তার বিকেল, তার সকাল বড্ড একলা কাটে। তার রাত প্রলম্বিত, আরও নিষ্ঠুর। একলা সন্তান এমনভাবেই হাহাকার করতে করতে একদিন মানুষ হয়ে যায়। হয়ত নিজের একাকিত্বকে সমাজের কাছে গচ্ছিত রেখে প্রতিষ্ঠিতও হয় জীবনে। তবু প্রশ্ন জাগে, এরা কি আদৌ জীবনের পরিপূর্ণতাটুকু পায়? তার এই একাকিত্বের জন্য কি আমরা কোনোভাবেই দায়ী নই?
পর্ব এক:
সাদা ফুল কালো রঙে আঁকছি
'আমার বন্ধু মানুষ/ আমার বন্ধু পাখী/ আমার বন্ধু নারকোল গাছ/
আমি বন্ধুকে ডাকি/
আমার
বন্ধু তুমি/ তোমার বন্ধু কই/ আমিই আমার বন্ধু, আমরা/ একসাথে বাঁচবই' -
কবীর সুমন
একক
সন্তানের বহমান নিঃসঙ্গতা অবিকল ধরা পড়েছে সত্যজিতরায়ের ‘পিকু’ ছবিটিতে। এই বড়দের
ছোট ছবিটি (শর্ট ফিল্ম)-র কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে পিকু নামের একটি ছোট্ট ছেলে। কলকাতার
এক অভিজাত পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম সে। প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িতে পিকুর সারাদিন কাটে
একাকী। বংশের দ্বিতীয় প্রজন্ম তাঁর বাবা ও মা, দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। পরস্পরের প্রতি
তাঁদের শ্রদ্ধা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। পিকুর বাবা সবসময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
সারাদিন তিনি বাড়ির বাইরেই কাটান। মা ব্যস্ত থাকেন তাঁর পুরুষবন্ধু সতীশকে নিয়ে,
দুজনের সময় কাটে পিকুদের বাড়িতেই। এই
বিশাল বাড়িটিতে আরও একজন থাকেন। তিনি বাড়ির প্রথম প্রজন্ম,
পিকুর অসুস্থ দাদু,
কিছুদিন আগে যাঁর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক
হয়েছে। যেদিনের ঘটনা সেদিন পিকুর স্কুল ছুটি। যথারীতি তার বাবা বাড়িতে নেই।
সতীশকাকু বাড়িতে এসেছেন দেখে মা তাকে বাড়ির বাগানে গিয়ে ছবি আঁকার নির্দেশ
দিলেন। এই অবসরে মা ও সতীশকাকু যখন গোপনে শরীরী খেলায় মগ্ন এবং পিকু ছবি আঁকতে,
তখন হঠাত পিকুর দাদুর দ্বিতীয়বারের জন্য হার্ট
অ্যাটাক হয়। ফাঁকা বাড়িতে পুত্রবধূর সাহায্য চেয়ে চেয়ে না পেয়ে শেষপর্যন্ত তিনি মারা
যান। আকাশে তখন মেঘ করেছে। পিকু বুঝতে পারছে না সাদা ফুল সে কি রঙ দিয়ে আঁকবে। সে
চিত্কার করে মাকে জানায়- ‘সাদা ফুল কালো রঙ দিয়ে আঁকছি’। এইসময় এক ফোঁটা বৃষ্টি
পড়ে তার ছবির খাতায়। পিকু খাতা নিযে দৌড়ে ওপরে এসে বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে শুনতে
পায় মা ও সকতীশকাকু ঝগড়া করছে। দরজার বাইরে থেকে সে চিত্কার করে বলে ওঠে,
‘চোপ’।
এই চোপ
শব্দটি যেন একক সন্তানের কন্ঠ থেকে বেরনো এক বজ্র নিনাদ। সমাজের মুখে ছুড়ে দেওয়া
তীব্র ঘৃণা। এর পরে পিকু ছুটে দাদুর ঘরে যায় কিন্তু তখন তিনি আর বেঁচে নেই।
একক
সন্তান-কিছু যুক্তি
কালের
নিয়মে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার অগ্রগতি, নগরায়ণ এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি মানুষকে ছোট পরিবারের দিকে নিয়ে গেছে। দেখা গেছে,
কমতে থাকা জন্মহার,
জন্মনিয়ন্ত্রণ,
মুদ্রাস্ফীতির অনিয়ন্ত্রিত চাপে অধিকাংশ
পরিবার একক সন্তানের দিকে ঝুঁকছে। আজকের দিনের অধিকাংশ শিক্ষিত দম্পতি তাই একটি
সন্তানেই খুশি। এমনকী এমনও কেউ কেউ আছেন যাঁরা সন্তানই চান না। তবে সেটা অন্য
প্রসঙ্গ।
একলা
সন্তান হওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা দুটোই আছে। অধিকাংশ বিবাহিত দম্পতি কিছুদিন বিবাহিত
জীবন কাটানোর পরে সন্তান কামনা করেন। সেটাই স্বাভাবিক,
সুস্থ ও সুন্দর এবং চিরন্তন। তবে আগেকার
দিনে ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে অন্যরকম ছিল। তখন সন্তান উত্পাদন ছিল বিনোদনের
অন্যতম মাধ্যম। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাভাবনায় বাস্তবতার
ছোঁয়া লাগে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ‘পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ বলে দার্শনিকতার
আশ্রয় নিয়ে ভিন্ন এক চালাকির অশ্রয় নেয়। পরিবারের সদস্য সংখ্যা,
বিশেষ করে পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়াকে
তখন সুবিধাজনক বলে মনে করা হত। এর সবচেয়ে বড় কারণ বেশি পুত্র সন্তান সংসারে মোট
উপার্জন বাড়াতে সাহায্য করত। একটু আরামে বিলাসে কাটানো যেত। তাই প্রাচীন ইতিহাস
ঘেঁটে একক সন্তানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
একই
যুক্তিতে আজও বহু গ্রামীণ বা শহুরে বস্তিতে থাকা পরিবারের নিরক্ষর দম্পতিরা একাধিক
সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন। তাঁদের কাছে বেশি সন্তান মানে অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে বেশি
লাভ। জীবনধারণে আর একটু স্বাচ্ছন্দ্য। কোনও রকমে শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পদার্পণ করলেই
এই সব শিশুদের শ্রমিক হিসেবে কাজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাতে সংসারের আয় বাড়ে। তবে এর
পরিণতি কিন্তু মারাত্মক। বংশানুক্রমিকভাবে এই পরিবারগুলির দারিদ্র্য আর ঘোচে না।
জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যুনতম উপাদানে বঞ্চিত হয়ে এরা আর্থিক অনটনের কারণে এক
সময় অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। তার পরে এক সময় বাবা-মাকে পরিত্যাগ করে
অন্য জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়।
পর্ব
দুই: বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও লিটল এম্পারর সিনড্রোম
১৯৪০
সালের পর থেকে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং বিশেষ করে এশিয়া মহাদেশের চীন ও জাপান-সহ
কয়েকটি দেশের পরিবারগুলিতে একক সন্তানের প্রবণতা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে।
আমেরিকা: আমেরিকার সেন্সার ব্যুরোর সার্ভে অনুসারে
সে দেশে ২০১১ সালে ১ কোটি ৫০ লক্ষ পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে যাদের একক সন্তান
ছিল। এক সন্তান আছে এমন পরিবারের সন্তানদের মোট সংখ্যা হিসেব করে দেখা গেছে,
তা আমেরিকার মোট শিশুর ২০%,
যা ক্রমশ বর্ধনশীল। অর্থাৎ,
একক সন্তান রয়েছে এমন পরিবার একাধিক
সন্তানযুক্ত পরিবারকে ক্রমশ পিছনে ফেলে দিচ্ছে। অথচ তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা হল,
৫০ বছর আগেও সংখ্যাটি ছিল ১০%।
অস্ট্রেলিয়া: ২০০৬ সালে করা অস্ট্রেলিয়ান ইনস্টিটিউট
অফ ফ্যামিলি স্টাডিজ-এর একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে যে,
অস্ট্রেলিয়ার মহিলারা তিনটি সন্তানের
চাইতে দুটি সন্তান জন্মদানে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। দেখা গেছে,
সে দেশে বেশি সন্তানের আকাঙ্খা ধীরে ধীরে
কমছে। অস্ট্রেলিয়ার তিন সন্তান বনাম দুই সন্তানের জন্মহার ১৯৯৬ সালে যেখানে ছিল
৩৮% বনাম ২৫%, ২০০৬
সালে সেটি কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩৮% বনাম ২২%-এ। এর ফলে ২০০৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার
অধিকাংশে পরিবারে দুটি করে সন্তান ছিল। তবে পরিবার পিছু একটি সন্তানের সংখ্যা ধীরে
ধীরে বাড়ছিল। ১৯৮১ সালে সে দেশে একক সন্তান আছে এমন পরিবারের সংখ্যা ছিল ৮%,
সেটাই ২০০৬ সালে গিয়ে ১৩%-এ দাঁড়ায়।
চীন: ১৯৭৯ সাল অবধি চীন দেশের মূল ভুখণ্ডে চালু
হওয়া ‘ওয়ান চাইল্ড পলিসি’ বা ‘এক সন্তান নীতি’ অধিকাংশ দম্পতিকে একটি সন্তানের
জন্ম দিতে বাধ্য করেছিল। তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় পর্যায়ে ও পরিস্থিতির বিচারে
অবশ্য কিছু নিয়মানুগ শৈথিল্যের ব্যবস্থা ছিল। এর প্রভাবে ভাল হয়েছে না খারাপ,
তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। যেমন,
কিছু কিছু গবেষক মনে করেন চীনে এক সন্তান
নীতির অধীনে জন্ম নেওয়া শিশুরা তুলনামূলকভাবে কম প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের
অধিকারী। প্রতিকূলতা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও অন্যদের থেকে পিছিয়ে। একই সঙ্গে তারা
হতাশাপ্রবণও। সম্প্রতি কিছু গবেষক ৪২১ জন চীন দেশের নাগরিকের বিভিন্ন তথ্য পরীক্ষা
ও পর্যবেক্ষণ করেন। এ ক্ষেত্রে ‘এক সন্তান নীতি’র অধীনে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের এক
দলে এবং নীতি প্রবর্তনের আগে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের ভিন্ন দলে রাখা হয়েছিল। এই
সমীক্ষার জন্য হওয়া সমস্ত পরীক্ষার পরে গবেষক দল এই সিদ্ধান্তে আসেন যে ‘এক সন্তান
নীতি’র অধীনে জন্ম নেওয়া-
·
ব্যক্তিরা কম নির্ভরযোগ্য
·
এঁরা অন্যের ওপরে আস্থা রাখতে পারেন না
·
ঝুঁকি নিতে অপছন্দ করেন
·
প্রতিযোগিতা-মনস্ক হন না
·
নীতিবান নয়
·
এরা কিছুটা বাতিকগ্রস্ত ও নেতিভাবাপন্ন হয়়
তবে অনেক
গবেষকই এই ধরনের সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করেন। তাঁরা মনে করেন,
একক সন্তান হোক বা সহোদর-যুক্ত সন্তান,
তাদের মধ্যে চরিত্রগত কোনও পার্থক্য থাকে
না।
সে যাই
হোক, চীনের
সাম্প্রতিক আদমশুমারি থেকে জানা যাচ্ছে সে দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য যে
পরিমান জনসংখ্যা দরকার ছিল বর্তমান জন্মহার তার চেয়ে কমে এসেছে। সে ক্ষেত্রে
বর্তমানে এই নীতির পরিবর্তন ঘটার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বাধ্যতামূলকভাবে এক
সন্তান নীতি কার্যকর করতে গিয়ে চীন সরকারকে বিশাল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যয় বহন
করতে হয়েছিল। তা ছাড়া এর ফলে গোটা দেশে এক দীর্ঘমেয়াদি লিঙ্গ-বৈষম্যের সৃষ্টি
হয়েছে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। ২০০০ সালে চীনে ছেলে ও মেয়ে জন্মানোর ক্ষেত্রে
অনুপাত ছিল ১১৭:১০০। প্রকৃতিগত ভাবে এই অনুপাত ১০৩-১০৭:১০০ হওয়া উচিত। এ ছাড়াও
বিভিন্ন রিপোর্টে চীনে মেয়ে শিশু মৃত্যুর হার বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
লিটল
এম্পারর সিনড্রোম
চীন দেশের ‘একক সন্তান নীতি’ থেকে লিটল এম্পারর সিনড্রোম বা লিটল এম্পারর এফেক্টের উত্পত্তি। সে দেশে কোনও পরিবারে ‘একক সন্তান নীতি’ থেকে জাত একক সন্তান তাদের বাবা-মা বা দাদু-দিদার কাছ থেকে আপাতদৃষ্টিতে অতিরিক্ত মনোযোগ পেয়ে থাকে। চীনের শিশুদের বাবা-মায়ের সংযোজন রূপে গণ্য করা হয়, যেখানে বাবা বা মায়ের প্রতি আনুগত্যই একটি শিশুর একমাত্র উত্কর্ষ বলে বিবেচিত। পরিবারের বেশি খরচ করার ক্ষমতা এবং ছেলে বা মেয়ে যাতে নিজেদের মতো উপেক্ষিত না হয় তার জন্য বাবা-মায়ের অস্বাভাবিক অভিলাষ মিলিতভাবে এক ধরনের প্রবণতা তৈরি করে। এটাই লিটল এম্পারর সিনড্রোম, যা আসলে একটি পরিব্যপ্ত সামাজিক ব্যাধি। এই প্রবণতা মোটেও সুখকর নয়, বরং যথেষ্ট সমস্যাসঙ্কুল।
অনেক গবেষকের মতে এই প্রবণতা চরম অবস্থায়
পৌঁছে গিয়ে এমন একটি অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করবে,
যাতে সমাজের ভয়ঙ্কর ক্ষতি হতে পারে।
চীনের লাগামছাড়া অর্থনৈতিক অগ্রগতি সে দেশের পার ক্যাপিটা ইনকামকে এক অসামান্য
উচ্চতায় নিয়ে গেছে। মেয়েরাও সেখানে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। ফলে
পরিবারের আয় বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। ক্রয় ক্ষমতার এই অসামান্য উন্নতিতে দম্পতিরা
দু’হাত ভরে তাদের সন্তানকে অপ্রয়োজনেও খেলনা থেকে জামাকাপড় সব কিছু কিনে দিচ্ছেন।
তাদের সমস্ত ধরনের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছেন। দেখা যাচ্ছে এই সব পরিবারের মোট
আয়ের প্রায় অর্ধেকই সন্তানের পেছনে ব্যয় করা হয়। বিনিময়ে বাবা-মায়ের মধ্যে তৈরি হয়
এক ধরনের অতিরিক্ত চাহিদা। ছোটবেলা থেকেই শিশুরা অত্যধিক চাপের শিকার হয়। এই
প্রসঙ্গে পরিবারের চার-দুই-এক গঠনেরও উল্লেখ করা যেতে পারে। এর অর্থ চারজন
দাদু-দিদিমা এবং দু’জন বাবা-মা একটি শিশুর ওপরে মিলিতভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। অর্থাত,
গোটা পরিবারটি আবর্তিত হচ্ছে একক
সন্তানটিকে ঘিরে। ভেঙে যাচ্ছে সনাতন কাঠামোয় তৈরি হওয়া আগেকার সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
কোরিয়া: ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ সমাপ্তির পরে
কোরিয়া সরকার নাগরিকদের এই মর্মে পরামর্শ দিয়েছিল যে,
অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে একটি বা দুটি
সন্তানই যথেষ্ট। এই প্রসঙ্গে আমাদের দেশের ছয় ও সাতের দশকের কথাও মনে করা যেতে
পারে, যখন
‘একটি বা দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ কিংবা ‘হাম দো হামারা দো’ মর্মের সরকারি বিজ্ঞাপনে
শহর-গঞ্জ ভরে গিয়েছিল। যাই হোক কোরিয়ান সরকারের সেই পরামর্শে কাজ হয়েছিল। সে দেশে
জন্মহার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায় এবং বহু সংখ্যক পরিবারে একক সন্তানের জন্ম হয়।
পর্ব
তিন: কাকা, পিসি, মামা ... এখন প্রায় বিলীয়মান
আজকের
ভাবনা
গোটা
বিশ্বে আজকের দম্পতিদের একক সন্তান চাওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত কারণ থেকে শুরু করে
সামাজিক, অর্থনৈতিক,
পেশাগত ইত্যাদি অনেক কারণ রয়েছে। যেমন,
ব্যক্তিগত পছন্দে,
পরিবার পরিকল্পনার লক্ষ্যে,
আর্থিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে,
বেশি বেশি বেড়ানোর ইচ্ছায়,
পারিবারিক চাপে,
পড়াশুনা বা গবেষণা সংক্রান্ত সুবিধা
পেতে, বেশি
বয়সে বিয়ে করেছেন বলে, প্রাতিষ্ঠানিক স্থায়িত্ব ও পেশার লক্ষ্যে,
সময়ের বাধায়,
অনেক মহিলার ক্ষেত্রে গর্ভধারণ সংক্রান্ত
ভীতির কারণে, এক সন্তান
জন্মানোর পরে বন্ধ্যাত্বের কারণে, ডিভোর্স ইত্যাদির কারণে অনেকেই একক সন্তান চাইছেন। তা ছাড়া
কেরিয়ার ও নিজস্ব স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে নজর রাখতে গিয়েও প্রচুর দম্পতি আজকাল দেরি
করে সন্তান আনছেন। এই দেরির কারণে বন্ধ্যাত্বের সমস্যা প্রাধান্য পাচ্ছে। নানাভাবে
চেষ্টা করে বন্ধ্যাত্ব সমস্যা সমাধান করে একবার সন্তান লাভের পর অধিকাংশ দম্পতি
দ্বিতীয় বা তৃতীয়বারের জন্য আর সে পথে হাঁটছেন না। শুধু শহরে নয় গ্রামেও ধীরে ধীরে
ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। পরিবারে এক সন্তানের সংখ্যা বৃদ্ধির এটাও একটি মস্ত
কারণ।
আমার মনে
হয়, আমাদের নিজস্ব
অভিজ্ঞতা দিয়েই আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, একটি সন্তানযুক্ত পরিবারের সংখ্যা
অতি-দ্রুত হারে বাড়ছে এবং এই বৃদ্ধির হার আপাতত বেশ কিছুদিন বজায় থাকবে বলে মনে
করা যেতে পারে।
ভারতের
প্রেক্ষিত
আজকের
ভারতের প্রায় ১০% পরিবার একক সন্তানের বিকল্প বেছে নিয়েছে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে
একটি অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। দেখা যাচ্ছে, এই সব পরিবারের অভিভাবকেরা এই কারণেই একক
সন্তানে থামতে চান, যাতে তাঁদের আয়ের উত্সে মনোনিবেশ করে সেটিকে সর্বাধিক
পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। তবে এই আয় বাড়ানোর কারণ নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের
জন্য নয়, উত্তর
পুরুষটি এই দুর্মূল্যের বাজারেও যেন ‘দুধে ভাতে’ বেঁচে থাকতে পারে,
তাঁদের সেটাই উদ্দেশ্য। এই প্রবণতা অবশ্য
মেট্রোপলিটান শহরগুলির শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেশি। দিল্লির ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল
অফ অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ’-এর করা গবেষণা থেকে এই তথ্য উঠে এসেছে। দিল্লির
জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির করা অন্য একটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে,
আমাদের দেশের ৮% মহিলাও চান তাঁদের যেন
একটি সন্তানই হয়।
সামাজিক
ট্রেন্ড
একক
সন্তান চাওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় পারবারিক আয়ই যে মুখ্য ভূমিকা নেয় তাও কিন্তু নয়। আশ্চর্য
হলেও সত্যি যে ভারতীয় সমাজের সর্বোচ্চ আয়ের উত্সধারী অংশেও এক সন্তানযুক্ত মায়ের
সংখ্যা ১১%। এমনকী বর্তমানের প্রায় এক চতুর্থাংশ কলেজ শিক্ষিত মেয়েরাও চান তাঁদের
একটি সন্তানই হোক। আমরা জানি, ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল পরম্পরাগতভাবে বড় পরিবারকে
সমর্থন করে এসেছে। তা সত্ত্বেও নতুন সামাজিক ও জনতাত্ত্বিক ধারা অনুসারে অর্থনৈতিক
বৃদ্ধি ও সনাতন মূল্যবোধের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শহুরে সমাজ ব্যবস্থায়
চিরাচরিত ভাবনার বিপ্রতীপে একধরনের বহির্মুখিতার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। এটা একটা
সামাজিক ট্রেন্ড হয়ে উঠল কিনা তা নিয়ে সমাজতত্ত্ববিদরা ভাবতে পারেন। কথাটি অবশ্য
সমগ্র এশিয়া মহাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রচুর মহিলা
আজকাল স্বাভাবিক বয়সের চেয়ে অনেক দেরি করে বিয়ে করছেন অথবা আদৌ বিয়ে করছেন না। লিভ
টুগেদার আজ আর উপন্যাসে পড়া ঘটনা নয়। আমাদের আশেপাশে থাকা অনেক যুবক-যুবতীই লিভ
টুগেদারে বেশি স্বচ্ছন্দ।
শহুরে
মধ্যবিত্ত সমাজে এখন এটা আর অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে, বহু পরিবারে প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার
পরেও আর সন্তান নেওয়া হচ্ছে না। ভাবলে অবাক লাগে ছবিটা কিন্তু এক সময় একেবারেই
অপরিচিত ছিল। আমাদের দেশে পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে ছেলে ছিল হীরের আংটি,
সেটা বাঁকা হলেও তাই ক্ষতি বলে মনে করা
হত না। আর তাই বড় সন্তান মেয়ে হলে অন্তত একটি পুত্র সন্তানের আশায় অধিকাংশ
পরিবারে আরও একবার (অনেক ক্ষেত্রে দু’বার) সন্তান আনা হত। একলা সন্তানের ইচ্ছায় এই
সনাতন ভাবনার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারার কারণেই হয়ত একসময়ের খুব পরিচিত দৃশ্যটি আজ
বিরল হয়ে উঠেছে। বাড়ির একমাত্র সন্তান হিসেবে মেয়ে সংসারের হাল ধরেছে এটা দেখতে
আমরা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি।
ওপরে
আলোচিত বক্তব্যগুলি নিঃসন্দেহে এক একটা নতুন প্রবণতা। ভারতের মতো দেশে যেখানে
জনবিস্ফোরণ একটা প্রবল সমস্যা সেখানে এই ধরনের প্রবণতাকে চোখ বুজে সমর্থন করা
উচিত। তাই আজ একক সন্তানযুক্ত পরিবার নয়, একাধিক সন্তানযুক্ত পরিবারকেই অন্য চোখে
দেখা হয়। আজ থেকে দু’দশক আগে কিন্তু এই ধরনের মানসিকতা যুক্ত পরিবারের সংখ্যা
আজকের তুলনায় প্রায় অর্ধেক ছিল। তখন বড়জোর ৫% দম্পতি একক সন্তান গ্রহণের কথা
ভাবতে পারতেন।
বিলীয়মান
প্রজাতি- কাকা, পিসি, মামা ...
ডোডো পাখি বিলুপ্ত। আরও হাজার হাজার
পশুপাখি জন্তুজানোয়ারও বিলুপ্তির মুখে। মানুষ চিন্তিত। তাই বিলীয়মান এই সব
প্রজাতির সুরক্ষায় নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে এই ধরনের উদ্যোগ আশা সঞ্চার করেছে। অথচ আমাদের অলক্ষ্যে আরও কিছু প্রজাতি
যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পথে তা আমরা ভেবে দেখছি না।
এখন প্রতি পরিবার পিছু সবেধন নীলমণির মতো
একটি ছেলে বা একটি মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে কী ধরনের বিপর্যয় ঘটতে চলেছে তা
ভেবে দেখেছেন কি? এদের আদৌ কাকু/জেঠু বা পিসি, মামা বা মামি হওয়ার সম্ভাবনাই থাকছে না।
কারণ এরা তো ওই বংশের শিবরাত্রির সলতে। ছেলেটি কাকু/জেঠু হতে পারবে না কারণ,
তার কোনও ভাই/দাদা নেই,
অন্য দিকে মেয়েটি মাসি হতে পারবে না কারণ,
তার কোনও বোন/দিদি নেই। এ ছাড়াও ভেবে
দেখুন ওই ছেলে বা মেয়েটির কোনও দিনই কোনও বড়দা, মেজদা, ছোড়দা কিংবা বড়দি,
মেজদি, ছোড়দি থাকবে না। একইভাবে এরা কখনও কারও
বড়কাকু, মেজকাকু,
ছোটকাকু, ফুলকাকু, ন’কাকু কিংবা বড়পিসি,
মেজপিসি, সেজপিসি, ফুলপিসি হতে পারবে না। এবার সোনাদা,
ফুলদা, সোনাপিসি, ফুলপিসি, ভালপিসি, মেজকাকিমা, সেজকাকিমা, ন’কাকিমার কথা ভাবুন। ওঁদের কী হবে,
ওঁরা সব কোথায় থাকবেন?
মামিমা, জেঠিমা, মেসো, জ্যাঠা- বাংলার এই পরিচিত সব সম্পর্ক কি
তা হলে হারিয়ে যাবে? আর তাই বোধহয় বাড়ি বাড়ি ঘুরেও ছিপ নিয়ে ধ্যানমগ্ন কাকু,
বড়ি দেওয়ার পিসি,
আচার দেওয়ার মাসি কিংবা ফেলুদার সিধু
জ্যাঠা- এমন কাউকেই মিলবে না।
নির্ধারক
শক্তি
বিভিন্ন
জনভিত্তিক গবেষণা থেকে এটা প্রমাণ করা গেছে যে, ভারতের মতো দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির
দেশে একক সন্তান আনার এই প্রবণতার ক্ষেত্রে চাকরির প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বড়
নির্ধারক শক্তি। একক সন্তানযুক্ত পরিবার যে খুব বেশি বেশি খায় কিংবা কিংবা অনেক
বেশি কাজ করে, এমন
কিন্তু নয়। বড় পরিবারের সঙ্গে এই পরিবারগুলির পার্থক্য হল,
এরা সন্তান খাতে বেশি খরচ করে,
যাতে বেশি পড়াশুনা করে সে কোনও ভাল
চাকরি জুটিয়ে নিতে পারে। এই কারণেই বর্তমানে এই ধরনের পরিবারে একক সন্তানের শিক্ষা
খাতেই সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে। মুশকিল হল, শিক্ষার জন্য অনেক অনেক বেসরকারি স্কুল,
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলেও সেই পরিমাণ
চাকরির ব্যবস্থা করে ওঠা যায়নি। তার ফলে প্রতিযোগিতা বেড়েছে বই কমেনি। তাই শেষ
পর্যন্ত এক ধরনের অনিশ্চয়তার শিকার হয়ে অধিকাংশ বাবা-মা তাঁদের সন্তানের প্রতি
নানাভাবে প্রত্যাশার চাপ অন্যায়ভাবে বাড়িয়ে চলেছেন। সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করছেন,
এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের দেশের
ছেলেমেয়েদেরও চীনের মতো ‘লিটল এম্পারর সিনড্রোম’ তৈরি হতে পারে।
পর্ব
চার: গবেষণায় সনাতন ধারনার পরিবর্তন
একলা
সন্তানের অসুবিধা
এই একক
সন্তান-প্রবণতা খারাপ না ভাল তা নিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। নিত্যনতুন
গবেষণায় নানা উল্লেখযোগ্য তথ্যও উঠে আসছে। কেউ বলছেন এই প্রবণতা খারাপ,
কেউ ভাল।
প্রথমে
এর খারাপ দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক। দেখা যাক একক সন্তান হওয়ার কারণে ভবিষ্যৎ জীবনে একটি শিশুর কী ধরনের সমস্যা হতে পারে।
তবে এই সব সমস্যা যে সবসময় সমস্ত একক সন্তানের ক্ষেত্রেই ঘটবে,
এমন নয়। গোটা ব্যাপারটা আসলে কিছু ঝুঁকি
তৈরি করে। কিছু কিছু মনস্তত্ত্ববিদ মনে করেন, একক সন্তানেরা খুব দ্রুত এই ধরনের
ঝুঁকিতে সামিল হয়ে নানা রকমের জটিলতার শিকার হয়ে পড়তে পারে। নিচে এই সম্ভাব্য
ঝুঁকির কারণগুলি জানানো হল-
একাকিত্ব: ছোটবেলা থেকেই একা একা বেড়ে উঠতে হয় বলে
একক সন্তানের পক্ষে একাকিত্ব একটা বিরাট বোঝা। যে বয়সে সঙ্গীর দরকার সে বয়সে সে
সঙ্গীহীন হয়ে একা একা সময় কাটায়। এই নিঃসঙ্গতাজনিত ট্রমা তাকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে
হতে পারে।
আত্মকেন্দ্রিকতা: একা থাকতে হয় বলে এই ধরনের একক শিশু কোনও
কিছু ভাগাভাগি করে নেওয়ার শিক্ষা পায় না। তার ফলে আত্মকেন্দ্রিকতা তার বৈশিষ্ট্য
হয়ে উঠতে পারে। সে ক্ষেত্রে সে সবসময় নিজের স্বার্থটাই বুঝতে শেখে। মিলেমিশে থাকতে
পারে না। বৃহত্তর সমাজে মেলামেশার ক্ষেত্রে এই প্রবণতা মোটেই ভাল নয়। যেহেতু
বাবা-মায়ের কাছ থেকে তারা যে অবিচ্ছিন্ন মনোযোগ পায় তা কেউ খণ্ডন করতে পারে না,
তাই তারা সবসময় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে
থাকতে চায়।
বখাটে
হয়ে যাওয়া: একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে পড়াশুনা বা অন্যান্য অনেক
বিষয়ে বাবা-মায়ের অস্বাভাবিক প্রত্যাশার প্রচণ্ড চাপ একজন একক সন্তানকে সবসময় ঘিরে
থাকে। নিজের স্বাচ্ছ্যন্দের কারণে সে একবার কোনও কিছু মুখ ফুটে চাইলেই অভিভাবক
সাধ্যমতো তা পূরণ করার চেষ্টা করেন। এই অনায়াস প্রাপ্তি থেকে তারা অকারণে জেদি হয়ে
যেতে পারে। আর এই জেদ থেকে তৈরি হতে পারে বখাটে হয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
স্বার্থপরতা: একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে প্রতিটি
বাবা-মা তাদের সন্তানকে অতিরিক্ত সুরক্ষার কবচে মুড়ে রাখেন। এই অতিরিক্ত সুরক্ষা
তাদের সাঙ্ঘাতিক রকমের স্বার্থপর করে তুলতে পারে। এর ফলে তাদের নিরাপত্তাহীনতার
শিকার হয়ে পড়ার ঝুঁকি খুব বেশি থাকে।
মনোযোগসন্ধানী: একক সন্তান মনোযোগসন্ধানী হয়। বন্ধু তৈরি
করতে পারে না। দলে গিয়ে সবার সঙ্গে মিশতে পারে না। এই মানসিক বৈকল্য থেকে তাদের
মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি করে, যা তাদের অকারণ মনোযোগসন্ধানী করে তোলে।
স্বাভাবিক ভাবেই এটাও কোনও ভাল স্বভাবের লক্ষণ নয়।
খেলাধূলায়
অতিরিক্ত আগ্রহ: সমস্ত ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অতিরিক্ত অংশগ্রহণ এদের একঘেয়ে
করে তুলতে পারে। তার ফলে একবার সুয়োগ পেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে একক সন্তানদের একটু
বেশিরকম খেলাধূলায় আগ্রহী হয়ে উঠতে দেখা যায়। অতিরিক্ত কোনও কিছুই ভাল নয়।
খেলাধূলাও নয়। এতে পড়াশুনার ক্ষতি হয়।
কম
মিশুকে: একক সন্তানের পক্ষে সামাজিক হয়ে ওঠা সমস্যা হতে পারে। কারণ
এরা প্রকৃতিগত ভাবে কম মিশুকে হয়। বাবা-মায়ের নিরন্তর সাহচর্য পেতে পেতে সামাজিক
হওয়ার প্রাকৃতিক শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত হয়। সমবয়সীদের সঙ্গে একেবারেই মিশতে পারে
না।
রোগপ্রবণ: একক সন্তানের রোগপ্রবণ হয়ে ওঠারও খুব
বেশি সম্ভাবনা রয়েছে। অতিরিক্ত যত্নে রাখা হয় বলে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা
শক্তিশালী হয়ে ওঠে না। ফলে সামান্য সংক্রমণেই তাদের কোনও না কোনও রোগভোগ লেগে
থাকে।
মানসিক
চাপ: এদের মানসিক চাপও কিছুটা বেশি হয়। একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে বয়সকালে
বাবা-মায়ের পুরো দায়িত্ব তাদের কাঁধে চলে আসে। সে দায় ভাগ করে নেওয়ার কেউ থাকে না।
কর্তব্যের এই দায়বদ্ধতা তাদের মানসিক চাপ বাড়ায়।
অতিরিক্ত
আত্মবিশ্বাস: অনেক একক সন্তান এত বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে যে সেটা
একগুঁয়েমির পর্যায়ে চলে যায়। এই ধরনের স্বভাব জীবনযুদ্ধে আখেরে ক্ষতির কারণ হয়ে
দাঁড়াতে পারে।
দ্বন্দ্ব
মানিয়ে নেওয়ার অক্ষমতা: নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে এই ধরনের
সন্তানদের এক ধরনের অবাস্তব পর্যবেক্ষণ থাকে। তাই দ্বন্দ্ব বা সঙ্ঘাত মানিয়ে নেওয়া
বা সমাধানের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে এক ধরনের অক্ষমতার সৃষ্টি হয়।
কিছু তথ্য
·
বয়ঃসন্ধিকালে যে-কোনও মানুষের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বন্ধুত্ব
হয়, সে একক
সন্তান হোক বা সহোদর-যুক্ত সন্তান
·
গোটা বিশ্ব জুড়েই পরিবারের আয়তন কমছে এবং একক সন্তানদের
সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে
·
সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে শৈশব বা কৈশোরেও যে-কোনও
মানুষের প্রচুর বন্ধু হয়। এর সঙ্গে একক সন্তান বা সহোদর আছে এমন সন্তানের তুলনা
করা অর্থহীন
·
একক সন্তানেরা তাদের বন্ধুদেরই নিজের ভাই বা বোন হিসেবে
কল্পনা করে
কিছু
গবেষণা ও সনাতন ধারনার পরিবর্তন
একক সন্তানমাত্রেই আদরে বাঁদর হয়ে যায় এরকম একটা ছাঁচে ঢালা বিশ্বাস একসময় অধিকাংশ মানুষের মধ্যে চালু ছিল। সাধারণভাবে, মনে করা হত যে একলা সন্তান হয়ে জন্মানো শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কারণ সহোদর ভাই বা বোনের অনুপস্থিতি মানে জীবনের বহু কার্যকরী শিক্ষা যথাসময়ে লাভ না করতে পারা। তা ছাড়া একমাত্র সন্তান হওয়ার সুবাদে বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রশ্রয় ও সুরক্ষা এই সব সন্তানদেরে বাস্তব সমস্যা সমাধান করতে শেখায় না, এমন একটা বিশ্বাসও দীর্ঘদিন সাধারণ মানুষের মনে বজায় ছিল। অনেকে এমনও মনে করতেন, একলা সন্তান ছোট থেকে চরম আত্মকেন্দ্রিক, না-মানিয়ে চলা ব্যক্তিত্ব ও অসুখী হয়ে বড় হয়ে ওঠে। হার্ভার্ডের মনস্তত্ত্ববিদ ও গবেষক জি স্ট্যানলি ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে প্রথমবারের মতো এই ধারনাটির সূত্রপাত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিইং অ্যান ওনলি চাইল্ড ইজ এ ডিজিজ ইন ইটসেল্ফ।’ অথচ এ ব্যাপারে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কিন্তু খুবই মুশকিল। কারণ পরবর্তীকালে মূলত বিদেশের নানা গবেষণায় এই ধারনার বিপরীতে প্রচুর তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সামাজিক মনস্তত্ত্ববিদ সুসান নিউম্যান এই ধরনের বিশ্বাসকে তাই মিথ বলেই মনে করেন। তাঁর মতে হাজার হাজার গবেষণা করেও একক সন্তানের সঙ্গে, সহোদর আছে এমন সন্তানের কোনও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি
একইরকম
ভাবে একটি জনপ্রিয় বিশ্বাস হল, সমাজবিমুখ একক সন্তানদের পক্ষে বন্ধু খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত
দুরূহ। অথচ ২০০৪ সালে আমেরিকার মিডল ও হাইস্কুল ছাত্রদের মধ্যে একটি সমীক্ষা করে
দেখা গেছে, এই ধরনের
বিশ্বাসের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টোনিও
ফ্যালবোও একই মত পোষণ করেন। একক সন্তানের ওপরে একাধিক গবেষণাধর্মী কাজ করে তিনি এই
সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সাধারণ শিশু ও সহোদরহীন একক শিশুর মানসিক গঠনের মধ্যে কোনও
মূলগত পার্থক্য নেই। তাই একক শিশু নিঃসঙ্গ, স্বার্থপর, মিশুকে নয় ইত্যাদি বলা অবান্তর। বরং
উভয়ের মধ্যে এই পার্থক্যটাই পরিলক্ষিত হয় যে, সহোদরহীন একক শিশু অনেক বেশি ইতিবাচক।
তারা পড়াশুনাতেও ভাল ফল করে। জীবনসংগ্রামেও দুরন্ত যোদ্ধা হয়। তারা যে তাদের
বাবা-মায়ের অখণ্ড মনোযোগ পায়, ভাল ফল করার পেছনে সম্ভবত সেই কারণটাই রয়েছে।
নেদারল্যান্ডে
করা একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, একলা সন্তান তাদের সমসাময়িক বন্ধুদের
মধ্যে মোটেও কম জনপ্রিয় নয়। সুতরাং একলা সন্তানরা অসুখী এমন দাবির যৌক্তিকতা মেনে
নেওয়া যাচ্ছে না। ১৯৮৭ সালে ১৪১টি একক শিশুর ওপরে ১৬টি ব্যক্তিত্ব বিষয়ক বৈশিষ্ট্য
নিয়ে করা অন্য একটি সমীক্ষাতেও প্রচলিত জনপ্রিয় ধারণাগুলির বিপরীত তথ্য উঠে এসেছে।
দেখা গেছে, এই ধরনের
কোনও শিশুর মধ্যেই কোনও সামঞ্জস্যহীনতার ব্যাপার থাকে না। এই সমীক্ষা থেকে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি উঠে এসেছে তা হল, একক শিশুর সঙ্গে সহোদর আছে এমন অন্য
শিশুদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। বরং একক সন্তানদের দৃষ্টিমুখ অন্যান্যদের তুলনায়
অনেক তীব্র। আসলে এই সব শিশুর প্রতি বাবা-মায়ের অখণ্ড মনোযোগ তাদের এইরকম গুণে
গুণান্বিত করে তোলে।
তাই খুব
সংক্ষেপে বলা যায়, মানুষের মনে গেঁথে বসে থাকা এই ধরনের সনাতন বিশ্বাস আজ মিথ
বলে প্রমাণিত। তবু এটা ভাবতে খারাপ লাগে যে একক সন্তানের পক্ষে বহু বহু
গবেষণাপ্রাপ্ত ফল থেকে ইতিবাচক তথ্য বেরিয়ে আসার পরেও তাদের আজও সেই একই অভিধায়
অভিহিত করা হচ্ছে। একক সন্তানকে সেই স্বার্থপর, বখাটে, একগুঁয়ে তকমার বাইরে আমরা দেখতে পাই না।
সম্ভবত চাই না বলেই।
পর্ব
পাঁচ: একক সন্তানের সুবিধাও অনেক
একক
সন্তানের বাবা-মা
তিন-চার
দশক আগেও একক সন্তানের বাবা-মায়েদের মাঝে মাঝেই কিছু সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি
হতে হত। কারণ বড় পরিবারের সন্তানসংখ্যা সাধারণভাবে একাধিক হত। তাই তখন এক
সন্তানের বাবা-মাকে সমাজে কিছুটা ভিন্ন চোখে দেখা হত। বন্ধু বা পরিবারের
শুভানুধ্যায়ীরা তাঁদের অন্তত আরও একটি সন্তান আনার জন্য চাপ দিতেন। এই চাপ দেওয়ার
কোনও নির্দিষ্ট সময় বা পরিবেশ থাকত না বলে তাঁরা পদে পদে বিব্রত হতেন। আজ অবশ্য
দিন পাল্টেছে। অধিকাংশ দম্পতিই এখন একক সন্তানের পক্ষপাতী। তবুও সম্ভবত একটা
নেতিবাচক ভাবনা তাঁদের মধ্যে থেকে যায়। আর তাই সামাজিক চ্যালেঞ্জ না হোক,
নিজের মনের থেকে উঠে আসা কিছু ভাবনা আজও
অনেক সময় তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়। সন্তানকে সহোদর না এনে দেওয়ার জন্য অনেক সময়ই
তাঁদের মনে অনুশোচনা হয়। তাঁদের মৃত্যুর পরে তাঁদের সন্তান একা হয়ে যাবে,
এই রকম নানা ভাবনায় তাঁরা উদ্বিগ্ন
থাকেন। তবে এই নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে এবং বহু গবেষণাই বাবা-মায়ের এ জাতীয় ভাবনাকে
অবান্তর প্রমাণ করেছে। ওপরের আলোচনাতেও এই প্রসঙ্গ এসেছে এবং গবেষণাগুলি থেকে
বিপরীত তথ্য পাওয়া গিয়েছে। জানা গেছে, একক সন্তানের পিতৃত্ব বা মাতত্বের সুবাদে
তাদের বাবা-মা বরং কিছু কিছু বাড়তি সুবিধা পান। এই সব সুবিধার মধ্যে সবচেয়ে বড়
হল, তাঁরা
তাঁদের সন্তানকে সমানভাবে ভালবাসা ও মনোযোগ দিতে পারেন।
একক
সন্তানের সুবিধা
একক
সন্তান থাকার অসুবিধের অনেকগুলি কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে আগে। আবার এমন কিছু কিছু
গবেষণার কথাও বলা হয়েছে, যেখান থেকে এই ধারনা করা যাচ্ছে যে,
একক সন্তান সংক্রান্ত অসুবিধেগুলো আসলে
মিথ। এবারে সরাসরি কিছু সুবিধের কথায় আসা যাক, যাদের কোনও মতেই অগ্রাহ্য করা যাবে না।
যেমন,
জোরালো
বন্ধন: একক সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধন খুব জোড়ালো হয়। সম্পর্কের মধ্যে থাকে
উষ্ণতা। এই বন্ধন দু’তরফের পক্ষেই ভাল। পরিবারের মধ্যে থাকা এই বন্ধুত্বপূর্ণ
সংবেদনশীল পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রে জটিল সমস্যা তৈরি হতে দেয় না। মানসিক স্বাস্থ্যের
পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
প্রাপ্তি: একক সন্তান হওয়ার সুবাদে বাবা-মায়ের
পক্ষে যা দেওয়া সম্ভব সেই মানবিক স্নেহ ও ভালবাসা থেকে শুরু করে জাগতিক সমস্ত
কিছুর মধ্যে সাধ্যমতো সেরা বস্তুটি সে পেতে পারে। একটু ভিন্ন ভাবে বললে বলা যায়,
অন্য সহোদর ভাই-বোনের সঙ্গে বাবা-মায়ের
ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ভাগাভাগি হওয়ার ব্যাপারটাও তার ক্ষেত্রে থাকে না। এই বাড়তি
পাওনা সে নানাভাবে, বিশেষ করে পড়াশুনায় খরচ করতে পারে। এতে তার প্রাপ্তির
ভাণ্ডার পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সহজেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ ঘটে।
অখণ্ড
মনোযোগ: একটাই সন্তান, সুতরাং তাকে ঘিরে থাকে বাবা-মায়ের অখণ্ড
মনোযোগ। আজকের এই জটিল পৃথিবীতে বিভিন্ন শিশুরা যখন নানাভাবে উপেক্ষিত তখন কোনও
সুস্থ পরিবার যেখানে সদস্যদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলি বেঁচে আছে,
সেখানে থাকা একটি একলা শিশুর জীবনে এই
অখণ্ড মনোযোগ অবশ্যই অসীম গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সহোদর ভাই বোন থাকে না বলে বাবা-মায়ের
মনোযোগ পেতে অন্য কোনও ভাই-বোনের সঙ্গে তাদের প্রতিযোগিতায় নামতে হয় না।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা নির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়াই অন্যান্য ভাইবোনের সঙ্গে তাকে
তুলনা করা হয় না।
একচ্ছত্র
অধীশ্বর: অন্য কোনও ভাই-বোনের সঙ্গে কিছু ভাগ করে নেওয়ার থাকে না।
তাই নিজের পরিবারে একজন একক সন্তান একচ্ছত্র সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে থাকে।
নিজেদের স্বাধীন রাজ্যে এরা অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে।
একক
সন্তান: কয়েকটি মিথ
মিথ: একক সন্তান আগ্রাসী ও প্রভুত্বকামী হয়
আসল
সত্য: সাধারণত একক সন্তান যে-কোনও জিনিস খুব দ্রুত শিখে নেয়। এই দ্রুততাকে অনেক
ক্ষেত্রেই আগ্রাসী ও প্রভুত্বকামী মনোভাব বলে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। এর ফলে তারা
খুব সহজেই দলচ্যুত হয়ে পড়ে। আগ্রাসী ও প্রভুত্বকামিতা প্রতিটি মানুষেরই এক ধরনের
বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে একক সন্তান হওয়ার কোনও যোগাযোগ নেই।
মিথ: একক সন্তান বখাটে হয়
আসল সত্য: গবেষকরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাঁদের
মতে এই ধরনের ধারণা একেবারেই ভুল। একক সন্তানের সঙ্গে এই ক্ষেত্রে সহোদর-যুক্ত
সন্তানদের কোনও পার্থক্য নেই। পরিস্থিতি অনুকুল না হলে যে-কোনও সন্তানই বখাটে হয়ে
যেতে পারে।
মিথ: একক সন্তান স্বার্থপর হয়
আসল সত্য: প্রতিটি শিশুই কোনও না কোনও সময় মনে করে
যে পৃথিবীটা তার একার। যারা পরের মত সহ্য করতে পারে না এবং শুধু নিজের কথাই ভাবে
তাদের স্বার্থপর বলা হয়। প্রতিটি মানুষ জীবনের নানা প্রান্তে স্বার্থপরতা দেখাতে
পারে। এর সঙ্গে একক সন্তানের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মিথ: একক সন্তান দ্রুত পরিণত হয়
আসল
সত্য: সহোদরযুক্ত প্রতিটি শিশু সাধারণভাবে নিজেদের তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে তুলনা না
করে ভাই বা বোনের সঙ্গে তুলনা করে। অর্থাত সহোদরদের চালচলনের দ্বারা তারা প্রভাবিত
হয়। অথচ একক সন্তানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক রোল মডেল তাদের বাবা-মা। এর ফলে একক সন্তান
প্রাপ্তবয়স্কদের আচার-আচরণ, কথা বলার ধরন নকল করতে শুরু করে। এ ছাড়া তাদের মধ্যে দ্রুত
যুক্তিবাদী মনের প্রকাশ দেখা যায়। বড় হয়ে ওঠার সময়কালে তারা সহজেই জীবনের
ওঠা-পড়া সামলে নিতে পারে। সুতরাং এই পরিণত হওয়াটা মোটেও নেতিবাচক নয়।
মিথ: একক সন্তান পরনির্ভরশীল
আসল
সত্য: বরং উল্টোটাই সত্যি। বড়দের দ্বারা পরিচালিত হতে হতে এবং সহোদরদের অনুপস্থিতির
কারণে ছেলেমানুষী শিক্ষা না পেয়ে একক সন্তান অনেক ছোট বয়স থেকেই আত্মনির্ভরশীল হয়ে
ওঠে। এটা তাদের জীবনযুদ্ধে সামিল হতে সাহায্য করে।
হীনমন্যতা
আসে না: আগেই লিখেছি একক সন্তান হওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল,
এরা কখনই বাবা-মায়ের ভালবাসা বা মনোয়োগ
থেকে বিচ্যুত হয় না। তার ফলে হীনমন্য হয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না। যে সমস্ত শিশু নতুন
ভাই-বোন হওয়ার কারণে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ থেকে বঞ্চিত হয়,
তাদের মধ্যে হীনমন্যতা আসে,
এটা পরীক্ষিত সত্য। হঠাত মনোযোগ হারিয়ে তারা
অনেক সময় মানসিক সমস্যাতেও আক্রান্ত হয়। একক সন্তানের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যার
কোনও সম্ভাবনা নেই।
বেহিসাবি হয় না: একক সন্তান সংসারের অর্থনীতিটি খুব দ্রুত
বুঝে যায়। তার ফলে তাদের অনেকের মধ্যে বেহিসাবি খরচের প্রবণতা জন্মায় না। তারা
মিতব্যয়ী ও বাস্তব ঘেঁষা হয়।
একক
সন্তান পালন
বড়
পরিবার থেকে নিউক্লিয়ার পরিবার কিংবা একাধিক সন্তানের পরিবর্তে একক সন্তান- এই
পরিবর্তনের পেছনে অনেক কারণ থাকলেও এটা মেনে নেওয়ার সময় এসে গেছে যে একক সন্তানকে
স্বাভাবিকভাবে বড় করে তোলা আজকের অভিভাবকের পক্ষে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এক
সন্তান ও একাধিক সন্তানকে মানুষ করার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। একদল সমাজমনস্ক
গবেষকের মতে একজোড়া যমজ বাচ্চা আর দুটি আলাদা বাচ্চা মানুষ করার মধ্যে যেমন
পার্থক্য, ঠিক
তেমনি একক সন্তান পালনের ক্ষেত্রটিও কিছু বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।
আগেই
লিখেছি, কিছুদিন
আগেও একক সন্তান পালন করার বিষয়টি কতগুলি বাঁধাধরা নেতিবাচক ভাবনার বেড়াজালে
সীমাবদ্ধ থাকত। সৌভাগ্যবশত সেই ছাঁদে বাঁধা ভাবনাগুলি সাম্প্রতিক গবেষণার নিরিখে
ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে সন্তান, সে একলাই হোক বা একাধিক, পালন করাটাই চ্যালেঞ্জের। শুধু একক
সন্তানের ক্ষেত্রে বিষয়টাকে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা বাঞ্ছনীয়।
পর্ব ছয়:
প্রত্যাশা যেন বাস্তব ঘেঁষা ও বয়সোচিত হয়
নতুন
নতুন গবেষণা এবং নানা লেখায় একক সন্তানকে মানসিক ও সামাজিক বিচারে স্বাস্থ্যকরভাবে
গড়ে তোলার জন্য নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেই রকমেরই কয়েকটি টিপস-
১)
সামাজিকতার শিক্ষা- কিছুদিন আগেও একক সন্তানের সামাজিক নৈপুণ্যকে কিছুটা বাঁকা
চোখে দেখা হত। মনে করা হত, তাদের সামাজিক সত্তার বিকাশ দেরিতে হয় অথবা ভাল করে হয় না।
সৌভাগ্যবশত আজকের দিনে শহরে-গ্রামে গড়ে ওঠা নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানের (যেমন,
প্রি স্কুল,
আঁকার ক্লাস,
বিভিন্ন ক্যাম্প ইত্যাদি) সাহায্যে খুব
ছোটরাও সামাজিক শিক্ষা পাচ্ছে। আমার মনে হয়, আপনার একক সন্তানকে এই সব প্রতিষ্ঠানে
সামিল করে দিলে তারা খুব সহজে অন্য ছোটদের সঙ্গে মিশতে শিখবে এবং সামাজিকতার
প্রাথমিক পাঠটুকু পেয়ে যাবে।
আাবার
এটাও ঠিক যে সামাজিকতার পাঠে এই সব প্রতিষ্ঠানকে একমাত্র আদর্শ হিসেবে ধরে নেওয়ার
কোনও সঙ্গত কারণ নেই। এই ব্যাপারে বাবা-মাকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে
নিজেদের প্রচেষ্টায় শিক্ষাদানও চালিয়ে যেতে হবে। যেমন,
গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা,
সবাইকে ভাগ দিয়ে তার পরে কোনও কিছু নিজে
নেওয়া অর্থাত শেয়ার করতে শেখা, সহানুভুতিশীল ও বিবেচক হওয়া, আপস করতে জানা,
নিয়মমাফিক খেলাধূলা করা,
হারা বা জেতা দুটি ঘটনাকেই সমানভাবে
গ্রহণ করতে পারা, ঝগড়াঝাটি না করা, ইত্যাদি। তা ছাড়া ওদের নিজেদের মতো করে
বাড়তে দেওয়াটাও দরকার।
একই
সঙ্গে বাবা-মায়েদের অনুরোধ করব তাঁরা যেন নিজেদের সামাজিক মেলামেশাও বাড়াতে
থাকেন। আমাদের প্রতিটি পরিবার এখন যেন ধীরে ধীরে এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের
বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে। যদি পরিবার-সহ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটানো যায়
তা হলে সন্তানেরাও নিজের খেলার সঙ্গী পেয়ে যাবে।
২)
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধের শিক্ষা- একক সন্তানদের মধ্যে সহজেই বখাটে ও
আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে বলে একটা বিশ্বাস বহুদিন ধরে চালু ছিল। এই
ধারণাটিও যে ঠিক নয় বর্তমান গবেষণা তেমনটাই দাবি করছে। তবুও একক সন্তানকে ব্যক্তি
স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধের বিষয়ে উতসাহ দিতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানকে অতি
সুরক্ষিত রাখার ব্যাপারে যে আদিখ্যেতা একক সন্তানের বাবা-মায়েরা দেখিয়ে থাকেন,
তা থেকে সযত্নে দূরে থাকা দরকার। একক
সন্তানকে নানাভাবে সাহায্য করা যেতেই পারে, তবে তার ফলে সে যাতে অন্যের ওপরে
নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে সেদিকে নজর দিন। শিশুদের নতুন নতুন উদ্ভাবনে উতসাহ দিন,
ভুল করা ও ভুল থেকে শিক্ষাদানের চেষ্টা
করুন। দূর থেকে নজর রেখে শিশুদের নিজের মতো করে নিজেদের কাজ করতে দিন তাতে তারা
স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে এবং কীভাবে ভাল থাকা যায় শিখবে। সঠিক দায়িত্ববোধের শিক্ষায়
তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের হোমওয়ার্ক বা ব্যক্তিগত বিষয়গুলি অনুশীলন করবে। এই
শিক্ষা থেকেই পরবর্তীকালে তাদের জীবনবোধের অঙ্গীকার তৈরি হবে।
তার ২৫
বছর বয়স হয়ে ওঠা অবধি আপনার সন্তানের জুতোর ফিতে আপনি বেঁধে দিতেই পারেন কিংবা
আজীবন তার ঘর পরিষ্কার করে দেওয়াই যায়, কিন্তু সেটা কী কখনও কাম্য হতে পারে?
তাকে নিজের মতো করে বড় হয়ে উঠতে দিন।
শুধু একান্ত প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই তাকে সাহায্য করুন। যে বয়সে যে ধরনের কাজ করা
উচিত তা তাকে সম্পূর্ণ করতে দিন। এতে তার মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে। আর এই বোধ
তার বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি ধাপ থেকে শুরু করে সারা জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় হয়ে
থাকবে।
একক সন্তান হওয়ার সুবিধা
·
বাবা-মায়ের ঘনিষ্ঠতা (এমনকী বন্ধুত্ব) বেশি থাকে
·
বিশেষ ধরনের নিরাপত্তার বোধ কাজ করে
·
কোনও সহোদরের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়াতে হয় না
·
বড়দের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারে
·
নিজের সঙ্গতেই আত্মতুষ্টি লাভ করতে শেখে
৩)
অতিরিক্ত প্রশ্রয় নয়- একটি সন্তান থাকুক বা তার বেশি,
কোনও ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত প্রশ্রয় ভাল নয়।
বিশেষ করে একক সন্তান বড় করে তোলার ক্ষেত্রে এই বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া উচিত,
কারণ একক সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের
প্রশ্রয় দেওয়ার ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাই এই ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন
থাকুন। দেখা গেছে, একক সন্তানের অভিভাবকদের মধ্যে একটা ‘অতি’ ব্যাপার থাকে।
তাঁরা তাঁদের সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেন, অতিরিক্ত সুরক্ষা দেন,
প্রয়োজন না থাকলেও প্রচুর খেলনা বা
অন্যান্য জিনিসপত্র কিনে দেন। এই সব ‘অতি’ বিষয়ের ফলে একলা সন্তানটির চাহিদা খুব
বেশি রকম বেড়ে যেতে পারে। যখন যা চাইবে তা সময় মতো না দিতে পারলে তারা অশান্তি
সৃষ্টি করতে পারে। এর মানে আপনার সন্তানকে কোনও কিছু কিনে দেবেন না,
এমন কিন্তু বলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে,
অতিরিক্ত প্রশ্রয় না দিয়ে,
কিংবা তার প্রত্যাশা কিছুটা দেরি করে
মিটিয়ে, আপনি
আপনার একক সন্তানকে ধৈর্য্যের পাঠ দিতে পারেন। এই শিক্ষা তাকে সহিষ্ণু হতে শেখাবে।
সুতরাং আপনাদের এই বিশেষ বদগুণটি দমন করা খুব প্রয়োজন। ধীর ও স্থির থাকুন এবং
কতগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্মণরেখা মেনে চলুন।
৪)
সীমাবদ্ধতার পাঠ- পরিবারে তার ভূমিকা কতটা হওয়া উচিত এবং এই বিষয়ে তার
সীমারেখা কতটুকু সেটা একজন একক সন্তানকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া ভাল। তবে খেয়াল
রাখতে হবে সেটা যেন তার পক্ষে দায় না হয়ে ওঠে। একক সন্তানের মধ্যে খুব সহজে
জ্যাঠামি করার প্রবণতা তৈরি হতে পারে। এমনকী সে আপনার কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার
চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারে। সুতরাং সীমারেখা ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাকে
বুঝিয়ে দেওয়া ভাল যে তার কোন কোন কার্যকলাপ কতটা অবধি সহ্য করা যাবে/যাবে না। এই
ধরনের কাজে আপনার একক সন্তানটির নিরাপত্তা বোধ তৈরি হবে। সে এটাও বুঝতে পারবে যে
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি সীমানা দ্বারা নির্দিষ্ট এবং এটা সর্বক্ষেত্রেই মেনে
চলা বাঞ্ছনীয়।
৫)
প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণ করুন- অধিকাংশ একক সন্তান প্রায়ই তাদের বাবা-মায়ের সম্পূর্ণ
মনোযোগ পেয়ে থাকে। মনোযোগ প্রাপ্তি অবশ্যই ভাল, তবে একটা কথা মনে রাখা উচিত যে ‘বেশি ভাল,
ভাল নয়’। বরং এই অতিরিক্ত মনোযোগের
ব্যাপারে ধারাবাহিক নজরদারি থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খেয়াল রাখুন আপনার সন্তানের
যেন এমন মনে না হয় যে, আপনার মনোযোগ শুধু তার কাজের সাফল্যের ওপরে নির্ভরশীল। আসলে
একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে সন্তানের ওপরে বাবা-মায়ের প্রত্যাশা খুব বেশি থাকে।
প্রত্যাশা থাকা খারাপ নয়। তবে সেই প্রত্যাশা যেন বাস্তব ঘেঁষা ও বয়সোচিত হয়।
প্রত্যাশার মধ্যে যেন কোনওভাবেই উতকর্ষতা বিচারের কোনও ছোঁয়া না থাকে। বরং তাকে নিজেদের
অটুট ভালবাসা দিয়ে যান। আর সেটাই আপনার সন্তানের জন্য এমন একটি সুরক্ষিত পরিবেশ
তৈরি করবে, যা তাকে
ইতিবাচক ও আত্মমর্যাদাপূর্ণ করে তুলবে এবং সামাজিক সুসম্পর্ক স্থাপন করতে শেখাবে।
তা ছাড়া অন্য আর একটি ব্যাপার হল, একক সন্তান বাড়ির ‘প্যারেন্ট ফিগার’ বা
তার সমকক্ষ হয়ে উঠুক এরকম একটা ইচ্ছেও বাবা-মায়ের মধ্যে থাকে। এই ইচ্ছে তার মধ্যে
নিরাপত্তাহীনতা এনে দিতে পারে। তাই এই ধরনের স্পষ্ট চাহিদা ও নির্দিষ্ট প্রত্যাশা
বর্জন করুন।
৬)
বন্ধুত্ব করতে দিন- একক সন্তানকে বড় করে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়টি হল তাদের অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে দেওয়া। অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মিশে তারা
তাদের খেলার সঙ্গীর অভাব মেটাতে পারে। আপনার সন্তানকে সামাজিক করে তোলার অনেক উপায়
আছে। যেমন, বন্ধু
পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রি-স্কুল একটি বড় মাধ্যম, তাছাড়া আপনার সন্তানকে কোনও খেলার
কোচিংয়ে ভর্তি করে দিতে পারেন। এই পরামর্শ আগেও দেওয়া হয়েছে। যদি তারা বয়সে একটু
বড় হয় তবে স্কুলের পরে তাদের কোনও অ্যাক্টিভিটি ক্লাসে ভর্তি করে দিন। সেই সঙ্গে
আপনি নিজেও তার সামাজিক ক্ষেত্রটিকে বাড়াতে সাহায্য করুন। তাকে বন্ধুর সঙ্গে আপোস
করতে, বন্ধুর
প্রতি সহনাভুতিশীল হতে, তাদের সঙ্গে কোনও কিছু ভাগাভাগি করে নিতে শেখান। এই ধরনের
প্রতিটি শিক্ষাই জীবনের প্রতি আলোকপাত করতে শেখাবে।
৭)
অতিরিক্ত সমালোচনা এড়িয়ে চলুন- একক সন্তানের অতিরিক্ত সমালোচনা করবেন
না। সে যখন কোনও ভুল করবে তখন তার কঠোর সমালোচনা বা বকাঝকা করা আপনার পক্ষে খুবই
সহজ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে তাতে অধিকাংশ সময় কাজ হয় না। বরং তাকে শৃঙ্খলার
প্রয়োজনীয়তাটুকু সহজ করে বোঝানো দরকার এবং সে বোঝানোর মধ্যে যেন আন্তরিকতা থাকে।
ভুল তো মানুষ মাত্রেরই হয়। সুতরাং অতিরিক্ত সমালোচনায় না গিয়ে তার সঙ্গে গঠনমূলক
আলোচনা করুন যাতে সে নিরুতসাহ না হয়ে পড়ে। সে একবার ভুল করতে পারে,
দু’বার কিংবা তিনবারও করতে পারে কিন্তু
ধৈর্য্য ধরে বোঝালে সে হয়ত চারবারের বার আর সেটি করবে না।
সূত্র: কৌশিক রায়
No comments:
Post a Comment