Thursday, May 7, 2020

আল্লাহ ন্যায়-নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন


আল্লাহ ন্যায়-নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন  এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন৷ তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো৷ –সূরা আর নাহলঃ আয়াত-৯০
Innal laaha ya'muru bil 'adli wal ihsaani wa eetaaa'i zil qurbaa wa yanhaa 'anil fahshaaa'i wal munkari walbagh-i' ya'izukum la'allakum tazakkaroon.
জুমআর সালাতের ভাষন তথা খুতবার শেষের দিকে ঈমাম সাহেব যখন এ আয়াতটি পাঠ করেন তখন আমরা মনে করি তিনি শেষের দিকে এসেছেন। এখন সালাত শুরু হবে। কিন্তু আমরা বোধ করি কখনোই এই গুরুত্বপূর্ণ আয়াতটি ভাল করে পড়িনা বা নিজের ঘরে গিয়েও এর ওপর কোন গবেষণা করিনা যে আল্লাহ তা‘য়ালা এখানে কী বলেছেন। আমরা আসলেই বড় অকৃতজ্ঞ আল্লাহ তা‘য়ালার প্রতি। 

এ ছোট্ট বাক্যটিতে এমন তিনটি জিনিসের হুকুম দেয়া হয়েছে যেগুলোর ওপর সমগ্র মানব সমাজের সঠিক অবকাঠামোতে ও চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত থাকা নির্ভরশীল৷
প্রথম জিনিসটি হচ্ছে আদল বা ন্যায়পরতা৷ দু'টি স্থায়ী সত্যের সমন্বয়ে এর ধারণাটি গঠিত৷
একঃ লোকদের মধ্যে অধিকারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও সমতা থাকতে হবে৷
দুইঃ প্রত্যেককে নির্দ্বিধায় তার অধিকার দিতে হবে৷ আমাদের ভাষায় এ অর্থ প্রকাশ করার জন্য
"ইনসাফ" শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ কিন্তু এ শব্দটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে৷ এ থেকে অনর্থক এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, দু' ব্যক্তির মধ্যে "নিসফ" "নিসফ" বা আধাআধির ভিত্তিতে অধিকার বন্টিত হতে হবে৷ তারপর এ থেকেই আদল ও ইনসাফের অর্থ মনে করা হয়েছে সাম্য ও সমান ভিত্তিতে অধিকার বণ্টন৷ এটি সম্পূর্ণ প্রকৃতি বিরোধী৷ আসলে"আদল" সমতা বা সাম্য নয় বরং ভারসাম্য ও সমন্বয় দাবী করে ৷ কোন কোন দিক দিয়ে "আদল" অবশ্যই সমাজের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সাম্য চায়৷ যেমন নাগরিক অধিকারের ক্ষেত্রে৷ কিন্তু আবার কোন কোন দিক দিয়ে সাম্য সম্পূর্ণ        "আদল" বিরোধী৷ যেমন পিতা ও মাতা ও সন্তানের মধ্যে সামাজিক ও নৈকিত সাম্য এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মজীবি ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মজীবীদের মধ্যে বেতনের সাম্য৷ কাজেই আল্লাহ যে জিনিসের হুকুম দিয়েছেন তা অধিকারের মধ্যে সাম্য নয় বরং ভারসাম্য ও সমন্বয় প্রতিষ্ঠা৷ এ হুকুমের দাবী হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার পূর্ণ ঈমানদারীর সাথে আদায় করতে হবে৷
দ্বিতীয় জিনিসটি হচ্ছে ইহসান বা পারোপকার তথা সদাচার, ঔদার্যপূর্ণ ব্যবহার, সহানুভূতিশীল আচরণ, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা পারস্পরিক সুযোগ সুবিধা দান, একজন অপর জনের মর্যাদা রক্ষা করা, অন্যকে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশী দেয়া এবং নিজের অধিকার আদায়ের বেলায় কিছু কমে রাযী হয়ে যাওয়া - এ হচ্ছে আদলের অতিরিক্ত এমন একটি জিনিস যার গুরুত্ব সামষ্টিক জীবনে আদলের চাইতেও বেশী৷ আদল যদি হয় সামাজের বুনিয়াদ তাহলে ইহসান হচ্ছে তার সৌন্দর্য ও পূর্ণতা৷ আদল যদি সমাজকে কটুতা ও তিক্ততা থেকে বাঁচায় তাহলে ইহসান তার মধ্যে সমাবেশ ঘটায় মিষ্ট মধুর স্বাদের৷ কোন সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি সর্বক্ষণ তার অধিকার কড়ায় গণ্ডায় মেপে মেপে আদায় করতে থাকবে এবং তারপর ঐ নির্দিষ্ট পরিমাণ অধিকার আদায় করে নিয়েই তবে ক্ষান্ত হবে, আবার অন্যদিকে অন্যদের অধিকারের পরিমাণ কি তা জেনে নিয়ে কেবলমাত্র যতটুকু প্রাপ্য ততটুকুই আদায় করে দেবে, এরূপ কট্টর নীতির ভিত্তিতে আসলে কোন সমাজ টিকে থাকতে পারে না ৷ এমনি ধরনের একটি শীতল ও কাঠখোটটা সমাজে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থাকবে না ঠিকই কিন্তু ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা, ঔদার্য, ত্যাগ, আন্তরিকতা, মহানুভবতা ও মংগলাকাংখার মত জীবনের উন্নত মূল্যবোধগুলোর সৌন্দর্য সুষমা থেকে সে বঞ্চিত থেকে যাবে ৷ আর এগুলোই মূলত এমন সব মূল্যবোধ যা জীবনে সুন্দর আবহ ও মধুর আমেজ সৃষ্টি করে এবং সামষ্টিক মানবীয় গুণাবলীকে বিকশিত করে৷
তৃতীয় যে জিনিসটির এ আয়াতে হুকুম দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে আত্মীয়- স্বজনদেরকে দান করা এবং তাদের সাথে সদাচার করা ৷ এটি আত্মীয়- স্বজনদের সাথে ইহসান করার একটি বিশেষ ধরন নির্ধারণ করে৷ এর অর্থ শুধু এই নয় যে, মানুষ নিজের আত্মীয়দের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, দুঃখে ও আনন্দে তাদের সাথে শরীক হবে এবং বৈধ সীমানার মধ্যে তাদের সহায্যকারী ও সহায়ক হবে৷ বরং এ ও এর অর্থের অন্তরভুক্ত যে, প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তি নিজের ধন-সম্পদের ওপর শুধুমাত্র নিজের ও নিজের সন্তান-সন্ততির অধিকার আছে বলে মনে করবে না বরং একই সংগে নিজের আত্মীয়- স্বজনদের অধিকার ও স্বীকার করবে৷ আল্লাহর শরীয়াত প্রত্যেক পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে যে, তাদের পরিবারের অভাবী লোকেরা যেন অভুক্ত ও বস্ত্রহীন না থাকে৷ তার দৃষ্টিতে কোন সমাজের এর চেয়ে বড় দুর্গতি আর হতেই পারে না যে, তার মধ্যে বসবাসকারী এক ব্যক্তি প্রাচুর্যের মধ্যে অবস্থান করে বিলাসী জীবন যাপন করবে এবং তারই পরিবারের সদস্য তার নিজের জ্ঞাতি ভাইয়েরা ভাত কাপড়ের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকবে৷ ইসলাম পরিবারকে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান গণ্য করে এবং এ ক্ষেত্রে এ মূলনীতি পেশ করে যে প্রত্যেক পরিবারের গরীব ব্যক্তিবর্গের প্রথম অধিকার হয় তাদের পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের ওপর, তারপর অন্যদের ওপর তাদের অধিকার আরোপিত হয়৷ আর প্রত্যেক পরিবারের সচ্ছল ব্যক্তিবর্গের ওপর প্রথম অধিকার আরোপিত হয় তাদের গরীব আত্মীয় - স্বজনদের, তারপর অন্যদের অধিকার তাদের ওপর আরোপিত হয়৷ এ কথাটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন৷ তাই বিভিন্ন হাদীসে পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে, মানুষের ওপর সর্বপ্রথম অধিকার তার পিতামাতার, তারপর স্ত্রী- সন্তানদের, তারপর ভাই- বোনদের, তারপর যারা তাদের পরে নিকটতর এবং তারপর যারা তাদের পরে নিকটতর৷ এ নীতির ভিত্তিতেই হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু একটি ইয়াতীম শিশুর চাচাত ভাইদেরকে তার লালন পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন৷ তিনি অন্য একজন ইয়াতীমের পক্ষে ফায়সালা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, যদি এর কোন দূরতম আত্মীয়ও থাকতো তাহেল আমি তার ওপর এর লালন পালনের দায়িত্ব অপরিহার্য করে দিতাম৷ অনুমান করা যেতে পারে, যে সামাজের প্রতিটি পরিবার ও ব্যাক্তি এভাবে নিজেদের ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব নিজেরাই নিয়ে নেয় সেখানে কতখানি অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, কেমন ধরনের সামাজিক মাধুর্য এবং কেমনতর নৈতিক ও চারিত্রিক পুতঃপবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও উন্নত পরি‌বেশে সৃষ্টি হতে পারে৷
ওপরের তিনটি সত কাজের মোকাবিলায় আল্লাহ তিনটি অসত কাজ করতে নিষেধ করেন৷ এ অসত কাজগুলো পর্যায়ে ব্যক্তিবর্গকে এবং সামষ্টিক পর্যায়ে সমগ্র সমাজ পরিবেশকে খারপ করে দেয়৷
পথম জিনিসটি হচ্ছে অশ্লীলতা- নির্লজ্জতা৷ সব রকমের অশালীন, কদর্য ও নির্লজ্জ কাজ এর অন্তরভুক্ত৷ এমন প্রত্যেকটি খারাপ কাজ যা স্বভাবতই কুতসিত, নোংরা, ঘৃণ্য ও লজ্জাকর৷ তাকেই বলা হয় অশ্লীলতা৷ যেমন কৃপণতা, ব্যভিচার উলংগতা, সমকামিতা, মুহররাম আত্মীয়কে বিয়ে করা, চুরি, শরাব পান, ভিক্ষাবৃত্তি, গালাগালি করা কটু কথা বলা ইত্যাদি৷ এভাবে সর্ব সমক্ষে বেহায়াপনা ও খারাপ কাজ করা এবং খারাপ কাজকে ছড়িয়ে দেয়াও অশ্লীলতা- নির্লজ্জতার অন্তরভুক্ত৷ যেমন মিথ্যা প্রচরণা, মিথ্যা দোষারোপ, গোপন অপরাধ জন সমক্ষে বলে বেড়ানো, অসতকাজের প্ররোচক গল্প, নাটক ও চলচ্চিত্র, উলংগ চিত্র, মেয়েদের সাজগোজ করে জনসমক্ষে আসা নারী পুরুষ প্রকাশ্যে মেলামেশা এবং মঞ্চে মেয়েদের নাচগান করা ও তাদের শারীরিক অংগভংগীর প্রদর্শনী করা ইত্যাদি৷
দ্বিতীয়টি হচ্ছে দুষ্কৃতি এর অর্থ হচ্ছে এমন সব অসত কাজ যেগুলোকে মানুষ সাধারণভাবে খারাপ মনে করে থাকে, চিরকাল খারাপ বলে আসছে এবং আল্লাহর সকল শরীয়ত যে কাজ করতে নিষেধ করেছে৷
তৃতীয় জিনিসটি জুলুম- বাড়াবাড়ি। এর মানে হচ্ছে, নিজের সীমা অতিক্রম করা এবং অন্যের অধিকার তা আল্লাহর হোক বা বান্দার হোক লংঘন করা ও তার ওপর হস্তক্ষেপ করা ৷
রেফারেন্সঃ

No comments:

Post a Comment