Thursday, June 13, 2024

তবলা

সন্ধ্যায় পাড়াতে জলসার আসর।দর্শক সমাগম নেহাত মন্দ নয়।বিলু সামনের দিকেই বসার একটা জায়গা জোগাড় করে ফেলেছে।মঞ্চে গায়ক তখনও ওঠেনি।বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যন্ত্রীরা তৈরি হচ্ছে।কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে তবলচি ছোট্ট একটা হাতুড়ি দিয়ে তবলার বেড়ের পাশের ছোটো ছোটো কাঠের টুকরোগুলোকে একটু করে ঠুকে তবলার চাঁদিতে চাঁটি মেরে তার বোল কান খাড়া করে শুনে আবার হাতুড়ির ঠোকা।এভাবে পুনরাবৃত্তি হতে থাকল।বিলু একসময় অধৈর্য হয়ে বলে ফেলল," ধুর! কেবলই

তবলায় ঠোকাঠুকি হচ্ছে ।গান কখন যে শুরু হবে কে জানে।" পাশ থেকে সিধু জ্যাঠা বলে উঠলেন," একে আটঘাট বাঁধা বলে।তবলায় কাঙ্ক্ষিত বোল বা তাল আনতে গেলে এটা করতে হয়।" তিনি আরও যোগ করলেন, " বুঝলি বিলে! আমরা যে বলে থাকি আটঘাট বেঁধেই তবে কাজে নামতে হয়, সেই ' আটঘাট ' কথাটা কিন্তু তবলার এই আটঘাট বাঁধা থেকেই উদ্ভব হয়েছে ।"

কয়েকদিন পর এক বিকেল বেলা সিধু জ্যাঠার সাথে দেখা হতেই বিলে পাকড়াও করল," সিধু জ্যাঠা, সেদিন আটঘাটের কথা বলছিলেন । তো সেটা কী?"

"ঠিক আছে, বলব।চল ..", বলে সিধু জ্যাঠা পার্কের কোণে বাধাঁনো বেঞ্চের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। কংক্রিটের বেঞ্চে দুজনে বসতেই সিধু জ্যাঠা শুরু করলেন, " তবলার আটঘাট কী তা জানার আগে আমরা এই তবলার উৎপত্তি কীভাবে হলো তা শুনব।"

“ আমাদের ভারতবর্ষে তবলা-বাঁয়ার প্রচলন শুরু হয় মুসলিম শাসনের আমলে। তবলার উৎস আরবি।আরবি শব্দ ' তব্‌লাহ " থেকে এর উৎপত্তি।তবলার সৃষ্টি বা আবিষ্কার নিয়ে নানা মুনির নানা মত।কথিত আছে, আদি তবলা তৈরি করেছিলেন আরবে জুবলের পুত্র টুবল। তাই আবিষ্কারকের নামানুসারেই এর নামকরণ করা হয়েছিল তবলা। এই বাদ্যযন্ত্রটি আরব-সঙ্গীত শিল্পীদের সূত্রে পারস্যে প্রবেশ করেছিল। তবে আমির খসরুর আগে ভারতবর্ষে তবলা নামক কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল কি না , তা কিন্তু জানা যায় না। অনেকেই মনে করেন, আমির খুসরু পারস্যের গজলের সাথে ব্যবহৃত দুই খণ্ডের বাদ্যযন্ত্রকে সংস্কার করে তবলায় রূপ দেন।১৩০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির রাজত্বকালে তিনি পারস্যেরএই যন্ত্রটির সংস্কার করে 'তবলা' নামক বাদ্যযন্ত্র দরবারে উপস্থাপিত করেন।

সঙ্গীতাচার্য গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সদারঙ্গের শিষ্য দ্বিতীয় আমির খসরু তবলার উদ্ভাবন করেছিলেন।উল্লেখ্য এই আমির খসরু ছিলেন মোগল সম্রাট তৃতীয় মহম্মদ শা'র আমলে (১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)। আবার আবার কেউ কেউ এই মতও পোষণ করেন, দিল্লির জনৈক পাখোয়াজ শিল্পীর সাথে সম্রাট আকবরের দরবারে প্রসিদ্ধ পাখোয়াজ বাদক সিধার খাঁর একটি পাখোয়াজ-বাদনের প্রতিযোগিতা হয়।ওই প্রতিযোগিতায় সিধার খাঁ পরাজিত হন।তিনি তখন ক্ষোভে, দুঃখে আর অভিমানে তাঁর অতি প্রিয় পাখোয়াজটিকে দুই টুকরো করে ফেলেন।এরপর ক্ষোভ প্রশমিত হলে এই পৃথক দুই টুকরোকে মেরামত করে আলাদা দুটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে তৈরি করেন এবং তা পরবর্তী কালে তবলা নামে পরিচিত হয়I
তবলা পরিচিতি:

তবলা : দুই খণ্ডের তবলা-বাঁয়ার সেটের একটি অংশ হলো তবলা।

সাধারণত এই অংশটি ডান হাতে বাজানো হয় বলে,একে ডাইনও বলা হয়।কিছু কিছু বাদক এই অংশটি বাম হাতেও বাজিয়ে থাকেন।সাধারণত নিম,চন্দন,বিজয়শাল, আম, কাঁঠাল গাছের কাঠ দিয়ে তবলার দেহ কাঠামো তৈরি করা হয়।এই কাষ্ঠখণ্ডের কম ব্যাসযুক্ত অংশের উপর থেকে খুঁড়ে ফাঁপা অংশ তৈরি করা হয়।

কানি : অন্য নাম চাঁটি।তবলার ছাউনির প্রান্তভাগে একটি পৃথক চামড়ার আচ্ছাদন থাকে।এই অংশকে বলা হয় কানি।

পাগড়ি : তবলার কানি ও মূল চামড়ার সাথে যুক্ত করে, চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়।এই বিনুনি অংশকে পাগড়ি বলা হয়।

ডোরি : এর আলাদা নামও আছে-

ছোট্,বদ্ধি বা দোয়ানী।পাগড়ির ১৬টি ছিদ্র পথে যে চামড়া ফিতা প্রবেশ করিয়ে, নিম্নাংশে কাঠের গুঁড়ির অংশের সাথে দৃঢ় করে বাঁধা হয়, তাকে ডোরি বলা হয়।

ময়দান :এর অন্যান্য নাম লব , সুর প্রভৃতি। তবলার খিরন এবং প্রান্তদেশীয় কানি অংশের ভিতরে যে বৃত্তাকার অংশ দেখা যায়,তাকে বলে ময়দান।

খিরন : একে শাহী বা গাব নামেও অভিহিত করা হয়।তবলার ছাউনির মধ্যস্থলে যে গোলাকার কালো অংশ থাকে, তাকে খিরন বলা হয়।গাবগাছের আঠার সাথে কাঠকয়লা মিশিয়ে আঠালো লেই তৈরি করা হয়। উক্ত লেই দিয়ে কয়েকটি পর্যায়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। খিরণ গাব-ফল দিয়ে তৈরি হয় বলে,এর অনেক সময় গাব নামেই পরিচিতি মেলে।খিরন তবলার মূল চামড়ার উপরে বসানো হয়।

গুলি : এর অন্য নাম গট্টা বা গুটি।তবলার উপরের ছাউনির সটান অবস্থা এবং পছন্দ অনুযায়ী আওয়াজ পাওয়ার জন্য ডোরির ভিতরে কয়েকটি কাঠের তৈরি লম্বাটে গোলাকার গুলি ব্যবহার করা হয়। এই গুলি উপরে নিচে নামিয়ে তবলার সুরকে নিম্ন বা চড়ায় নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

ডুগি (প্রচলিত নাম বাঁয়া): ডুগির মূল দেহকাঠামো মাটি বা ধাতু দিয়ে তৈরি হয। সাধারণত এর ধাতু হিসেবে পিতল, তামা বা এরূপ কোনো সংকর ধাতু ব্যবহার করা হয়।এর গঠন অনেকটা হাঁড়ির মতো।

এবারে মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।কথাটি বাগধারা রূপে বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত।আমরা দৈনন্দিন ব্যাবহারিক জীবনে হামেশাই চারিদিকে 'আটঘাট ' বেঁধে কাজে নামার কথা বলে থাকি।আটঘাট বাঁধা বলতে বোঝায় কোনও কাজ শুরু করার আগে সকল রকম ব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করে তবেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু এই 'আটঘাট বাঁধা ' শব্দবন্ধটি বাগধারারূপে বাংলা শব্দভাণ্ডারে কীভাবে জায়গা করে নিল?

গান গাইতে গেলে সাধারণত তবলার অনুসঙ্গ অপরিহার্য।গানের সাথে তবলায় সঙ্গত করতে গান শুরুর অনেক আগেই তবলচিকে তবলার ‘আটঘাট’ বেঁধে নিয়ে উপযুক্ত তাল বা লয়ের উপযোগী করে তুলতে হয়।এখন প্রশ্ন হলো এই ' আটঘাট বাঁধা ' ব্যাপারটা কী?

আগেই আমরা বর্ণনা করেছি, তবলার কানির চতুর্দিকে মোট আটটি কাঠের বর্তুলাকার গুলি বা গুটির ওপর চারটি করে চামড়ার ফিতে থাকে যা পাগড়ি থেকে নেমে আসে।এই আটটি গুলির মাঝে আটটি ফাঁক থাকে।প্রত্যেকটি ফাঁককে ঘাট বলে।আটটি গুলির মধ্যেকার এই আটটি ফাঁক 'আটঘাট 'বলে পরিচিত সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরুর আগে তবলচি এহেন আটটি কাঠের গুলির ওপর লোহা বা রুপোর ছোট্ট হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে ফিতেগুলিকে প্রয়োজনানুযায়ী শক্ত বা ঢিলে করে সুষমভাবে স্বরের মাত্রা বা তাল পাওয়ার জন্য মিলিয়ে নেন।তবেই তবলা ঈপ্সিত সুরে বাজে।একে বলা হয় ' আটঘাট বাঁধা’।

এবার বলি, আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাতেও বুঝি এইভাবে তাল মিলিয়ে নিতে হয়।বুঝলি?কোনও কাজে নামার আগে সবদিক ভেবেচিন্তে ' আটঘাট বেঁধে ' নিয়ে তবে শুরু করতে হয় নইলে আরব্ধ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে গিয়ে তাল কেটে যেতে পারে। “

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এল। পার্কের আলোগুলো জ্বলে উঠল।আর অন্ধকার রইল না।

--প্রবীর চট্টোপাধ্যায়

সূত্র :

■বঙ্গীয় শব্দকোষ - হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

■ তবলার ইতিবৃত্ত-শম্ভুনাথ ঘোষ।


No comments:

Post a Comment