, নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য কেবল ‘পরিমাণগত’ পার্থক্য নয়; বরং গুণাবলীর দিক থেকেও তারা পরস্পর পৃথক। তিনি বলেনঃ নারী ও পুরুষের মেধা-প্রতিভার ধরন আলাদা এবং সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান তাদের জন্যে যে দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ও তাদেরকে যে অধিকার প্রদান করতে চেয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই তা পরস্পর থেকে পৃথক। এরিস্টোটলের মতে, নারী ও পুরুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও বহু ক্ষেত্রেই স্বতন্ত্র। একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস একজন পুরুষের জন্যে উত্তম গুণ হিসাবে পরিগণিত হতে পারে, কিন্তু তা একজন নারীর জন্যে উত্তম গুণরূপে পরিগণিত না-ও হতে পারে। এর বিপরীতে অন্য কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস একজন নারীর জন্যে উত্তম গুণ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে, কিন্তু তা একজন পুরুষের জন্যে উত্তম গুণ হিসেবে পরিগণিত না-ও হতে পারে।
সেই প্রাচীনকালীন দুনিয়ায়ই এরিস্টোটলের মতামত প্লেটোর মতামতকে বাতিল করে দেয়। পরবর্তীকালীন মনীষীগণ প্লেটোর মতামতের ওপর এরিস্টোটলের মতামতকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন।
আজকের দুনিয়ার মতামত
আজকের বিশ্ব নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে কী বলে? নতুন বিশ্ব কেবল ধারণা ও আন্দায-অনুমানের ওপর নির্ভর করে না, বরং পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিসংখ্যানের আশ্রয় নেয় এবং বাস্তবে গবেষণা করে। বর্তমান বিশ্বে চিকিতসা বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্ব সম্পর্কিত ব্যাপক গবেষণার ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যে এত বেশি ও এমন ব্যাপক পার্থক্য উদ্ঘাটিত হয়েছে প্রাচীন বিশ্ব যার কোনো খবরই রাখত না।
প্রাচীনকালীন বিশ্বের মানুষ নারী ও পুরুষের মধ্যে যার ভিত্তিতে পার্থক্য করত তা হচ্ছে এই যেঃ
একজনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপেক্ষাকৃত বড়, অপর জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপেক্ষাকৃত ছোট;
একজনের শরীর রুক্ষ্ম, অপর জনের শরীর মসৃণ;
একজন অপেক্ষাকৃত লম্বা, অপর জন অপেক্ষাকৃত খাটো;
একজনের কণ্ঠস্বর মোটা, আরেক জনের কণ্ঠস্বর চিকন;
একজনের শরীর লোমে পরিপূর্ণ, আরেক জনের শরীর লোমশূন্য।
কেউ যদি এর চেয়ে বেশিদূর অগ্রসর হত সে ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হবার বয়স ও যৌবনের মেয়াদ বিবেচনা করত, অথবা তাদের বিচার-বুদ্ধি ও আবেগ-অনুভূতির মধ্যকার পার্থক্যকে গুরুত্ব দিত। তারা পুরুষকে বিচার-বুদ্ধির বহিঃপ্রকাশস্থল এবং নারীকে দয়া-মায়া, ভালবাসা ও স্নেহ-মমতার প্রকাশস্থল বলে অভিহিত করত।
কিন্তু আজকের দুনিয়ায় এ ছাড়াও আরো অনেক দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে এবং এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, নারী ও পুরুষের জগত অনেক ক্ষেত্রেই আলাদা।
দ্বৈততা
শারীরিক দিক থেকেঃ গড়পড়তা অবস্থা হচ্ছে এই যেঃ
পুরুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপেক্ষাকৃত পুষ্ট ও বড় এবং নারীর শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপেক্ষাকৃত ছোট;
পুরুষ অপেক্ষাকৃত উঁচু, নারী অপেক্ষাকৃত খাটো;
পুরুষের শরীর শক্ত ও রুক্ষ্ম, নারীর শরীর মোলায়েম ও মসৃণ;
পুরুষের কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত মোটা ও কর্কশ, নারীর কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত চিকন ও মিষ্টি;
নারীর শরীরের বৃদ্ধি দ্রুততর, পুরুষের শরীরের বৃদ্ধি বেশি সময় নেয়; এমন কি বলা হয় যে, মেয়ে শিশুর ভ্রূণ পুরুষ শিশুর ভ্রূণের তুলনায় দ্রুততর বৃদ্ধি পায়।
পুরুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বৃদ্ধির পরিমাণ ও শারীরিক শক্তির পরিমাণ নারীর তুলনায় বেশি।
অনেক রোগ-ব্যাধির মোকাবিলায় নারীর প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার তুলনায় বেশি।
নারী পুরুষের তুলনায় তাড়াতাড়ি বয়ঃপ্রাপ্ত হয় এবং পুরুষের তুলনায় তাড়াতাড়ি সন্তান জন্মদান ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মেয়ে শিশু ছেলে শিশুর তুলনায় তাড়াতাড়ি কথা বলতে শেখে।
গড়ে নারীর মস্তিষ্কের তুলনায় পুরুষের মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত বড়, কিন্তু গোটা শরীরের সাথে মস্তিষ্কের অনুপাতের দৃষ্টিতে নারীর মস্তিষ্ক পুরুষের মস্তিষ্কের তুলনায় বড়।
পুরুষের ফুসফুস নারীর ফুসফুসের তুলনায় বেশি পরিমাণে বাতাস ধারণ করতে সক্ষম, অন্যদিকে নারীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া পুরুষের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়ার তুলনায় দ্রুততর।
মানসিক দিক থেকেঃ 
খেলাধুলা, শিকার এবং অধিকতর শারীরিক শক্তি ব্যবহারী ও ছুটাছুটি মূলক কাজে নারীর তুলনায় পুরুষের আগ্রহ বেশি।
পুরুষের আবেগ-অনুভূতি হচ্ছে সংগ্রামী ও জঙ্গী
নারীর আবেগ-অনুভূতি শান্তিকামী ও অতিথি পরায়ণ।
পুরুষ অধিকতর আগ্রাসী ও অধিকতর হৈচৈকারী
নারী অধিকতর শান্ত ও নম্র।
নারী অন্যদের প্রতি ও নিজের প্রতি সহিংসতার আশ্রয় নেয়া থেকে বিরত থাকে। এ কারণেই নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা পুরুষদের তুলনায় কম।
পুরুষরা আত্মহত্যার পন্থার ক্ষেত্রেও নারীদের তুলনায় রূঢ়তর। আত্মহত্যার জন্যে পুরুষ লোক বন্দুক ব্যবহার করে, ফাঁসি নেয়, উঁচু ভবনের ওপর থেকে নিচে ঝাঁপ দেয়;
আর নারী ঘুমের বড়ি, আফিম ইত্যাদির আশ্রয় নেয়। বর্তমানে অবশ্য তারা ভিন্ন আবেগে গিয়ে গলায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করে।
নারীর আবেগ-উচ্ছ্বাস পুরুষের তুলনায় অধিকতর উথলে ওঠে।
নারী পুরুষের তুলনায় দ্রুত অস্থির হয়ে পড়ে অর্থাত পসন্দনীয় বিষয়ে ও ভয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত স্বীয় আবেগানুভূতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
আবেগানুভূতির ক্ষেত্রে পুরুষ নারীর তুলনায় অধিকতর ঠান্ডা মেজাজের পরিচয় দেয়।
নারী স্বাভাবিকভাবেই সৌন্দর্যচর্চা, অলঙ্কারাদি, সাজগোজ ও বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন পসন্দ করে।
নারীর আবেগ-উচ্ছ্বাস পুরুষের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম স্থায়ী হয়।
নারী পুরুষের তুলনায় অধিকতর সতর্ক, অধিকতর ধার্মিক, বেশি কথা বলে, বেশি ভয় পায়, আনুষ্ঠানিকতার অধিকতর পক্ষপাতী।
নারীর আবেগানুভূতি মাতৃসুলভ; আর এ আবেগানুভূতি শৈশব কাল থেকেই তার মধ্যে সুপরিস্ফুট থাকে। পরিবারের প্রতি নারীর আগ্রহ পুরুষের তুলনায় বেশি এবং অবচেতনভাবেই সে পারিবারিক সংগঠনের ওপর পুরুষের তুলনায় বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।
যুক্তি প্রয়োগমূলক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং বিচার-বুদ্ধি সংশ্লিষ্ট নীরস বিষয় নারী পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে না, কিন্তু সাহিত্য, চিত্রাঙ্কন এবং আবেগানুভূতি ও মননশীলতার সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়ে সে পুরুষের তুলনায় মোটেই পিছিয়ে থাকে না।
রহস্য গোপন করে রাখা এবং নিজের ভিতরে কষ্টকর রহস্য চেপে রাখার ক্ষমতা নারীর তুলনায় পুরুষের মধ্যে বেশি; এ কারণেই পুরুষদেরকে নারীদের তুলনায় অধিক হারে দুঃখ-বেদনা চেপে রাখাজনিত রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
নারী পুরুষের তুলনায় অধিকতর আন্তরিক বন্ধুত্ব প্রবণ, আর এ কারণেই সে খুব দ্রুত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে।
পরস্পরের প্রতি অনুভূতির দিক থেকেঃ 
পুরুষ স্বীয় যৌন কামনার গোলাম, আর নারী পুরুষের প্রেমের হাতে বন্দিনী।
পুরুষ এমন নারীকে ভালবাসে যাকে সে পসন্দ করেছে ও বেছে নিয়েছে, আর নারী সেই পুরুষকে ভালবাসে যে তাকে মূল্যায়ন করেছে এবং তাকে ভালবাসার কথা বলেছে।
পুরুষ নারীটিকে নিজের আয়ত্তাধীন করতে চায়, আর নারী পুরুষের হৃদয়কে দখল করতে চায় এবং হৃদয় জয়ের মাধ্যমে তার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
পুরুষ নারীর ওপর বাহ্যিকভাবে কর্তৃত্ব চায়, আর নারী চায় পুরুষের হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে।
পুরুষ নারীকে, নারী পুরুষকে মুঠোয় আনতে চায়।
নারী পুরুষের মধ্যে সাহস ও বীরত্ব দেখতে চায়, আর পুরুষ নারীর মধ্যে সৌন্দর্য ও হৃদয়হারী বৈশিষ্ট্য দেখতে চায়।
নারী পুরুষের সহায়তাকে নিজের জন্যে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মনে করে। স্বীয় যৌন কামনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় নারীর মধ্যে বেশি।
পুরুষের যৌন কামনা উদ্যোগ গ্রহণকারী ও আগ্রাসী, আর নারীর যৌন কামনা ক্রিয়াগ্রহণকারী ও উস্কানিমূলক।
নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্যঃ প্রফেসর রিক্
খ্যাতনামা মার্কিন মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর রিক্ দীর্ঘ বহু বছর ধরে নারী ও পুরুষের অবস্থা সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালিয়েছেন এবং তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফল একটি বিরাটাকার গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। এতে তিনি নারী ও পুরুষের মধ্যে অসংখ্য পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
প্রফেসর রিক্ বলেনঃ পুরুষের জগত নারীর জগত থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নারী যদি পুরুষের মতো চিন্তা বা কাজ করতে না পারে তার কারণ এই যে, তাদের জগত পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র। তিনি বলেনঃ
তাওরাতে বলা হয়েছে, ‘‘নারী ও পুরুষ এক মাংস থেকে সৃষ্টি হয়েছে।’’ কিন্তু উভয়ই একই মাংস থেকে অস্তিত্বলাভ করা সত্ত্বেও তারা ভিন্ন ধরনের শরীরের অধিকারী এবং যৌগ উপাদানের দিক থেকে পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।
এছাড়া এ দুই সত্তার অনুভূতি কখনোই পরস্পরের অনুরূপ হবে না এবং ঘটনা ও দুর্ঘটনার মোকাবিলায় তারা কখনোই এক রকম প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে না।
নারী ও পুরুষ তাদের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের দাবি অনুযায়ী পৃথকভাবে ক্রিয়া করে এবং ঠিক দু’টি ভিন্ন অক্ষে অবস্থিত দু’টি ভিন্ন নক্ষত্রের ন্যায় পথ চলে।
তারা পরস্পরকে বুঝতে পারে এবং পরস্পরের পরিপূরক হতে সক্ষম। কিন্তু তারা কখনো এক বা অভিন্ন হয় না।
এ কারণেই নারী ও পুরুষ একত্রে জীবন যাপন করতে পারে, পরস্পরকে ভালবাসতে পারে এবং পরস্পরের চরিত্রবৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী থেকে ক্লান্ত ও অসন্তুষ্ট হয় না।
প্রফেসর রিক্ নারী ও পুরুষের মানসিকতার মধ্যে তুলনা করেছেন এবং এ তুলনায় তিনি তাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পেয়েছেন। যেমন, তিনি বলেনঃ
‘‘পুরুষ যে নারীকে ভালবাসে অনবরত সে নারীর কাছে থাকা তার জন্যে ক্লান্তিকর। কিন্তু একজন নারীর জন্যে সব সময় তার পসন্দের পুরুষের পাশে অবস্থান করার চেয়ে আনন্দজনক আর কিছুই নেই।
‘‘পুরুষের মন চায় যে, সে সব সময়ই সেই একই অবস্থায় থাকুক। কিন্তু একজন নারী প্রতিদিনই এক নতুন মানুষে পরিণত হতে চায় এবং চায় যে, প্রতিদিন প্রত্যুষেই এক নতুনতর চেহারা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠবে।
‘‘একজন পুরুষ একজন নারীর উদ্দেশে সর্বোত্তম যে বাক্যটি বলতে পারে তা হচ্ছে, ‘প্রিয়তমা! আমি তোমাকে ভালবাসি।’ আর একজন নারী তার পসন্দের পুরুষের উদ্দেশে যে সুন্দরতম বাক্যটি উচ্চারণ করতে পারে তা হচ্ছে, ‘তুমি আমার অহঙ্কার।’
‘‘একজন পুরুষ যদি তার জীবনে কয়েক জন প্রেমিকার সাহচর্য পেয়ে থাকে তাহলে অন্য নারীদের দৃষ্টিতে সে একজন আকর্ষণীয় পুরুষরূপে প্রতিভাত হয়। কিন্তু যে নারীর জীবনে একাধিক পুরুষ এসেছিল পুরুষরা তাকে অপসন্দ করে।
‘‘পুরুষরা যখন বৃদ্ধ হয় তখন নিজেদেরকে হতভাগ্য অনুভব করে, কারণ তারা তাদের নির্ভরস্থল অর্থাত কাজ হাতছাড়া করে ফেলে।
কিন্তু বৃদ্ধা নারীরা সন্তোষ ও পরিতৃপ্তি অনুভব করে। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে তারা এখন সর্বোত্তম জিনিসের অধিকারী, তা হচ্ছে একটি ঘর, ছেলে পুলে এবং কয়েক জন নাতি-নাতনী।
‘‘পুরুষের দৃষ্টিতে সৌভাগ্য হচ্ছে সমাজে সম্মানার্হ পদমর্যাদা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া। আর একজন নারীর জন্যে সৌভাগ্য হচ্ছে একজন পুরুষের হৃদয়কে দখল করা ও সারা জীবন তা রক্ষা করতে পারা।”
‘‘একজন পুরুষ সব সময়ই চায় যে, তার পসন্দের নারীকে স্বীয় ধর্মে ও জাতীয়তায় নিয়ে আসবে। অন্যদিকে একজন নারীর জন্যে বিবাহের পরে স্বীয় পারিবারিক উপাধি পরিবর্তন করা যেমন সহজ তার ভালবাসার পুরুষটির জন্যে স্বীয় ধর্ম ও জাতীয়তা পরিবর্তন করাও তেমনি সহজ।’’
সৃষ্টিপ্রকৃতির সেরা কাজ
নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য তাদের পারিবারিক অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্যেও পার্থক্য সৃষ্টি করে কিনা সে প্রশ্নে যদি না-ও যাই, তথাপি একটি বিষয় স্বীকার করতেই হবে যে, প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়টি হচ্ছে সৃষ্টিপ্রকৃতির শ্রেষ্ঠতম কাজসমূহের অন্যতম। এ হচ্ছে তাওহীদ ও স্রষ্টাতত্ত্বের পাঠ; এ বিশ্বজগতের একটি প্রজ্ঞাজাত ও সুপরিচালিত ব্যবস্থাপনা থাকার নিদর্শন; এ সত্যের সুস্পষ্ট নিদর্শন যে, সৃষ্টিপ্রকৃতির ঘটনাবলী কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঘটনাক্রমে সংঘটিত হয় নি, প্রকৃতি স্বীয় ঘটনাবলীকে অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে নেয় না। বিশ্বের ঘটনা সমূহকে যে একটি ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ থাকার মূলনীতি ছাড়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়, এ হচ্ছে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
সৃষ্টিপ্রকৃতির বিশাল যন্ত্র স্বীয় লক্ষ্যে উপনীত হওয়া ও প্রজাতিসমূহের হেফাযতের উদ্দেশ্যে প্রজন্ম উতপাদনের জন্যে এক বিশাল কারখানা তৈরী করে রেখেছে।
সৃষ্টিপ্রকৃতি তার কারখানায় অনবরত যেমন পুরুষ সৃষ্টি করছে, তেমনি নারী সৃষ্টি করছে।
যেহেতু তাদের প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য সেহেতু একই প্রজাতির দুই লিঙ্গের অধিকারীদের, বিশেষ করে দুই লিঙ্গের মানুষকে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সাহায্যে বাধ্য করার লক্ষ্যে তাদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
আর এ জন্যে এমন কাজ করা হয়েছে যে, প্রতিটি প্রাণশীল সত্তার জন্যে অপরিহার্য আত্মস্বার্থপরতা ও সুবিধা সন্ধানী মানসিকতাকে পারস্পরিক সেবা, সহযোগিতা, ক্ষমা ও আত্মত্যাগে পর্যবসিত করে দেয়া হয়েছে।
তাদেরকে পরস্পর একত্রে বসবাসে আগ্রহী করে দেয়া হয়েছে। আর পরিকল্পনাটি যাতে পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত হয় এবং তাদের উভয়ের শরীর ও উভয়ের প্রাণকে যাতে পরস্পরের সাথে অধিকতর উত্তমরূপে জুড়ে দেয়া যায় সে লক্ষ্যে তাদের উভয়ের মধ্যে বিস্ময়কর শারীরিক ও মানসিক পার্থক্য তৈরী করে দেয়া হয়েছে।
আর এই পার্থক্যই তাদেরকে পরস্পরের প্রতি অধিকতর আকৃষ্ট করে, পরস্পরকে প্রেমিক ও প্রেমিকায় পরিণত করে এবং পরস্পরকে কামনা করতে বাধ্য করে।
নারী যদি পুরুষসুলভ শরীর, মন, প্রকৃতি ও অভ্যাসের অধিকারী হত তাহলে তার পক্ষে পুরুষকে তার সেবায় বাধ্য করতে পারা এবং তার সাথে মিলিত হবার জন্যে পাগলপারা করে তোলা হত একেবারেই অসম্ভব।
অথবা পুরুষ যদি নারীর শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হত তাহলেও নারী তাকে স্বীয় জীবনের বীরপুরুষ গণ্য করবে এবং তার হৃদয়কে শিকার ও করায়ত্ত করার জন্যে স্বীয় সর্বোত্তম শিল্পকুশলতাকে ব্যবহার করবে এটাও একদমই সম্ভব হত না। বস্ত্তত পুরুষ বিশ্ববিজেতা হিসেবে ও নারী পুরুষ-বিজয়িনী হিসেবে সৃষ্ট হয়েছে।
সৃষ্টিপ্রকৃতির বিধান নারী ও পুরুষকে পরস্পরের কামনাকারী ও পরস্পরকে পসন্দকারী রূপে বানিয়েছে। কিন্তু তাদের পরস্পরকে পসন্দ করার বিষয়টি তাদের অন্যান্য বস্ত্তকে পসন্দ করার মত নয়।
মানুষ যে অন্যান্য জিনিস পসন্দ করে তার কারণ তার আত্মস্বার্থপরতা অর্থাত মানুষ বিভিন্ন জিনিসকে তার নিজের জন্যে চায়। সে ঐসব কিছুকে উপায়-উপকরণের দৃষ্টিতে দেখে এবং সেগুলোকে তার সেবা ও আরাম-আয়েশের জন্যে কাজে লাগাতে চায়।
কিন্তু নারী ও পুরুষের দাম্পত্য জীবনের প্রতি আগ্রহের বিষয়টি হচ্ছে এরূপ যে, তাদের প্রত্যেকে অপরের সৌভাগ্য ও আরাম-আয়েশ কামনা করে, তারা একে অপরের জন্যে ছাড় দিয়ে ও আত্মত্যাগ করে আনন্দ লাভ করে।
যৌন লালসা-ঊর্ধ্ববন্ধন
বড়ই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, কতক লোক যৌন লালসা ও প্রেম-ভালবাসার মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য দেখতে পায় না। তারা ধারণা করে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা বন্ধন সৃষ্টি করে তা কেবল যৌন লালসা এবং সেবা লাভ ও কাজে লাগানোর অনুভূতি।
আর এ হচ্ছে সেই অনুভূতি মানুষ যা খাদ্য, পানীয়, পরিধেয় ও যানবাহনের প্রতি পোষণ করে থাকে।
এরা জানে না যে, সৃষ্টিপ্রকৃতিতে আত্মস্বার্থপরতা ও সুবিধা সন্ধানী প্রবৃত্তি ছাড়াও অন্য ধরনের আকর্ষণও রয়েছে যে আকর্ষণ আত্মস্বার্থপরতা থেকে উতসারিত নয়, বরং অন্যের প্রতি প্রত্যক্ষ আকর্ষণ।
এ ধরনের আকর্ষণ হচ্ছে আত্মত্যাগ, ক্ষমা, নিজে কষ্ট স্বীকার করা ও অন্যের আরাম-আয়েশ কামনার উতস। এ ধরনের আকর্ষণ হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব প্রদর্শনকারী। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের আকর্ষণের অংশবিশেষ অর্থাত যতখানি জুটি ও সন্তানদের সাথে সংশ্লিষ্ট তা প্রাণিকুলের মধ্যেও দেখা যায়।
এই লোকেরা ধারণা করেছে যে, পুরুষ সব সময়ই নারীর প্রতি কেবল সেই দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আসছে ও তাকায় যে দৃষ্টিতে একজন অবিবাহিত যুবক একজন পতিতার দিকে তাকায়।
অর্থাত কেবল যৌন লালসাই তাদের দু’জনকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে। অথচ যৌন লালসার ঊর্ধ্বে এমন ধরনের বন্ধনও রয়েছে যা স্বামী-স্ত্রীর ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। আর তা হচ্ছে সেই আকর্ষণ কোরআন মজীদ যাকে ‘‘মাওয়াদ্দাত্’’ ও ‘‘রহমত্’’ বলে অভিহিত করেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেনঃ
وَ مِنْ آيَاتِهِ اَنْ خَلَقَ لَکُمْ مِنْ اَنْفُسِکُمْ اَزْوَاجًا لِتَسْکُنُوا اِلَيْهَا وَ جَعَلَ بَيْنَکُمْ مَوَدَّةً وَ رَحْمَةً. (এখানে পুরো আয়াত না লিখে দরকারী অংশটিই এসেছে)
 Wa min Aayaatiheee an khalaqa lakum min anfusikum azwaajal litaskunooo ilaihaa wa ja'ala bainakum mawad datanw wa rahmah; inna fee zaalika la Aayaatil liqawminy yatafakkaroon (পুরো আয়াত)
‘‘আর তাঁর নিদর্শনসমূহের অন্যতম এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই জুটি বানিয়ে দিয়েছেন যাতে তোমরা তার কাছে গিয়ে স্বস্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও মেহেরবানি (ভালোবাসা সহানুভূতি) তৈরী করে দিয়েছেন।’’
এটা কত বড় ভুল ও অন্যায় যে, নারী ও পুরুষের সম্পর্ককে কেবল সেবা আদায়, শোষণ ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে পারস্পরিক বিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হবে! এ ব্যাপারে অনেক উদ্ভট কথা তৈরী করা হয়েছে! অনেক লেখায় দেখা যায় যে, নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাসকে কেবল একটি নীতির ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা হচ্ছে বিরোধের নীতি- যাতে নারী ও পুরুষকে এমন দু’টি সামাজিক শ্রেণীর মতো গণ্য করা হয়েছে যারা অনবরত যুদ্ধ ও সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। বস্ত্তত পিতা ও সন্তানদের সম্পর্কের ইতিহাসকে যদি সেবা গ্রহণ ও শোষণের অনুভূতির দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় তাহলে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কের ইতিহাসকেও এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সন্দেহ নেই যে, পুরুষ সব সময়ই নারীর তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী ছিল, কিন্তু সৃষ্টিপ্রকৃতির আইন সহজাত প্রবণতার দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষকে এমন এক অবস্থায় নিয়ে রেখেছে যে, সে তার দাসদের, চাকর-বাকরের ও অধীনস্থদের প্রতি এবং পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রতি যে ধরনের যুলুম-নির্যাতন করেছে, নারীর প্রতি তা করতে পারে নি, ঠিক যেভাবে স্বীয় সন্তানদের প্রতি সে ধরনের যুলুম-নির্যাতন করতে পারে নি।
নারীর ওপরে পুরুষের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করা যায় না। বরং এ নির্যাতন সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তা ও অস্বীকার করা যায়। মানব জাতির ইতিহাসে পুরুষ নারীর ওপর অনেক নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু এ নির্যাতনের মূল হচ্ছে তা-ই যে কারণে স্বীয় সন্তানের প্রতি ভালবাসা ও তাদের সৌভাগ্যের ঐকান্তিক কামনা সত্ত্বেও তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। এর পিছনে সেই একই কারণ নিহিত থাকে যে কারণে ব্যক্তি নিজের ওপরও নির্যাতন চালায়। অর্থাত এর মূল হচ্ছে অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও অভ্যাস, সুবিধা সন্ধানী মানসিকতা নয়।
নারী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি অনুভূতির দ্বৈততা
অন্যান্য জিনিসের প্রতি মানুষের যে মনের টান তা থেকে পারিবারিক জীবনের প্রতি নারী ও পুরুষের টান তথা পরস্পরের প্রতি তাদের আকর্ষণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। শুধু তা-ই নয়, তাদের একজনের প্রতি অপর জনের যে মনের টান তা-ও এক ধরনের নয়। অর্থাত নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ ও পুরুষের প্রতি নারীর আকর্ষণ ভিন্ন ধরনের। যদিও তাদের মধ্যকার আকর্ষণ হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক আকর্ষণ, তবে প্রাণহীন বস্ত্তর বিপরীতে এ ক্ষেত্রে ছোটটি বড়টিকে আকর্ষণ করে ও নিজের দিকে টেনে নেয়। সৃষ্টিপ্রকৃতি পুরুষকে যাচ্ঞা, প্রেম ও চাওয়ার বহিঃপ্রকাশস্থল রূপে এবং নারীকে প্রিয়া ও প্রেমাস্পদ হওয়ার বহিঃপ্রকাশস্থলরূপে বানিয়েছে। পুরুষের অনুভূতি অভাব ও প্রয়োজনের অনুভূতি এবং নারীর অনুভূতি আত্মগৌরবের অনুভূতি। পুরুষের অনুভূতি যাচ্ঞাকারীর অনুভূতি, আর নারীর অনুভূতি বাঞ্ছিতার অনুভূতি।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ আত্মহত্যাকারী একজন রাশিয়ান যুবতীর সচিত্র সংবাদ: যুবতীটি আত্মহত্যার আগে লিখে রেখে গিয়েছিলঃ ‘‘এখন পর্যন্ত কোন পুরুষ আমাকে চুম্বন করে নি, তাই আমার পক্ষে আর এ জীবন সহনীয় নয়।’’
এটা একজন যুবতীর জন্যে এদিক থেকে এক বিরাট পরাজয় যে, সে কোনো পুরুষের প্রিয়া হতে পারে নি। কিন্তু একজন যুবক কখন তার জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে যায়? কোনো যুবতী তাকে চুম্বন না করলে কি সে জীবন সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে? না, বরং সে যখন কোনো যুবতীকে চুম্বন করতে পারে না তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে।
উইল ডুর‌্যান্ট এ বিষয়ে বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, নারী যদি কেবল জ্ঞানগত ও চৈন্তিক অগ্রসরতার অধিকারী হয়, কিন্তু চিত্তাকর্ষক প্রকৃতি ও অবচেতন চাতুর্যের অধিকারী না হয় তাহলে সে স্বামীর অধিকারী হবার ক্ষেত্রে খুব একটা সফল হবে না। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৬০ ভাগ মহিলাকেই স্বামীবিহীন থাকতে দেখা যায়।
এরপর তিনি বলেনঃ ‘‘শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী মিস কোভালেভস্কি অভিযোগ করেন যে, কেউ তাকে বিয়ে করছে না। তিনি বলেনঃ ‘কেন কেউ আমাকে ভালবাসে না? আমি অনেক নারীর চেয়েই অধিকতর উত্তম, তা সত্ত্বেও অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ নারীকে ভালবাসা ও পসন্দ করা হচ্ছে, কিন্তু আমাকে নয়।’ লক্ষ্য করুন, এ মহিলার পরাজয়ের অনুভূতি এজন পুরুষের পরাজয়ের অনুভূতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; তিনি বলছেনঃ কেন আমাকে কেউ ভালবাসছে না?’’
পুরুষ কেবল তখনই পরাজয় অনুভব করে যখন সে তার পসন্দের উপযোগী কোনো নারীকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়, অথবা খুঁজে পেলেও তাকে নিজের জন্যে পেতে ব্যর্থ হয়।
এ সব কিছুর পিছনেই একটিমাত্র দর্শন নিহিত রয়েছে। তা হচ্ছে সুদৃঢ়তর বন্ধন ও ঐক্য। এ বন্ধন কী জন্য? এর উদ্দেশ্য কি শুধু এই যে, নারী ও পুরুষ যেন জীবন থেকে অধিকতর আনন্দ লাভ করতে পারে? না, শুধু এটাই নয়, বরং মানবিক সমাজের ভিত্তি এবং ভবিষ্যত প্রজন্মসমূহের প্রশিক্ষণের ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ক্লিওডলসন্ নামের একজন মনোবিজ্ঞানী মহিলার অভিমত
তিনি বলেনঃ ‘‘একজন মহিলা মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমার সবচেয়ে বেশি পসন্দের বিষয় হচ্ছে পুরুষের মন-মানসিকতা সম্পর্কে গবেষণা। কিছুদিন আগে আমাকে নারী ও পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক উপাদানসমূহ সম্বন্ধে গবেষণা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি আমার গবেষণা থেকে এ উপসংহারে উপনীত হইঃ
১) সকল নারীই অন্য ব্যক্তির তদারকিতে কাজ করা পসন্দ করে। মোদ্দাকথা, তারা পরিচালিত হওয়া এবং পরিচালকের অধীনে কাজ করা পসন্দ করে।
২) সমস্ত নারীই এটা অনুভব করতে চায় যে, তাদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয়।’’
এরপর তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেনঃ
‘‘আমার মতে, নারীর এ দুই মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজন এ বাস্তবতা থেকে উতসারিত যে, নারীরা আবেগের অনুসারী ও পুরুষরা বিচারবুদ্ধির অনুসারী। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, নারীরা সচেতনতার দিক থেকে শুধু যে পুরুষদের সমপর্যায়ের তা নয়, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর। কিন্তু নারীর দুর্বল দিক হচ্ছে শুধু তাদের তীব্র ভাবাবেগ। পুরুষরা সব সময়ই অধিকতর বাস্তবমুখী চিন্তা করে, অধিকতর উত্তম ফয়সালা করে, সংগঠিত করার কাজে তারা অধিকতর উত্তম, অধিকতর উত্তমরূপে পথনির্দেশ প্রদান করে। অতএব নারীদের তুলনায় পুরুষদের মানসিক শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে এমন বিষয় স্বয়ং প্রকৃতিই যার পরিকল্পনাকারী। নারীরা এ বাস্তবতার সাথে যতই সংগ্রাম করতে চাক না কেন তা নিস্ফল হতে বাধ্য। নারীরা যেহেতু পুরুষদের তুলনায় অধিকতর আবেগপ্রবণ সেহেতু তাদেরকে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, তাদের জীবনে তারা পুরুষের তত্ত্বাবধানের মুখাপেক্ষী। … নারীদের জীবনের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হচ্ছে ‘নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা’। তারা যখন তাদের লক্ষ্যে উপনীত হয় অতঃপর আর তারা কিছু করতে চায় না। নারী তার এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে ঝুঁকি গ্রহণ করতে ভয় পায়। ভীতি হচ্ছে নারীর একমাত্র অনুভূতি যা দূর করার জন্যে তার সাহায্যের প্রয়োজন। যেসব কাজে অনবরত চিন্তা করার প্রয়োজন হয় তা নারীকে ক্লান্ত-শ্রান্ত ও অসুস্থ করে ফেলে।’’
উইল ডুর‌্যান্টের মত
 উইল ডুর‌্যান্ট তাঁর লেখা The Pleasures of Philosophy নামক গ্রন্থের চতুর্থ খন্ডে লৈঙ্গিক ও পারিবারিক বিষয়াদি সম্বন্ধে অত্যন্ত ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করেছেন।
উইল ডুর‌্যান্ট ‘প্রেম’ শিরোনামে বলেনঃ ‘‘প্রেমের সর্বপ্রথম সুস্পষ্ট সঙ্গীত বয়ঃপ্রাপ্ত হবার সাথে সাথেই শুরু হয়। ইংরেজী ভাষায় ‘পিউবার্টি’ (puberty) শব্দটি বয়ঃপ্রাপ্তি বা বয়ঃসন্ধিক্ষণ অর্থে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ল্যাটিন ভাষার এ শব্দটির মূল তাতপর্য বিবেচনা করলে শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘লোমের বয়স’ অর্থাত যে বয়সে ছেলেদের শরীরে লোম গজায়, বিশেষ করে বুকের লোম – ছেলেরা যা নিয়ে গর্ব করে এবং চেহারার পশম যা তারা কামিয়ে ফেলে। পশমের ধরন ও পরিমাণ (অন্যান্য বিষয় সমরূপ হলে) দৃশ্যত সন্তান জন্মদান ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত, আর এ সর্বোত্তম অবস্থা হচ্ছে জীবনের আনন্দের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়ার সময়। এভাবে আকস্মিকভাবে পশম গজানোর ও এর সাথে কণ্ঠস্বরের কর্কশতা হচ্ছে লৈঙ্গিকতার দ্বিতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্য যা বয়ঃপ্রাপ্তির সময় ছেলেদের মধ্যে প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রকৃতি এ বয়সে মেয়েদেরকে শরীরের বিভিন্ন অংশে নম্রতা ও চলাফেরায় শ্লথ অবস্থা প্রদান করে যা তাদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। এছাড়া তাদের নিতম্ব প্রশস্ততর হয় যার ফলে তাদের জন্য মাতৃত্ব সহজতর হয়ে ওঠে এবং তাদের বক্ষ সন্তানকে দুধ দেয়ার জন্যে পূর্ণ ও উঁচু হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে এ দ্বিতীয় স্তরের বৈশিষ্ট্যের প্রকাশের কারণ কী? কেউ জানে না। তবে এ ব্যাপারে প্রফেসর স্টারলিং-এর মতামতকে ইতোমধ্যে অনেকেই সমর্থন করেছেন। তাঁর মতে, সন্তান জন্মদানকারী কোষসমূহ বয়ঃপ্রাপ্তি কালে কেবল ডিম্ব ও বীর্যই তৈরী করে না, বরং একই সাথে এক ধরনের হরমোনও তৈরী করে যা রক্তের সাথে মিশে যায় এবং শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটানোর কারণ হয়ে থাকে। এ বয়সে কেবল যে শরীরই নতুন নতুন শক্তির অধিকারী হয় তা নয়, বরং মন ও অভ্যাসেও হাজারো ধরনের প্রভাব বিস্তার লাভ করে। রোমাঁ রোলাঁ বলেনঃ ‘‘মানুষের জীবনে এমন একটা সময় এসে উপস্থিত হয় যখন একজন পুরুষের সত্তায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয় এবং একজন নারীর সত্তায়, এসব পরিবর্তনের মধ্যে তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সাহস ও শক্তি নম্র হৃদয়গুলোকে আন্দোলিত করে এবং নম্রতা ও মসৃণতা শক্তিমানদের মধ্যে আগ্রহ ও লালসা জাগিয়ে দেয়।’’ দ্য মুসে বলেনঃ ‘‘সকল পুরুষই মিথ্যাবাদী, প্রতারক, গপ্পবাজ, দুমুখো ও জঙ্গীবাজ এবং সকল নারীই আত্মম্ভরী, বাহ্যিক প্রদর্শনকারিণী ও বিশ্বাসঘাতিনী। কিন্তু এ বিশ্বে কেবল একটি বিষয় আছে যা পবিত্র ও সমুন্নত, তা হচ্ছে এই দুই অসম্পূর্ণ সত্তার মিলন।’’
‘‘বয়ঃপ্রাপ্তদের মধ্যে জোড়া বাঁধার প্রচেষ্টার নিয়ম হচ্ছে পুরুষদের পক্ষ থেকে আয়ত্তাধীন করার জন্যে হামলা চালানো এবং নারীদের পক্ষ থেকে হৃদয় হরণ ও প্রতারণার লক্ষ্যে পিছু হটা (অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়) । যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে পুরুষ হচ্ছে যুদ্ধবাজ ও পশুশিকারী সেহেতু তার কাজ ইতিবাচক ও আক্রমণাত্মক। নারী তার নিকট এমন একটি পুরস্কার স্বরূপ যাকে পেতে হবে ও যার মালিক হতে হবে। জোড়া বাঁধার প্রচেষ্টা হচ্ছে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব স্বরূপ এবং বিবাহ মালিকানা হাসিল ও কর্তৃত্বলাভস্বরূপ।
‘‘নারীর সতীত্ব তার সন্তান জন্মদানের লক্ষ্যের সেবায় নিয়োজিত। কারণ নিজেকে আড়াল বা আবৃত করে রাখার কায়দায় সে যে নিজেকে বিরত রাখে তা তাকে বিপরীত লিঙ্গের সাথী বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। সতীত্ব নারীকে তার প্রেমিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে অর্থাত কাকে সে তার সন্তানদের পিতৃত্বের গৌরব প্রদান করবে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকতর সক্ষম করে তোলে। সমষ্টির ও মানব জাতির স্বার্থ নারীর মুখে কথা বলে, ঠিক যেভাবে ব্যক্তির স্বার্থ পুরুষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে। বস্ত্তত প্রেমের খেলায় নারী পুরুষের তুলনায় অধিকতর সুদক্ষ। কারণ, তার আগ্রহ এতটা তীব্র নয় যে, তার বিচারবুদ্ধির চোখকে বন্ধ করে দেবে।
‘‘ডারউইন লক্ষ্য করেছেন যে, বেশিরভাগ প্রজাতির ক্ষেত্রেই স্ত্রী প্রজাতি প্রেমের জগতের প্রতি অনাগ্রহী। লোম্বোরোযো, কীশ্ ও ক্রাফ্ট্ এবিঙ্গ্ এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, নারীরা প্রধানতঃ পুরুষদের উচ্ছ্বসিত ও অর্থহীন প্রশংসা পসন্দ করে এবং তারা প্রধানতঃ চায় যে, পুরুষরা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়ার দিকে দৃষ্টি প্রদান করুক। আর এতে তারা যৌন আনন্দ ভোগের চাইতেও বেশি আগ্রহী। লোম্বোরোযো বলেনঃ নারীর প্রেমের প্রাকৃতিক ভিত্তি হচ্ছে কেবল একটিমাত্র দ্বিতীয় স্তরের গুণবৈশিষ্ট্য, তা হচ্ছে মাতৃত্ব। নারীর যেসব আবেগ-অনুভূতি ও স্নেহ-মমতা নারীকে পুরুষের সাথে যুক্ত করে তা শরীরের চাহিদা থেকে উতসারিত নয়, বরং তা বন্দিনী হওয়া ও আত্মসমর্পণের সহজাত প্রবণতা (অর্থাত পুরুষের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা লাভের প্রবণতা) থেকে উতসারিত হয়। আর পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এ প্রবণতা অস্তিত্ব লাভ করেছে।’’
উইল ডুর‌্যান্ট তাঁর গ্রন্থের ‘পুরুষ ও নারী’ শিরোনামের অধ্যায়ে বলেনঃ
‘‘নারীর একান্ত কাজ হচ্ছে প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্যে সেবা দান এবং পুরুষের একান্ত কাজ হচ্ছে নারী ও শিশুর খেদমত করা। তাদের হয়তো আরো কাজ থাকতে পারে, কিন্তু প্রজ্ঞা ও সুপরিচালনা অন্য সমস্ত কাজকেই এ দুই মৌলিক কাজের অধীন করে দিয়েছে। এ লক্ষ্যসমূহ হচ্ছে মৌলিক লক্ষ্য, তবে তা অর্ধসচেতনভাবে এবং মানুষের তাতপর্য ও সৌভাগ্যের প্রকৃতি এতেই নিহিত রয়েছে। … নারীর প্রকৃতি প্রধানত: আশ্রয় সন্ধানী। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, কতক স্ত্রী প্রজাতির মধ্যে যুদ্ধবাজ প্রবণতার আদৌ অস্তিত্ব নেই; স্ত্রী প্রজাতি যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তো কেবল তার শিশু সন্তানদের জন্যে।
‘‘নারী পুরুষের তুলনায় অধিকতর ধৈর্যশীলা। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ও জীবনের সঙ্কটময় মুহূর্তে পুরুষের মধ্যে সাহসিকতা বেশি দেখা যায়, কিন্তু সীমাহীন ছোটখাট কষ্টের মোকাবিলায় সব সময়ের জন্যে ও প্রতিদিন যে সহনশক্তির প্রয়োজন তা নারীর মধ্যেই বেশি। নারী অন্যের মধ্যে যোদ্ধাভাব সন্ধান করে; নারী যোদ্ধাদেরকে পসন্দ করে এবং শক্তিমান পুরুষদেরকে তার ভাল লাগে। শক্তি দর্শনে তার মধ্যে বিস্ময়করভাবে আনুগত্যের ভাবের উদ্রেক হয়, যদিও হতে পারে যে, সে নিজেই এ শক্তির শিকার হয়।”
‘‘সুপ্রাচীনকাল থেকেই শক্তি ও পৌরুষে নারীর আনন্দিত হওয়া অনেক সময় নতুন যুগের নারীর অর্থনৈতিক অনুভূতিকেও পরাভূত করে। তাই ক্ষেত্র বিশেষে একজন নারী একজন উন্মাদ বীর পুরুষকে বিবাহ করার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। যে পুরুষ অধিনায়কত্ব করতে পারে নারী তার কাছে খুব সহজেই আত্মসমর্পণ করে। বর্তমান যুগে যে নারীর মধ্যে আদেশ পালনের মানসিকতা অপেক্ষাকৃত কম লক্ষ্য করা যায় তার কারণ এই যে, এ যুগের পুরুষরা শক্তি ও চরিত্রের দিক থেকে পূর্ববর্তী যুগের পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়েছে। নারীর মনোযোগ হচ্ছে পারিবারিক বিষয়াদির প্রতি। তার পরিবেশ সাধারণত: তার নিজের ঘর। সে প্রকৃতির মতোই সুগভীর। সে তার সীমিত আয়তনের গৃহের ন্যায় নিজেও সীমাবদ্ধ। সহজাত প্রবণতা তাকে সুপ্রাচীন রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত করে। নারী না মনের দিক থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পক্ষপাতী, না অভ্যাসগত দিক থেকে। (বড় বড় শহরের বাসিন্দা কতক নারীকে এর ব্যতিক্রম গণ্য করতে হবে।) নারী যদি স্বাধীন প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়ে তো তার কারণ হচ্ছে এই যে, সে এর মাধ্যমে স্বাধীনতার সন্ধান করছে। বরং এর পিছনে কারণ এই যে, সে তার জীবনে একজন দায়িত্বশীল লোকের সাথে  সাধারণ ও প্রথাগত বিবাহের কারণে হতাশ হয়ে পড়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে নারী যদি যৌবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিভাষা ও শ্লোগান দ্বারা অভিভূত হয়ে থাকে এবং নিজেকে একজন সর্বমুখী মানুষ বলে অনুভব করেও থাকে, তথাপি একজন নিষ্ঠাবান স্বামী লাভ করার পর ঐসব ততপরতা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। সে খুব শীঘ্রই নিজেকে ও তার স্বামীকে এসব সার্বজনীন ততপরতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং স্বামীকে এ কথাই শিক্ষা দেয় যে, সে তার তীব্র নিষ্ঠার অনুভূতিকে পুরোপুরি গৃহের মধ্যে সীমাবদ্ধ করুক। কোনরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই নারী জানে যে, সংস্কার কেবল গৃহকোণ থেকেই উতসারিত হয়ে থাকে। নারী যে কারণে একজন কল্পনা বিলাসী ও ঘুরে বেড়াতে অভ্যস্ত পুরুষকে স্বীয় গৃহ ও সন্তানের প্রতি নিষ্ঠাবান পুরুষে পরিণত করে তা হচ্ছে প্রজাতিকে হেফাযত ও টিকিয়ে রাখা। প্রকৃতি আইন-কানুন ও সরকারকে মোটেই গুরুত্ব দেয় নি। প্রকৃতির প্রেম গৃহ ও শিশুদের প্রতি; এদের হেফাযতে যদি সে সফল হয় তাহলে সরকারের প্রতি তার কোন আগ্রহ থাকে না এবং যারা এসব মৌলিক আইন পরিবর্তনের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের উদ্দেশে সে হাসে। আজকে যদি প্রকৃতি পরিবার ও শিশুদের হেফাযতে অক্ষম বলে প্রতিভাত হয়ে থাকে তার কারণ হচ্ছে এই যে, কিছুদিন হলো নারী স্বীয় প্রকৃতিকে ভুলে গেছে। কিন্তু প্রকৃতির পরাজয় সব সময়ের ব্যাপার নয়। প্রকৃতি যখনই চাইবে তার ভান্ডারে মওজূদ শত শত কল্যাণের দিকে ফিরে আসবে। এমন অনেক জাতি ও জনগোষ্ঠী আছে বিস্তার ও সংখ্যার দিক থেকে তারা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি এবং প্রকৃতি স্বীয় নিশ্চিত ও অনির্ধারিত স্থায়িত্বের বিষয়টিকে তাদের মধ্য থেকে পূরণ করে নেবে।’’
সূত্রঃ আয়াতুল্লাহ মুর্তাযা মোতাহ্হারী, ইরান কালচারাল সেন্টার
  1. Ashley Montagu
  2. The Natural Superiority of Women
  3. Al quran সূরাহ্ আর্-রূম্ঃ ২১
  4. Sonia Kovalevsky
  5. The Pleasures of Philosophy, p. 136.
  6. Professor Starling
  7. Romain Rolland
  8. De Musset
  9. Lomboroso
  10. Kisch
  11. Kraft Ebing

No comments:

Post a Comment