Thursday, May 28, 2020

আশা

জীবনে চলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে আশা মানুষকে সঞ্জীবিত করে। আশা আছে বলেই মানুষ তার সম্ভানার দুয়ারগুলো উন্মুক্ত রাখতে পারে, ভবিষ্যতকে না জেনেও সেই পথেই অগ্রসর হয়, বর্তমানকে সাদরে গ্রহণ করে। আশা যেন এক সুদক্ষ বাজিকর। সংসারচক্রে আশাই মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা। জীবনের ভেতরে আশাকে একটি ‘সংকেত’ হিসেবে না নিলে মানুষ নোতুন করে কিছু শুরু করতে পারে না। সে সংকেত কখনো স্বচ্ছ আবার কখনো অস্বচ্ছ বা নির্দয়ভাবে জীবনে ধরা দেয়। আশা না থাকলে বিভিন্ন অভিযোগ মাথা চাড়া দেয় এমনকি চরম হতাশা চলে আসে। আশার স্বচ্ছতা আর নির্দয়তা এক স্রোতে মিলিত না হলে মানুষের মধ্যে বিভ্রম চলে আসে।
জীবনান্দের আশাটা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম, অস্বচ্ছও বলা যায়। তার লেখায় পাওয়া যায়:
‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না; আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে, পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।’
আবার হুমায়ুন আজাদ বাঙালীর আশাকে যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। তার লেখায় এসেছেঃ
‘বাঙালিকে একটি একাডেমি দাও, বাঙালি সেটিকে গোয়ালে পরিণত করবে।’
শেক্সপিয়রের কথায় হতাশার সকরুন সূর নেই। তার লেখায় এসেছেঃ
‘আমি সবসময় নিজেক সুখী ভাবি, কারণ আমি কখনো কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না, কারো কাছে কিছু প্রত্যাশা করাটা সবসময়ই দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
আবার ওই একই মানুষ ভিন্ন মাত্রায় অস্বচ্ছভাবে বলেনঃ
‘প্রত্যাশাই সকল মর্মবেদনার কেন্দ্র বিন্দু।’
জর্জ বার্নার্ড শ’ আশা নিয়ে নির্দয়ভাবে বলেছেন। তার লেখায় পাওয়া গেছেঃ
‘জীবনে দুটি দুঃখ আছে। একটি হল তোমার ইচ্ছা অপুর্ণ থাকা, অন্যটি হল ইচ্ছা পুর্ণ হলে আরেকটির প্রত্যাশা করা।’
আর নজরুল? তিনি তো আশা আর নিরাশাকে এক কড়াইয়ে ভেজেছেন:
‘বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেয়ো না তাহার কাছে
নড়াচড়া করে, তবুও সে মরা, জ্যান্তে সে মরিয়াছে।
শয়তান তারে শেষ করিয়াছে, ইমান লয়েছে কেড়ে,
পরাণ গিয়াছে মৃত্যুপুরীতে ভয়ে তার দেহ ছেড়ে।
থাকুক অভাব দারিদ্র্য ঋণ রোগ শোক লাঞ্ছনা,
যুদ্ধ না ক’রে তাহাদের সাথে নিরাশায় মরিও না।’
আমি বলি শোনো মানুষ! পূর্ণ হওয়ার সাধনা করো,
দেখিবে তাহারি প্রতাপে বিশ্ব কাঁপিতেছে থরোথরো!
ইহা আল্লার বাণী যে, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়,
এই মানুষের হাত পা চক্ষু আল্লার হয়ে যায়!
চাওয়া যদি হয় বৃহত, বৃহত সাধনাও তার হয়,
তাহারি দুয়ারে প্রতীক্ষা করে নিত্য সর্বজয়।
অধৈর্য নাহি আসে কোনো মহাবিপদে সে সেনানীর,
অটল শান্ত সমাহিত সেই অগ্রনায়ক বীর।
নিরানন্দের মাঝে আল্লার আনন্দ সেই আনে,
চাঁদের মতন তার প্রেম জনগণ-সমুদ্রে টানে।
কিন্তু আমার কাছে পুরোনা কবিতাটাই সেরা এবং এখনোঃ
ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়ায়
অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।
দাঁড়াইত স্থিরভাবে, চলিত না হায়
মন্ত্রবলে তুমি চক্র না ঘুরাতে যদি।
ভবিষ্যত অন্ধ, মূঢ় মানবসকল
ঘুরিতেছে কর্মক্ষেত্রে বর্তুল-আকার,
তব ইন্দ্রজালে মুগ্ধ, পেয়ে তব বল।
বুঝিছে জীবনযুদ্ধে হায় অনির্বার
নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে
নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে।

No comments:

Post a Comment