Sunday, May 24, 2020

জালিম কারা? কুরআন ভিত্তিক একটি বিশ্লেষন

১.
জালিম শব্দটি আরবি। ‘আজ-জুল্ম’ শব্দমূল থেকে উদ্গত। যার আভিধানিক অর্থ ‘অত্যাচার করা, উতপীড়ন করা, নিপীড়ন করা, নির্যাতন করা, দুর্ব্যবহার করা।’ ব্যাখ্যা: যেসব মানুষ কারো প্রতি অত্যাচার, উতপীড়ন, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার করে তাদেরকে জালিম এবং যাদের প্রতি জুল্ম করা হয় তাদেরকে মাজলুম বলে।
‘আজ-জুল্ম’ শব্দটি ক্রিয়াবাচক, জালিম শব্দটি কর্তৃবাচক এবং মাজলুম শব্দটি কর্মবাচক।
১. জালিম হলো আত্ম-অবিচারকারী বা নিজের প্রতি জুলুমকারী। কুরআন মাজিদের একটি উদাহরণ, সুলায়মান আ:-এর দরবারে উপস্থিত রানী বিলকিসকে বলা হলো, এ প্রাসাদে প্রবেশ করো। যখন সে তাতে প্রবেশ করতে অগ্রসর হলো তখন সে দেখল, যেন এক গভীর জলাশয় এবং সে তার পদদ্বয় অনাবৃত করতে থাকল। এ সময় তাকে হজরত সুলায়মান আ: বললেন, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিকমণ্ডিত প্রাসাদ মাত্র। তখন সে নারী বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমি তো আত্ম-অবিচার বা নিজের প্রতি জুলুম করতে চলছিলাম। (অর্থাত প্রাসাদের মেঝে স্বচ্ছ কাঁচমণ্ডিত ছিল। দেখতে পানি বলে ভুল হতো। সে কারণে রানী বিলকিস কাপড় গুটিয়ে নিচ্ছিল।) আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম’ (সূরা নামল: ৪৪)।
২. জালিম সে তো নিজের খেয়ালখুশির অনুসরণকারী। এ অর্থে কুরআন মাজিদের একটি আয়াত, ‘যদি আপনি আহলে কিতাবদের কাছে সমুদয় নিদর্শন উপস্থাপন করেন, তবুও তারা আপনার কিবলা মেনে নেবে না এবং আপনিও তাদের কিবলা মানেন না। আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও যদি আপনি তাদের নিজেদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করেন তাহলে নিশ্চয়ই আপনি সেসব জালিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন’ (সূরা বাকারা: ১৪৫)।
৩. জালিম হলো আল্লাহ তায়ালার সাথে অংশীদার স্থাপনকারী। ‘স্মরণ করো, যখন লুকমান উপদেশছলে স্বীয় পুত্রকে বলেছিলেন, হে আমার ছেলে! আল্লাহর সাথে কোনো শরীক করো না। নিশ্চয়ই শির্ক অতি বড় ধরনের জুলুমই বটে’ (সূরা লুকমান: ১৩)।
৪. জালিম হলো আল্লাহ তায়ালার বিধানের বিপরীত বিচার-ফয়সালাকারী।  ‘আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমের বিনিময়ে সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তদনুযায়ী যারা বিচার-ফায়সালা করে না তারাই জালিম’ (সূরা মায়িদা: ৪৫)।
৫. জালিম হলো, যারা সাক্ষ্য গোপনকারী তথা প্রত্যক্ষ বা চাক্ষুস বিষয়কে উল্টিয়ে ফেলে মিথ্যার ব্যবসা করে। ‘অথবা তোমরা কি বলছ যে, নিশ্চয়ই ইবরাহিম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব আ: ও তাদের সন্তানগণ ইহুদি অথবা খ্রিষ্টান ছিলেন? আপনি বলে দিন, তোমরা বেশি জানো, না আল্লাহ বেশি জানেন? যে ব্যক্তি সাক্ষ্য গোপন করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে হতে পারে?’ (সূরা বাকারা: ১৪০)।
৬. জালিম হলো, আল্লাহ তায়ালার আদেশ অমান্যকারী।
‘এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাকো এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাকো, কিন্তু তোমরা কখনোই এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। তাহলে তোমরা জালিমদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (সূরা বাকারা: ৩৫)।  আল্লাহ বলেন, ‘তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা তো আমাদের নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেলেছি। এখন তুমি যদি আমাদেরকে ক্ষমা এবং অনুগ্রহ না করো তাহলে তো আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো’ (সূরা আরাফ: ২৩)। হজরত আদম আ: শয়তানের কুমন্ত্রণায় ওই আদেশটি লঙ্ঘন করে জালিম সাব্যস্ত হয়েছিলেন। এ কথা তাঁর বক্তব্যই প্রমাণ করে।

৭. জালিম হলো, উপহাসকারী, কাউকে অন্যায়ভাবে দোষারোপকারী এবং অন্যকে মন্দনামে আহ্বানকারী। ‘হে মুমিনগণ! কোনো পুরুষের অপর কোনো পুরুষকে উপহাস করা উচিত নয়। কেননা যাকে উপহাস করা হলো সে তাদের থেকে উত্তমও হতে পারে এবং কোনো নারীর অপর কোনো নারীকেও উপহাস করা উচিত নয়। কেননা যাকে উপহাস করা হলো, সে উপহাসকারিণী থেকে উত্তমও হতে পারে। তোমরা তোমাদের একে অপরের প্রতি দোষারোপ করবে না এবং তোমাদের কাউকে মন্দ নামে ডাকবে না। ঈমান গ্রহণের পর মন্দ নামে ডাকা বড় পাপের কাজ। যারা এর থেকে ফিরে থাকবে না, তারাই তো জালিম’ (সূরা হুজরাত: ১১)।

৮. জালিম হলো, আল্লাহ তায়ালার প্রতি মিথ্যা আরোপকারী অথবা তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কুরআন মাজিদকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। ‘তার থেকেও বড় জালিম আর কে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যাচার করে অথবা সত্য তার সামনে এসে যাওয়া সত্ত্বেও তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে? জাহান্নামই কি এ ধরনের কাফিরদের অবাসস্থল নয়?’ (সূরা আনকাবুত: ৬৮)।

৯. জালিম হলো, আল্লাহ তায়ালার ঘরে তারই নাম স্মরণে বাধা দানকারী এবং তা ধ্বংস সাধনে প্রচেষ্টাকারী। ‘তার থেকেও বড় জালিম আর কে, যে মানুষকে আল্লাহ তায়ালার মসজিদে আল্লাহর নাম উচ্চারণে বাধা প্রদান করে এবং তা ধ্বংস সাধনে প্রচেষ্টা করে বেড়ায়? এ ধরনের লোকদের ইবাদতের ওই সব স্থানে ঢোকাই উচিত নয়। আর যদি যায় তাহলে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায়ই যেন যায়। তাদের জন্য পার্থিব জীবনে অপমান, লাঞ্ছনা এবং পরকালীন জীবনে ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে’ (সূরা বাকারা: ১১৪)।

১০. জালিম হলো, সুদভিত্তিক অর্থনীতি তথা ব্যবসাবাণিজ্য, লেনদেন ইত্যাদি পরিচালনাকারী। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। যদি প্রকৃতপক্ষে মুমিন হয়ে থাকো, আর যদি তা না করো তবে জেনে রেখো, এটা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এখনো যদি তাওবা করো এবং সুদ ছেড়ে দাও তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে। তোমরা জুলুম করবে না, তাহলে তোমাদের ওপরও জুলুম করা হবে না’ (সূরা বাকারা: ২৭৮-২৭৯) ।

১১. জালিম হলো, সেসব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি যারা মানুষকে ভয়াবহ আগুন বা ‘নার’-এর পানে তথা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করে। ‘অতঃপর আমি তাকে ও তার সৈন্যবাহিনীকে পাকড়াও করলাম এবং সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। দেখে নাও, জালিমদের পরিণতি কিরূপ হয়েছিল। আমি তাদেরকে নেতা বানিয়ে ছিলাম আর তারা মানুষকে ভয়াবহ ‘নার’-এর পানে আহ্বান করত। কিয়ামতের দিন তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (সূরা কাসাস: ৪০-৪১)।

১২. জালিম হলো তারা যারা মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে বাধা প্রদান করে, তাতে বক্রতা খোঁজে এবং আখিরাতকে প্রত্যাখ্যান করে।
‘যারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বাধা দেয়, সে পথকে বাঁকা করে দিতে চায় এবং আখিরাত তথা আল্লাহর দরবারে প্রত্যাবর্তন অস্বীকার করে’ (সূরা হুদ: ১৯)।

১৩. জালিম হলো ভূমিদস্যু। ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে জুলুমের পথ অবলম্বন করে কারোর এক বিঘাত পরিমাণ জমি আত্মসাত করে, কিয়ামতের দিন তার গলায় সাত তবক জমিন ঝুলিয়ে দেয়া হবে’ (বুখারি-২৯৫৯)।

১৪. জালিম হলো, যারা ধর্মের ব্যাপারে মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনকারী ব্যক্তি। ‘আল্লাহ তো তোমাদের কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন। যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তোমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তোমাদের বহিষ্কারে সাহায্য করেছে। এ ধরনের লোকদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই জালিম’ (সূরা মুমতাহিনা: ৯)।

উপসংহার: জুলুম একটি শব্দ। এর ব্যাপকতা অনেক। আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি, অবাধ্যতা, সীমাঅতিক্রম কিংবা কারো নিজের প্রতি অথবা অন্য কোনো মানুষের প্রতি অন্যায়-অবিচার, উতপীড়ন-নিপীড়ন, দুর্ব্যবহার এবং যেকোনো সৃষ্ট্ জীবের প্রতি প্রকৃত অধিকার হরণ বা তার যথোপযুক্ত

২.
সাপের কবলে পড়ে কাঁদে এক নির্জীব শিকার।
শেষ হয়ে এলো তার
জীবন-পিপাসা।
মাথা ঠুকে মরে সে মাটিতে
সকল জীবন, স্বপ্ন, আলোকের মুক্ত অধিকার
বাতাসে বাতাসে ভাসে ব্যর্থতার আহাজারি, ব্যর্থ হাহাকার।
এখানে সভয়ে দেখি আদমের সন্তানেরা
হলো কোটি মৃত্যুর শিকার,
কোটি আজদাহা-লোভ-কুণ্ডলীতে ক্ষয়মান দিগন্ত-কিনার
লীলাভূমি হলো জালিমের।

দিন শেষ হলো আমাদের।

দিকে দিকে শয়তানের অনুচর সেই জালিমেরা
তুলে দিল বেড়া,

কুল মাখলুক আজ সর্পবাস হলো জালিমের
দিন শেষ হলো আমাদের।
আমাদের ক্ষুধাতুর শবের পর্বতে
অত্যাচার করে গেলে নিশ্চিতে-বিলাসে
আমাদের ভবিষ্যত কালো-সিয়া অন্ধকারে শেষ হয়ে আসে
ক্ষুধাহীন হাড় ভাসে পথে।

তোমাদের পরিচয় আজ হলো শেষ।
অসংখ্য, অশেষ।
তোমরা সকলেই এক তোমাদের এক মজহাব
হারাম নেশায় মত্ত ছুড়িতেছে বিষাক্ত শারাব
জনতার বুকে মৃত্যু বিষ,
ছড়াতেছ সমাজ পুরীষ,
জালিমের সাথে নিতেছ সমান আঘাত,
মানুষের রক্ত শুষি আনিতেছ ভয়াবহ
অন্ধকার কালো-সিয়া রাত।
দুর্বল, বিশীর্ণ এই জনতার বিশ্বাসের চরম সুযোগে
যত পারো করো অত্যাচার।
আজ শুধু ঘৃণা ছাড়া আমাদের আর
কোনো শক্তি নাই এ দুর্যোগে।

আজ শুধু ঘৃণা করে যাব তোমাদেরে।
দিগন্ত-প্রসারী এই ঘৃণার ধোঁয়ায়
তোমাদের ঘিরে ফেলে কোন এক প্রবঞ্চিত ক্ষুধিত প্রভাতে
মুহূর্তে মৃত্যুর মতো প্রতিশোধ-লেলিহান ফাটিবে হাভিয়া
জালিমের আর জুলুমের বুকে এক সাথে চলিবে রহিয়া
শৃঙ্খল, শোষণ-ক্ষুব্ধ রুধিরাক্ত কলিজার উত্তপ্ত গরল।

সেই বিষে শেষ হবে, সে আঘাতে শেষ হবে
অভ্রভেদী অত্যাচার-তিক্ত হলাহল
এই উত্পীড়িত হাড়, বুভুক্ষু জিন্দেগি আর পাদপিষ্ট সিনা
আজ শুধু তোমাদেরে করে যাবে ঘৃণা
উত্তপ্ত লেলিহ ধোঁয়া বুকে তার উত্পীড়িত রাত্রি হবে ভোর
সে আগুন জ্বালানোর
দুর্বার জেহাদে।
ঐ দেখো, সেই ঘৃণা, সেই ঘনায়িত ধোঁয়া
সে লেলিহ মানবতা ক্ষুধাতুর বিষাক্ত প্রভাবে
মাথা তোলে জুলুমের ফাঁদে।
ফররুখ আহমদের

‘জালিম ও মজলুম’

কৃতজ্ঞতা: dailynayadiganta.com
kalerkantho.com








No comments:

Post a Comment